গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৫

সাঈদা মিমি


চিঠি

সাতরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে পুরোপুরি আউলে গেলাম, একটা দুইটা নয়, পুরো আটাশ বছর পর বিরুদের বাড়ি খুঁজছি, কোথায় সেই সাদারঙের দেড়তলা বাড়িটা? সব পথগুলো একইরকম, প্রায় নিঝঝুম জায়গাটার একি দশা! আলিশান সব বাড়িঘর, সেই গাছপালায় ছাওয়া জায়গাটি উধাও, দিঘাবাড়ির পুকুর খুঁজেই পেলাম না, পূন্যবাগান? নেই, যেন ভিনগ্রহবাসিরা এসে রাতারাতি গায়েব করে দিয়ে গেছে! মরণ, কি ভাবছি? মাঝখানের আটাশ বছর কি ভুতে খেলো? কিন্তু বিরুদের বাড়িটা? ওটা পেতে হবে, বিরু কে দরকার, ওর কাছে আমার একগুচ্ছ আমানত পড়ে রয়েছে, মাত্র গতকালই জেনেছি পাপিয়ার ছোট বোন নিরুপমার কাছে, পাপিয়া মানে পাপিয়া, আমার একমাত্র বন্ধু ক্লাসমেট

নিরুপমাকে আমি চিনতেই পারিনি, ওকে শেষবার যখন দেখেছি তখন সে নেহায়েত শিশু, অতিরিক্ত ফর্সা আর বিড়ালের মত সাদা চোখ, নিরুর নাকটা ছিলো আকর্ষণীয় তীক্ষ্ণ নিটোল, মৃদুলের সাথে তখনও সম্পর্ক ছিলো উষ্ণ, তারপর একটা ব্যাপার ঘটলো, মৃদুল লটারী জিতে আমেরিকা চলে গেলোকথা ছিলো আমাদের বিয়ে আগে হবে তারপর যাবে, বাস্তবিকই আমরা অনেক বেশি বাস্তববাদী ছিলাম, এভাবে বিয়ে করে নতুন বৌ কে রেখে যেতে চায়নি , আমিও চাই নি, অবশেষে সে চলে গেলো আমরা নির্জনে কয়েকটা দিন কাটালাম, অনেক গল্প করলাম, খুব কাঁদলাম, তারপর অপেক্ষা, পড়ার চাপ, আমিও স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে যাবো এমন কথাই ছিলো, যদিও তৃতীয় মাসেই খবর এলো, মৃদুল এক শেতাঙ্গিনীকে বিয়ে করেছে, একটা ক্ষমাসূচক চিঠিও পেলাম, তার গ্রীণকার্ড পাকাপোস্ত করার কিসব জানি লেখা ছিলো ওতে, এসব ক্ষেত্রে মহৎ সাজা দুঃসাধ্য, চিঠিটা ছিঁড়ে ফেললাম

এবার বাবার কথা একটু বলি, বাবা প্রচণ্ড অহংকারী, তিনি এলিটদের সাথে ওঠাবসা করতেন এবং আমি মাঝে মাঝেই বলতাম, বাবা তুমি ফ্রান্সে চলে যাও, এই দেশের পরিমণ্ডলে তুমি সুখি থাকতে পারবে না, আমার এরকম কৌতুক বাবার পছন্দ ছিলো না আমার ওপর ক্ষেপে থাকতো সে অজস্র নিয়ম ভাঙার অপরাধে, নীচু জাতের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠার কারণে, এমনকি মৃদুল এর মত নিম্ন মধ্যবিত্ত ছেলেকে ভালোবাসার কারণেও, বাবা চান নি আমি মৃদুল কে বিয়ে করি, পরমপিতা তার ইচ্ছে কবুল করে নিলেন এবং আমি আরশাদুল্লা হাইস্কুলে মাস্টারনী হিসেবে যোগ দিলাম নিরুপমা ওর স্বামীর সঙ্গে সৌদি আরব থাকে, সেদিনের নেংটি পড়ে ঘোরা মেয়েটি! আমাদের দেখা হলো নিউমার্কেটে, আমি চিনতে পারিনি আমাকে চিনে নিয়েছে, এত আনন্দ লাগলো, এত কথার দিননিজেও পরিবার নিয়ে দেশে বেড়াতে এসেছি মাসখানেক হলো, হ্যাঁ, বিয়েশাদি করে আমিও আমেরিকা থাকি, তবে নিউইয়র্কে নয়, সাউথ ক্যারোলিনায় এবং মৃদুলের সাথে যোগাযোগের কোন চেষ্টাই করিনি নিরু কে নিয়ে বসেছি একটা কাবাব ঘরে, অনেক গল্প করছি কিন্তু মৃদুলের বিষ কিছুই জিজ্ঞেস করিনি, বোধকরি আমার ক্ষোভ অনুভব করেছিলো সে, হঠাৎ বলে উঠলো, দাদার কথা কিছু জানতে চাইলে না? বিব্রত বোধ করি একটু? নাহ, করা উচিৎ নয়, মধ্যবয়স মানুষকে সাহসী করে তোলে, কি জানতে চাইবো? তোমার দাদা নিঃসন্দেহে ভালো আছে, সত্যি বলতে কি আমিও ভালো আছিকিন্তু তুমি সৌদি আরব কেন? আমার স্বামী গালফ এয়ারের কো-পাইলট, তাই…….

নীরু মাথা নীচু করে বসে ছিলো, ওর চারবছরের ছেলেটা চেয়ারের নীচ দিয়ে পায়ে সুড়সুড়ি দেয়া খেলায় ব্যাস্ত, হয়তো আমি একটু বেশীরকম রূঢ় আচরণ করে ফেলেছি, নিরুপমার চোখ থেকে জলের ফোঁটা পড়লো চাওমিনের ওপর, আমি দুঃখিত নীরু, আসলে এভাবে বলতে চাইনি, তুমি কেন দুঃখিত হচ্ছো বুবু? কিছু কি জানতে পেরেছিলে তুমি? সত্যটা? সত্যিটা? নীরু, কোন সত্য? আমেরিকা যাওয়ার তিনমাস পর দাদার লিউকোমিয়া ধরা পড়েছিলো, লাস্ট স্টেজ, আরও বছরখানেক, তোমাকে জানানো বারণ ছিলোনীরু, এতবড় সত্য কেন আড়াল করলে আমার কাছ থেকে? দাদা চায়নি তুমি জানো, সইতে পারতে না, দাদা ফিরলো কফিনে, একবছর তিনমাসের প্রতিটা দিন তোমায় চিঠি লিখেছে সে, পাঠিয়েছিলো বিরুদার কাছে

আমাকে লেখা মৃদুলের তিন সাতানব্বইটা চিঠি পড়ে আছে বিরুর কাছে, আজ আঠাশটা বছর ওর শেষকথাগুলি জানার জন্য, ভালোবাসার অস্তিত্ব কে আবার ফিরে পাওয়ার উচ্চাশা নিয়ে, হরেক গলিপথ ঘুরছি, দেড়তলা সাদা বাড়িটা কোথায়?