স্বপন
দীর্ঘ তের বছর পর হঠাৎ গড়িয়াহাটের মোড়ে স্বপনের সাথে দেখা। না, ঠিক বললাম না। মধ্যে বার দু’এক ওর সাথে দূর্গাপুর বা পানাগড়, কোথায় যেন, হাওড়া আসার পথে খুব অল্প সময়ের জন্য দেখা হয়েছিল। ভিড় ট্রেনে সে ভাবে কথা বলার সুযোগ ছিল না। তবু ওরই মধ্যে সামান্য দু’চার কথায়, তার পুরানো স্বভাবের ছবিটাই ফুটে উঠলো। মানুষের জীবনে শেষ পরণতি মৃত্যু, আর কথায় বলে স্বভাব যায় না ম’লে….। কাজেই মরলেও যে স্বভাবের পরিবর্তন হয় না, কর্মস্থল সামান্য এক জেলা থেকে অন্য জেলায় স্থানান্তরিত হলে স্বভাব পরিবর্তন হবে– কোন হালায় কয়?
মেয়ের বিয়ের বাজার করতে গিয়ে, গড়িয়াহাটের মোড়ে হঠাৎ স্বপনের সাথে একবারে মুখোমুখি দেখা। অল্প কথায় জানতে পারলাম যে, সে চাকরী থেকে বছর পাঁচেক আগে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে, এখন টিউশন করে। গড়িয়াহাটের এক বহুতল ফ্ল্যাটে সে এখন থাকে। তার স্ত্রী চাকরী করে। দু’জনের আয়ে তাদের বেশ স্বচ্ছলতায় দিন কাটে। ফ্ল্যাটটা কিনেছে, না ভাড়া নিয়েছে, জিজ্ঞাসা করা হ’ল না। তবে মনে হ’ল, সে নিজের ফ্ল্যাটেই থাকে।
চাকরীসুত্রে আমাকে মেদিনীপুর জেলার একটা প্রত্যন্ত গ্র্রামে বদলি হয়ে যেতে হয়েছিল। প্র্রায় কুড়ি কিলোমিটার দুরের একটা মহকুমা শহর থেকে, অফিস যাতায়াত করতাম।
ঐ একই সময় আরও অনেকের মতো, স্বপনও বদলি হয়ে ঐ মহকুমা্ শহরেই পোষ্টিং পায়। আমরা জনা পাঁচেক ছেলে, ঐ শহরেই একটা তিনতলা বাড়ির ওপর তলায় আস্তানা গাড়লাম। বাড়িটার তিনতলায় খানকয়েক ঘর। সবকটা ঘরই লজ্ হিসাবে ভাড়া দেওয়া হয়। আমাদের এই পাঁচজনের মধ্যে স্বপন একজন। কিছুদিন পরে যে যার নিজের নিজের পছন্দ ও সুবিধা মতো ব্যবস্থা করে নিলেও, স্বপন আর আমি একটা বেশ বড় ঘরে থাকতাম। আমাদের এই ঘরটা ছাড়া আর সব ঘরে লোক আসতো, একদিন দু’দিন থেকে চলে যেত। একমাত্র এই ঘরটাতে, আমরা দু’জনে মাসিক ভাড়ায় থাকতাম। ঘরটার মুখোমুখি দুটো দরজা। সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে পাশাপাশি দুটো চৌকি। উল্টো দিকে আর একটা দরজা, সেটা দিয়ে বেরলে খানিকটা খোলা ছাদ, যাকে ওপন টেরাস বলে। ঠিক পাশ দিয়ে বাস রাস্তা। কলকাতা, হাওড়া থেকে আসা বাস, ঐ রাস্তায় যাতায়াত করে।
বাড়িওয়ালা ব্রজেনদার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বেশ ভাল। আমাদের তিনি খুব সম্মান করতেন। ঘরের চৌকি, বিছানা, চাদর, বালিশ, মশারি, টেবিল, আয়না, সব ব্রজেনদার। এমন কী প্রতি শনিবার আমরা বাড়ি চলে এলে, বালিশের ঢাকা, বিছানার চাদর, কেচে ভাঁজ করে আমাদের বিছানায় রেখে দেবার দায়িত্বও, ব্রজেনদার স্ত্রীর ছিল। ছাদের দরজা খুলে প্রতিদিন ভিজে গামছা বা টুকটাক কাচাকাচি করা জামা প্যান্ট তুলে যার যার বিছানার ওপর ভাঁজ করে রাখার দায়িত্বও বৌদির ছিল। ঘরের দরজার চাবি আমরা বৌদির কাছে রেখে অফিস যেতাম। সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে দেখতাম, ঘরে ধুপ জ্বলছে। ধুপদানি ও ধুপ, দুই-ই ব্রজেনদার। আমরা শুধু মাস গেলে একটা টাকা ধরে দিতাম। সেটাও খুব ন্যায্য, হয়তো কম বলা-ই ঠিক হবে।
আমি অফিস থেকে ফিরে, স্নান সেরে, বিছানায় শুয়ে বই পড়তাম। স্বপন পাশের চৌকিতে গালে হাতের ভড় দিয়ে শুয়ে, ব্যাঙ্কিং পরীক্ষার প্রস্তুতি নিত। মাঝে আমি অঞ্জনের ঝুপড়িতে খেতে যেতাম। স্বপন তার সময় মতো অঞ্জনের ঝুপড়িতে বা অন্য কোথাও খেতে যেত।
আমি চিরকালই নিশাচর। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে, শুয় শুয়ে বই পড়তাম। দশটা-সাড়ে দশটার মধ্যেই স্বপন ঢুলতে শুরু করতো। মাঝে মাঝে গাল থেকে হাত সরে গিয়ে, চৌকি থেকে পরে যাবার উপক্রম হ’ত। আমি ওকে ডেকে শুয়ে পড়তে বলতাম। ও কোন কথা না বলে, মশারি
খাটিয়ে শুয়ে পড়তো। ও কিন্তু বেশ ভোরে উঠতো, এবং আমাকে সময় মতো ডেকে দিত। ও ডেকে না দিলে আমার অফিস কামাই হবার সম্ভাবনা ছিল যথেষ্ট।
অবিবাহিত স্বপন কলকাতায় কোন গভর্নমেন্ট কোয়ার্টার্সে থাকতো। সম্ভবত তার বাবা চাকরী সুত্রে ঐ কোয়ার্টার্সটি পেয়েছিলেন, এবং স্বপনের কথায় মনে হ’ত, ঐ কোয়ার্টার্সে যারা একবার ঢোকে, তারা কেউই আর সে কোয়ার্টার্স ছেড়ে যায় না। ঠিক মতো ভাড়া দিলে, ছাড়তেও হয় না।
উচ্চতায় সামান্য খাটো হলেও, স্বপন ছিল অত্যন্ত স্মার্ট, ও বেশ ফরসা। ডীপ্ কালারের গেঞ্জি পরলে তাকে বেশ সুপুরুষ বলা যেতেই পারতো। সে খুব স্বাস্থ্য সচেতনও ছিল। রোজ না হলেও, প্রায় প্রতিদিনই সে একটা সুন্দর লাফদড়ি নিয়ে স্কিপিং করতো। খাওয়া দাওয়াও ছিল যথেষ্ট পরিমিত। কিন্তু তার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গোটা রুটিনটাই, এমন কী তার দৈনন্দিন কাজকর্ম, কথাবার্তা, সব কিছুই ছিল, নারীপছন্দ দিয়ে নিখুত ভাবে বোনা। নারীরা কী পছন্দ করে, সেটা সে নিজেই নিজের ধারণা দিয়ে ঠিক করে নিত, এবং ঐ একই কারণে সে খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও ফিটফাট্ থাকতে ভালবাসতো।
সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে লজে ফিরে প্রায়ই দেখতাম, সে অফিস থেকে বাসায় ফেরে নি। যদিও তার অফিস ছিল লজ্ থেকে মাত্র পাঁচ-সাত মিনিটের হাঁটাপথ, আর আমার অফিস ছিল প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দুরে। কোথায় যেত জানি না। রাস্তায় কোন কোন সময় তাকে অন্য ছেলেদের সাথে গল্প করতে দেখতাম। তাদের হাবভাব, চেহারা, স্বপনের সাথে খাপ খেত না। আর স্বপনের সাথে তাদের আলোচনার একমাত্র বিষয়বস্তু ছিল– “স্বপনদা, আজ একটা যা দারুণ দেখতে মেয়েকে দেখলাম না, একবারে চাবুক” গোছের। ও কিন্তু সবার সামনে স্বচ্ছন্দে এসব আলোচনা করতো। কোন কোন দিন লজে ফিরে দেখতাম দু’চারজনকে নিয়ে স্বপন আমাদের ঘরে আসর জমিয়ে বসেছে। ওর অফিসের ম্যানেজারকেও মাঝে মাঝে এই আসরে অংশ গ্রহণ করতে দেখতাম। কোন না কোন স্পনসর ম্যানেজ করে আমাদের ঘরে খানা পিনার আসর বসাতো। যেহেতু এলাকাটা ট্রান্সপোর্ট ব্যবসার জন্য বিখ্যাত, তাই স্পনসর করার লোকেরও অভাব ছিল না। তবে এই আসরেও আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল নারী, এবং মুখ্য বক্তা ছিল– অবশ্যই স্বপন। তবে এইসব আসরে তাকে কিন্তু কোনদিন বেহেড হতে দেখি নি। বিনামূল্যে, অথচ পরিমিত পানাহার এর পিছনে হয়তো স্বাস্থ্য সচেতনতা, এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার পিছনে হয়তো মেয়েদের পছন্দ কাজ করতো।
অদ্ভুত চালচলন ছিল তার, যার সাথে কারো মিল খুঁজে পেতাম না। প্রসাধনের জন্য নানা রকম ক্রী্ম, নানা আকারে্র ও আকৃতির চিরুণী, শ্যাম্পু, সাবান, মাথায় মাখার তেল ইত্যাদি, তার ভান্ডারে সব সময় মজুদ থাকতো। এমন কী যে কোন সময়ে প্রয়োজন হতে পারে ভেবে চৌকির ঠিক পাশে, টেবিলে সব কিছু হাতের কাছে সাজানো থাকতো। চিরুণী যে কত প্রকারের হতে পারে, তার সংস্পর্শে এসে জেনেছিলাম। সরু দাঁতের, মোটা দাঁতের, খুব
সরু দাঁতের গোঁফ ছাঁটার, গোল এবং তার চার পাশে দাঁত, খুব মোটা মোটা ও ফাঁক ফাঁক দাঁতের ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমরা সাধারণত ভোরে ঘুম ভাঙ্গার পরে, আলস্য ভাঙ্গার জন্য আড়মোড়া ভেঙ্গে একটু শুয়ে থেকে, মশারি থেকে বেড়োই। স্বপন কিন্তু ভোরে চোখ মেলেই এক টানে মশারি ফাঁক করে চৌকি থেকে নীচে নেমে, নানা আকারের চিরুণী দিয়ে, নানা ভাবে চুল আঁচড়ে নিত। অত সকালে ঘরের মধ্যে কেন যে ঘুম থেকে উঠেই তার চুল আঁচড়াবার প্রয়োজন হ’ত, সেই বলতে পারবে।
বিবাহিত জীবন সম্বন্ধে তার বক্তব্যও ছিল পরিস্কার ও বাঁধিয়ে রাখার মতো। কোন রকম রাখঢাক্ না রেখে সে বলতো যে, সে এমন মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, যে হয় চাকরী করবে, না হয় অনেক টাকা যৌতুক দেবে। বাচ্ছা সমেত কোন মেয়েকে বিয়ে করতেও তার আপত্তি নেই, তবে সে ক্ষেত্রে কিছু অ্যাডিশনাল শর্ত আছে। চাকরী অথবা অনেক টাকা যৌতুক ছাড়া বাচ্ছার খরচ স্ত্রীকেই যোগাতে হবে, এবং তার জীবনের গতিবিধিতে কোন রকম বাধা দেওয়া চলবে না। কনট্র্যাকট্ অ্যাকট্ এ আইন বলে, কনসিডারেশন ছাডা কোন চুক্তি আইনসিদ্ধ নয়। স্বপনও বোধহয় সেটা জানতো, বুঝতো এবং মানতো। তাই ঐ কনডিশনাল বিবাহের কনসিডারেশন হিসাবে তার বক্তব্য ছিল, তার ভাবী স্ত্রী-ও তার নিজের পছন্দ মতো যার সাথে খুশী, যেখানে খুশী ঘুরে বেড়াতে পারবে, তাতে স্বপনের কোন আপত্তি থাকবে না, এবং এ ব্যাপারে সে কোন প্রশ্নও করবে না, বা বাধাও দেবে না।
যাহোক্, এ হেন স্বপনের দিন শুধুমাত্র মেয়েদের নিয়ে আলোচনা ও কল্পনায় সীমাব্দ্ধ থেকে ভালই কাটছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে নানা আকারের চিরুণী দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে যত্ন করে চুল আঁচড়ে, দাঁত মেজে, হাত মুখ ধুয়ে চা খেতে যাওয়া। তারপর আমি অফিসে বেড়িয়ে যাবার পর, কোন এক সময় টুকটাক কাচাকাচি করে, স্নান সেরে, কোন হোটেল বা ঝুপড়িতে খেয়ে নিয়ে, অফিস যাওয়া। অফিস থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে, মুখে ক্রীম দিয়ে নীচ থেকে ওপর দিকে ম্যাসাজ্ করে সেই ক্রীম মাখা। এ ভাবে ক্রীম না মাখলে, অর্থাৎ মুখের ওপর থেকে নীচের দিকে হাত দিয়ে ঘষলে মুখের চামড়া ঝুলে যাবে, যেটা কোন মেয়েই পছন্দ করবে না। তারপর বই নিয়ে পড়তে বসা, কারণ ব্যাঙ্কিং পরীক্ষায় পাশ করতেই হবে।
তবে মাঝে মাঝে মন মেজাজ ভাল করতে শহর ছেড়ে আট-দশ কিলোমিটার দুরে একটা ছোট সিনেমা হলে, নাইট শোতে মালয়ালাম সিনেমা দেখতে যাওয়া। যদিও ছবির নাম হিন্দীতেই লেখা থাকতো, এবং ছবির নাম দেখে “নদের নিমাই” গোছের কোন নিরীহ ছবি বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। সিনেমা দেখে অত রাতে লজে ফেরার অসুবিধার জন্য ভ্যান রিক্সাওয়ালাকে টিকিট কেটে তার সাথে সিনেমা দেখানোর বুদ্ধিটাও তা্র, এবং অনেক রাতে সিনেমা দেখে কী ভাবে ফিরেছে, সেটা বেশ গর্ব করে আমাকে গল্পও করতো। বেশী টাকা ভাড়া এবং বিনা পয়সায় অত ভাল সিনেমা দেখার লোভ কোন ভ্যান রিক্সাওয়ালা ছাড়তে চায়? স্বপনের মতো সেও তো রক্ত মাংসের মানুষ।
অন্যান্য দিন রাতে বাইরে থেকে খেয়ে এসে আবার বই নিয়ে বসা, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ লাল করে ঢুলতে থাকা। আমি তাকে ডেকে দিয়ে শুয়ে পড়তে বললে্ই, মশারি খাটিয়ে শুয়ে পড়া। কিন্তু এর মাঝে স্বপনের জীবনে একটা বড় পরিবর্তন এল। আর তার জন্য দায়ী তার এক বন্ধু, যে চাকরী সূত্রে না পড়াশোনার জন্য, আমেরিকায় থাকতো। স্বপনের কাছে শুনতাম সেই বন্ধু নাকি তার নামে সেখান থেকে ডলার পাঠায়। নিজের বাড়ি, নিজের আত্মীয় স্বজন ছেড়ে, সে যে কেন স্বপনের নামে ডলার বা টাকা পাঠাতো, বলতে পারবো না।
এই বন্ধু নাকি স্বপনকে জানিয়েছে যে, আমেরিকায় মেয়েরা কলেজে প্রায় বিকিনি পরে আসে। এরকম একটা উত্তেজক সুখবর শোনার পরে আর শুয়ে বসে থাকা চলে না। কথায় বলে, যে শুয়ে থাকে তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে। তাই সে আর এক মুহুর্তও সময় নষ্ট না করে, ব্যাঙ্কিং এর সমস্ত বইপত্র ওপরের তাকে তুলে রেখে, উচ্চ শিক্ষার্থে আমেরিকা যাবার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দিল। বিদেশে পড়তে গেলে যে পরীক্ষায় বসতে হয়, তার জন্য বইপত্র কিনে জোর কদমে পড়াশোনা শুরু করে দিল। তখন যদি চৈত্র সেলের মতো স্বপনকে কেউ অফার দিত যে, আমেরিকা ছাড়া পৃথিবীর যে কোন দেশের, যে কোন ইউনিভার্সিটিতে, ঐ একই কোর্স পড়তে যেতে পারে, এবং তার জন্য তাকে কোন টেষ্ট্ দিতে হবে না, স্বপন রাজী হ’ত না। আমেরিকা যাবার জন্য সে জীবন বাজি রাখতেও রাজী আছে। ব্যাঙ্কিং এর পরিবর্তে বিদেশ যাবার জন্য পড়াশোনা, এটুকু অমিল বাদ দিলে, আর সব রুটিন ঠিক আগের মতোই থাকলো।
মাঝে একবার স্বপন ও মানিক হঠাৎ ব্রজেনদার
লজ্ ছেড়ে কিছুটা দুরে এক মুসলিম ডাক্তারের বাড়ি ভাড়া নেবার ব্যবস্থা করলো। মানিক প্রথম দিকে আমাদের সাথে এই লজেই থাকতো। ঐ ডাক্তার বিদেশে গেছেন এবং দোতলা বাড়ির একতলাটা ভাড়া দেওয়া হবে। আমার সেখানে যাবার কোন ইচ্ছা ছিল না। বাড়িটার ভাড়া অনেক বেশী, অফিস যাবার জন্য আমাকে বাস ধরতে অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হবে। তাছাড়া তিনতলার ওপর ব্রজেনদার লজ্ অনেক নিরিবিলি ও আলো হাওয়া যুক্ত। সেখানে ভাড়া অনেক কম, অথচ স্বাধীনতা ও সুযোগ সুবিধা অনেক বেশী। ব্রজেনদার স্ত্রী ও মা আমাদের বেশ ভালবাসতেন। একপ্রকার লোকাল গার্জেন সুলভ ছিলেন। আমাদের দ্বারা রান্না করে খাওয়া বাস্তবে সম্ভব হবে না, তাই শুধু শুধু অত বড় বাড়ি ভাড়া নেওয়ার কোন কারণই, আমার কাছে যুক্তিযুক্ত বলে মনে হ’ল না।
তবু ওদের সাথে ওদের অনুরোধে, নতুন বাড়ি দেখতে যেতেই হ’ল। একতলায় চারটে বড় বড় ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম পায়খানা। একতলাটা ডাক্তার এখানে থাকার সময় নার্সিং হোম ছিল। একতলার ভিতর দিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, সিঁড়ির মুখে কোলাপসিবল্ গেট্। আবার একতলায় না ঢুকেও, পাশের প্যাসেজ দিয়ে দরজা খুলে ঐ একই সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠা যায়। যাহোক্, একতলায় তিনটে ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম পায়খানা নিয়ে আমাদের নতুন সংসার শুরু হ’ল। একটা ঘর বন্ধ করে দেওয়া হ’ল। প্রথম দিনই রান্না করা, বাজার করা নিয়ে ঝামেলা হ’ল। আমি অনেক সকালে অফিস বেড়িয়ে যেতাম, ফেরারও আমার কোন ঠিক ছিল না। কোনদিন সন্ধ্যাবেলা, আবার কোনদিন বেশ রাত হয়ে যেত। আমি বললাম আমার পক্ষে বাজার করা বা রান্না করা, কোনটাই সম্ভব হবে না। তাছাড়া সকালে আমি যখন অফিস যাই, সেই সময়ের মধ্যে সকালের রান্নাও কোনদিন শেষ করা সম্ভব হবে না।
ওদের দু’জনের পক্ষে অতবড় বাড়িটা নেওয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে যাবে বলে, ওরা আমাকে ছেড়ে দিতেও পারছে না। শেষে ওরা বাধ্য হয়ে বাজার করা ও রান্না করার দায়িত্ব নিজেরা
নিল। দিন দশ পনের কাটার পর, একদিন সকালে স্বপন সংবাদ দিল যে, গতকাল রাতে ও একটা আওয়াজ পেয়ে ওঠে, এবং একজন মহিলাকে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুতবেগে ওপরে উঠে যেতে দেখে। আমি বললাম সিঁড়িতো একটাই। বাইরের দরজা দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে তো ওঠাই যায়। তাছাড়া সিঁড়ির মুখে কোলাপসিবল্ গেটে তো ওদের ও আমাদের দু’দুটো তালা লাগানো, আমাদের এদিকে কেউ আসবেই বা কেন এবং কী ভাবেই বা আসবে? স্বপন জানালো, ডাক্তারের স্ত্রী বোধহয় কোন কারণে নেমে এসেছিল। ওর পায়ের আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি ওপরে ফিরে যায়। বেলা যত বাড়তে লাগলো, স্বপনের বর্ণনায় ডাক্তারের স্ত্রীর সৌন্দর্যও তত বাড়তে থাকলো। অথচ ও নিজেই বলছে আগন্তুককে সে ভালভাবে দেখতেই পায় নি।
এরপর ওর ধারণা হ’ল ডাক্তারের স্ত্রী রাতে আবার আসবে, এবং আমরা না থাকলে সেটার সম্ভাবনা অনেক বেশী। কয়েক রাত আধো জাগরণেও যখন্ কাউকে আসতে দেখা গেল না, তখন আশায় আশায় ও পরপর দুটো শনিবার কলকাতার বাড়িতে না ফিরে, ওখানে একা থেকে গেল। বেচারা স্বপন, ও সত্যি কাউকে দেখেছিল বলে আমার মনে হয় না। যদি দেখেও থাকে, সে শুধু স্বপনের কল্পনার ছিপে ফাৎনা নাড়িয়ে চলে গেছে। টোপ খেতে কোন শনিবারই সিঁড়ি ভেঙ্গে আসে নি। শেষে আর কিছুদিন পরে ব্রজেনদার অনুরোধে, আমরা
আবার ব্রজেনদার লজের সেই পুরানো ঘরে ফিরে গেলাম। স্বপন বোধহয় এই বাড়িটা নেহাত অপয়া বলেই, ফিরে যেতে আপত্তি করলো না। মানিক অন্য জায়গায় আলাদা ঘর ভাড়া নিল।
কলেজ বা চাকরী জীবনে দেখেছি, যাকে নিয়ে আর সকলে মজা করে, যে আর সকলের কাছে আনন্দের, মজার রসদ হয়ে দাঁড়ায়, তাকে
মুরগী বলে। আমি আমার জীবনে এরকম অনেক, অনেক মুরগীকে দেখে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, শতকরা দশজনকে আর সকলে মুরগীতে রুপান্তরিত করে। বাকী নব্বই শতাংশ, মুরগী হয়েই ধরাধামে প্রবেশ করে। যেন মুরগী হবার জন্যই তারা বলিপ্রদত্ত। স্বপন অবশ্যই দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত লেগহর্ন মোরগ। ফলে তাকে নিয়ে ঐ কষ্টের দিনেও আনন্দে সময় কাটাতে, আমাদের বিশেষ কোন বেগ্ পেতে হয় নি।
কোনদিন সন্ধ্যার পর অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরলে, আমি ও আমার অফিসের সহকর্মী, শুভাশীষ বাসায় না ফিরে বাজারে গিয়ে, বাজার দর করে, চা খেয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে, যে যার বাসায় ফিরতাম। ও আমার লজের কাছেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে একা থাকতো। মাছের দর, আলুর দর, সবজীর দর, চালের দর ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করে, যদিও জানতাম আমাদের বিনা পয়সায় ঐ সব সামগ্রী দিলেও নেবার উপায় ছিল না, তবু একা একা ঘরে বসে না থেকে, এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটাতাম। এই সান্ধ্য ভ্রমনে মাঝে মধ্যে স্বপনকে পাওয়া যেত। সেদিন আর সময় কাটাবার জন্য বাজার দর করতে হ’ত না। স্বপনই আমাদের বাজার দরের বিকল্প রসদ হয়ে যেত। স্বপনের নারী সংক্রান্ত আলোচনায় আমার নঞর্থক মতামত প্রায়ই তার উৎসাহে বিঘ্ন ঘটাতো। ফলে সে আমাকে প্রায়ই বলতো– “তোর কোন বাইয়লজিক্যাল নীডই নেই”।
একদিন সন্ধ্যার সময় আমি, স্বপন ও শুভাশীষ, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ স্বপন বললো, “ঐ মেয়েটাকে দ্যাখ”। রাস্তার পাশে একটা বাড়ি। রাস্তার ঠিক পাশে লম্বা গ্রীল দেওয়া বারান্দা। বারান্দার পরে পর পর ঘর, ঘরেরও পরে বোধহয় বাইরের বারান্দার সমান্তরাল প্যাসেজ। সেই প্যাসেজের দিকে স্বপনের নির্দ্দেশ মতো চোখ যেতে মনে হ’ল, লাল রঙের কিছু একটা চলে গেল। সে মহিলা না পুরুষ, সালোয়ার কামিজ না শাড়ি না জামাপ্যান্ট পরিহিত তাও বোঝার আগেই, সে অদৃশ্য হয়ে গেল। স্বপন পুলকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো- “শুভাশীষ, মেয়েটাকে কেমন দেখলি”? শুভাশীষ বললো “ওঃ. স্বপনদা, চমৎকার। এত সুন্দরী একটা মেয়ে এখানে থাকে, আগে কোনদিন দেখিনি তো”? স্বপন বেশ গর্ব ভরে জানালো “ওর সাথেই আমার বিয়ের কথা হচ্ছে”। মনে পড়লো কিছুদিন হ’ল শুনছিলাম স্বপনের অফিসের ম্যানেজার, স্বপনের জন্য পাত্রী দেখছে। বোধহয় স্বপনের অনুরোধেই।
শুভাশীষ গদগদ হয়ে বললো “আপনার পছন্দ আছে স্বপনদা, অসাধারণ। আপনার সঙ্গে খুব ম্যাচ করবে”। অভিজ্ঞতায় শিখেছি মুরগী করার প্রথম ও প্রধান নিয়ম হ’ল, সকলে মিলে পক্ষে বা বিপক্ষে বললে খেলা তেমন জমে না। পক্ষে ও বিপক্ষে, উভয় পক্ষেই, কথা বলার মতো লোক থাকতে হবে। স্বাভাবিক ভাবে শুভাশীষ স্বপনের পক্ষ নিয়ে মেয়েটার সৌন্দর্যের তারিফ করতে লাগলো। যদিও আমার মতো সেও কাউকে স্পষ্ট দেখতে পায় নি, দেখার কোন সুযোগও ছিল না।
“এ রকম মেয়ে আমারও খুব পছন্দ। ঠোঁটদুটো একটু ভিজেভিজে থাকবে”। স্বপন উল্লাসিত হয়ে বললো– “বল্ শুভাশীষ বল, আমিও ঠিক তাই পছন্দ করি”। আমার দিক থেকে কোন মন্তব্য না আসায়, শুভাশীষ আবার শুরু করলো– “হালকা মেক্ আপ নেবে, ছোট্ট টিপ পরবে”। স্থান কাল পাত্র ভুলে, স্বপন প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো– “তোর পছন্দ ঠিক আমার মতো”। শুভাশীষ একটু সময় নিয়ে আবার বললো-
“চিবুকে একটা তিল থাকবে, আর…..”। কথার মাঝে আমি বললাম, “চোখের কোনে পিঁচুটি থাকবে”। ব্যাস, স্বপন ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার করে বললো– “অ্যাই, তুই চুপ করতো, তুই আমার জীবনের শনি। তোর জন্য আমার কিছু হবে না। তুই কী বুঝবি, তোর তো কোন বাইয়লজিক্যাল নীডই নেই”।
উত্তেজনা কমাতে শুভাশীষ নতুন করে শুরু করলো– “স্বপনদা, ওর কোন বোন নেই”? স্বপন বললো “নিশ্চই, ওর একটা বোন আছে। ওর বাবার স্বভাব চরিত্র ভাল নয়। সে অন্য কারো সাথে আলাদা থাকে। মাঝেমাঝে আসে। আমি ভাবছি ওর মা আর বোনকে নিয়ে গিয়ে, কলকাতায় আমার নতুন কেনা ফ্ল্যাটে রাখবো। বুঝলি না, বাবার টাকা, বাড়ি সবই তো আমার হবে, সঙ্গে বোনটাকেও ফাউ হিসাবে পাওয়া যাবে। মা’টাকে তো দেখিস নি, দেখলে মাথা ঘুরে যাবে। ভারী সুন্দর”। শুভাশীষ বললো “স্বপনদা, বোনটার সাথে আমার সম্বন্ধ করুন না। আমার কোন সম্পত্তি চাই না। আপনি চেষ্টা করলে নিশ্চই রাজী হবে”।
তুই রাজী আছিস? একবার বল্, ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু মুশকিল হ’ল আমি এখনও মনস্থির করে উঠতে পারি নি, কোন বোনটাকে বিয়ে করা যায়। মানে দু’জনকে তো আর অফিসিয়ালি বিয়ে করা যায় না। তবে তুই যদি রাজী থাকিস, তাহলে বড়টাকে আমি বিয়ে করে, বোনটার সাথে তোর সম্বন্ধ পাকা করে দিতে পারি। এ যেন গুপি গায়েন বাঘা বায়েন এর “কন্যা কম পড়িয়াছে?” এর মতো কেস্। স্বপন এমন ভাবে কথাগুলো বলছিল, যেন গোটা ফ্যামিলিটাই ওর সম্পত্তি।
সারা রাস্তাটা আমাকে কোন কথা বলার সুযোগ দিল না। কলকাতায় ও যেখানে থাকে, তার প্রায় আশেপাশেই ও একটা এক কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাট কিনেছে। সে ফ্ল্যাট আমাকে ও দেখাতেও নিয়ে গেছে। ভীষণ ছোট, দরজা খুলেই খাটে উঠে পড়তে হবে। ওকে বলেছিলাম, ফ্ল্যাট যদি কিনলিই, তো এত ছোট ফ্ল্যাট কিনতে গেলি কেন? উত্তরে ও বলেছিল “এখানে তো আর থাকবো না। ধর্ কোন বান্ধবী টান্ধবী দু’দিনের জন্য এল, তাকে তো আর নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখা যায় না। তখন দু’একদিন এখানে থাকলাম”। অর্থাৎ ফ্ল্যাট কেনার পেছনেও সেই একই গল্প, এবং এতদিনে, সম্ভব হলে সে গল্পের বাস্তব রুপ দিতে চায়।
রাতে স্বপন আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “তোর কোন বোনটাকে পছন্দ রে”?
একটার সম্ভবত লাল রঙের পোষাক দেখেছি, আর একটাকে চোখেই দেখি নি, স্বপনের মাধ্যমে শুধু বাঁশী শুনেছি। আমি কবি নই, তাই মন প্রাণ যাহা ছিল দিয়ে ফেলা তো দুরের কথা, পছন্দ করাও সম্ভব নয়, এ অবস্থায় কী বলবো। আমি বললাম–“তুই তো বলিস আমার কোন বাইয়লজিক্যাল নীড নেই। কাজেই আমার পছন্দ জেনে তোর কী লাভ? আমার পছন্দ কী আর তোর পছন্দ হবে”?
“তবু বল না শুনি। তোর কোন বোনটাকে পছন্দ”?
“পছন্দ বলতে কী বোঝাতে চাইছিস”?
“মানে তোর কোন মেয়েটাকে বেশী ভাল বলে মনে হয়? মানে তুই হলে কাকে বিয়ে করতিস”?
“সে কী আর এক কথায় বলা যায়? ছোট বোনটাকে তো চোখেই দেখি নি। তাছাড়া ওরা দুজনেই যেরকম সুন্দরী বলছিস, আমার মতো বাইয়লজিক্যাল নীডলেস্ একটা দোজব’রে আধবুড়োকে তারা বিয়ে করতে রাজী হবে কেন? আবার ধর শুভাশীষ যদি সত্যিই ছোট বোনটাকে বিয়ে করে, তাহলে আর আমার পছন্দ করার বা বিয়ে করার সুযোগ কোথায়? দুটি বই মেয়ে তো ভদ্রমহিলার নেই”।
“আহা, তবু তুই বলই না। তোর মতামতটা জানতে চাই”।
এইভাবে যখন সে ব্যাকুল হয়ে আমার মতামতের অপেক্ষায় আকুল, যখন আমার একটা মুখের কথায় তার, ও ঐ দুই বোনের এক বোনের, ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে, যখন্ ও বুঝতে পারছে এত রাতে আর দ্বিতীয় কারোর মতামত পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, তখন বললাম, “আমার মতামতের কী আর কোন মূল্য আছে? তবে আমি হ’লে মা’টাকেই বিয়ে করতাম”।
স্বপন বিরক্ত হয়ে আলোচনা বন্ধ করে দিল। পরদিন থেকে আবার আগের জীবন, আগের রুটিন।
ভাস্কর নামে একটা ছেলে ইনসুরেন্সের কাজে আমার অফিসে আসতো, স্বপনের অফিসেও তার যাতায়াত ছিল। অত্যন্ত ভদ্র ছেলেটা আমাকে দাদা দাদা বলে ডাকতো, ভীষণ শ্রদ্ধা করতো। একদিন সন্ধ্যায় একটা কাজে সে আমার সাথে আমার লজে এসে উপস্থিত হ’ল। স্বপন তখনও অফিস থেকে ফেরে নি। দরজা খুলে ঘরে ঢুকে আমার তো চক্ষুস্থির। লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার অবস্থা। সারা ঘর জুড়ে দেওয়ালে একটা মদের কোম্পানীর বিভিন্ন পোজের অর্ধ উলঙ্গ মেয়েদের ছবি লাগানো। তার মানে ব্রজেনদার স্ত্রী বা মা, অথবা দুজনেই এগুলো দেখেছেন।
ভাস্করকে বললাম “কিছু মনে কোর না। তুমি তো জানই আমার রুমমেট…..”
কথা শেষ করতে না দিয়ে সে বললো, “আপনাকে এত বলতে হবে না। আমি ওকে জানি। শুধু আমি না, এখানে প্রায় সকলেই ওকে জানে। আপনি আর কী করবেন”?
আর একদিন সান্ধ্য ভ্রমনে হঠাৎ শুভাশীষ শুরু করলো– “জানেন স্বপনদা, মেয়েরা গান ভীষণ ভালবাসে। বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত”।
“কী করে বুঝলি”?
কাল বাড়ি থেকে আসার সময় বাসে আমার পাশে একটা বেশ সুন্দর মেয়ে বসেছিল। আমি গুনগুন করে একটা রবীন্দ্র সংগীত গাইছিলাম। হাইরোডে বাসটা দাঁড়াতে, আমি চা খেতে নীচে নেমে যাই। ফিরে এলে মেয়েটা আমাকে হেসে বললো “আমি জানলার ধারটায় বসবো”? অন্য কেউ হলে রাজী হতাম না। কিন্তু মেয়েটাকে দেখতে এত সুন্দর, যে খুশী হয়েই বললাম বসুন। মেয়েটা যেন ইচ্ছে করেই আমার গা ঘেঁসে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ পর দেখি মেয়েটা আমার গাওয়া রবীন্দ্র সংগীতটা গুনগুন
করে ভাঁজছে। রাস্তায় অনেক কথাও বললো। ভাবছি গান শিখবো”।
বললাম “গান শিখতে যাস্ না। তোর যা গলা, তোর গলায় গান শুনলে কোন মেয়ে তোকে বিয়ে করবে না। করলেও পালিয়ে যাবে”।
“তুই চুপ করতো। তোর শুধু নেগেটিভ কথাবার্তা”। এবার সে শুভাশীষের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলো, “মেয়েটা কোথায় থাকে, কোথায় যাচ্ছিল জিজ্ঞাসা করেছিলি”?
শুভাশীষ আমার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে বললো, “না তো, ঠিকানাটা জিজ্ঞাসা করা হয় নি”।
“এই তো, এখানেই তো চালে ভুল করিস। আচ্ছা শুভাশীষ, হারমোনিয়ামের কী রকম দাম হবে বলতো”?
ব্যাপারটা ক্রমে এমন অবস্থায় দাঁড়ালো যে, ভয় হ’ল পরদিনই না ও একটা হারমোনিয়াম নিয়ে লজে ফেরে।
আর এক সন্ধ্যায়, অনেকদিন পরে তিনমূর্তি এক জায়গায় হয়েছি। হঠাৎ শুভাশীষ আরম্ভ করলো– “বুঝলেন স্বপনদা, মেয়েরাই হচ্ছে এনার্জি। যে, জীবনে কোনদিন কোন মেয়ের সংস্পর্শে আসেনি, তার জীবনটাই বৃথা”।
“ঠিক বলেছিস্। আমার এই ব্যাঙ্কে চাকরী আর ডেবিট ক্রেডিট, একদম ভাল লাগছে না। ঘেন্না ধরে গেল। আমি এমন একটা কিছু করতে চাই, যাতে টাকাও প্রচুর আসবে, আর অনেক মেয়ের সান্নিধ্যে আসা যাবে”।
শুভাশীষ করুণ মুখে বললো– “সে সুযোগ কী আর আমাদের জীবনে আসবে”?
স্বপন বেশ উত্তেজিত হয়ে বললো, “তবু চেষ্টা করতে দোষ কী”?
এতক্ষণে আমি বললাম, “শুভাশীষ তো একটা খোদার খাসী, ওর দ্বারা কিছু হবে না। তবে স্বপন যথেষ্ট স্মার্ট, চালাক চতুর, দেখতেও সুন্দর ও এনার্জেটিক। ওর কিন্তু সে সুযোগ ও ক্ষমতা, দুই-ই যথেষ্ট আছে। তবে ও কী আর করতে পারবে”?
স্বপন আমার ওপর ভীষণ খুশী হয়ে বললো– “কী কাজ বল্, না পারার কী আছে? আমি তোর মতো নেগেটিভ অ্যাটিচুডের ছেলে নই। আমি পারিনা এমন কাজ এখনও জন্মায় নি”।
“নাঃ, তোর দ্বারা হবে বলে মনে হয় না”।
“তুই একবার বলেই দেখ না। তুই রাস্তাটা বাতলে দে না, তারপর আমার ক্যারিশমা দেখবি”।
“ঠিক আছে, পরে একদিন বলবো”।
“আরে, তোর এখন বলতে কিসের আপত্তি? বল্ না”।
শুভাশীষ বিরক্তি প্রকাশ করে বললো– “আপনার এই এক মহা রোগ, বলবেনই যখন, তখন এখন বলতে আপত্তিটা কোথায়? নাই যদি বলবেন, তো এত কথা বলার দরকারটাই বা কী ছিল”?
এইভাবে স্বপন যখন তার ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লো, তখন বললাম– “বলছি, কিন্তু তুই কী করতে পারবি? পারলে অনেক টাকা, অনেক মেয়ের সান্নিধ্য, দুই-ই যথেষ্ট আছে”।
“বেশ, তুই বলেই দ্যাখ না”।
“রেড লাইট এলাকায় যেমন মাসী থাকে, তুই সেরকম মেসো হয়ে যা”।
শুনে ও তো প্রায় আমাকে মারতে আসে।
কোর্ট চত্বরে অঞ্জনের ঝুপড়িতে রাতে খেতে যেতাম। একদিন রাতে খাবার জন্য টেবিলে বসেছি। টেবিলগুলো এত নোংরা ও আঁশটে গন্ধযুক্ত, যে রাতের বেলাও মাছি ভনভন্ করছে। হঠাৎ দেখি স্বপন এসে হাজির। অঞ্জন আমাকে রুটি তরকারী দিয়ে গেল। স্বপনের কথামতো আমার উল্টোদিকে বসা স্বপনকে, মাছ ভাত দিয়ে গেল। লক্ষ্য করলাম ওকে মাছের একটা বেশ বড় ল্যাজা দিয়েছে। ও মাছটা খুব যত্ন করে কাঁটা বেছে খেয়ে, ল্যাজার একবারে শেষ অংশ, যেখানে কোন মাছ থাকে না, শুধু শক্ত কালো কাঁটার মতো অংশ থাকে, সেটা টেবিলে ফেলে দিল। অত্যন্ত নোংরা টেবিল। স্বপন কিন্তু অত্যন্ত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। আমি বললাম “ল্যাজার ঐ অংশটা ফেলে
দিলি”? ও খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো “এটায় কিছু নেই”। আমি বললাম “ওখানে কিছু থাকেও না, তবু সাহেবরা ঐ অংশটার সুপ্ খায়। যেমন টেংরিতে কিছু না থাকলেও, অনেক দাম দিয়ে লোকে টেংরি কেনে। ঐ অংশটায় নাকি প্রচুর প্রোটিন থাকে”। একটু সময় নিয়ে বললাম, “তাছাড়া ওটা খেলে নাকি স্কিন খুব ভাল থাকে”।
সম্ভবত স্কিনের কথা শুনেই ও বললো– তাই? এবং সঙ্গে সঙ্গে নোংরা টেবিল থেকে ল্যাজার অংশটা তুলে নিয়ে, চিবতে শুরু করে দিল। আমি জানি এখানেও সেই একই কারণ কাজ করেছিল। হঠাৎ দেখলাম ও রোজ খেজুর কিনে নিয়ে এসে, লজে সকাল সন্ধ্যা খেজুর খাওয়া শুরু করলো। ওর কথায় জানতে পারলাম খেজুর নিয়মিত খেলে পুরুষত্ব বাড়ে। আমার কাছ থেকে গোপন সংবাদটা পেয়ে, শুভাশীষ একদিন ওকে জানালো যে গন্ডারের শিংটা আসলে শক্ত লোম দিয়ে তৈরী। ঐ লোম গুঁড়ো করে খেতে পারলে পুরুষের শক্তি বাড়ে। প্রৌঢ, বৃদ্ধ পুরুষরাও, যৌবন ফিরে পায়। ফলমূল, শিকড় বাকড়েরও সে শক্তি নেই। উদাহরন স্বরুপ সে জানালো শিলাযুতের থেকেও অনেক শক্তিশালী, তবে জোগাড় করা মুশকিল, এবং দামও অনেক। তাই শুনে স্বপন তো প্রায় তখনই গন্ডারের শিং জোগাড়ে, আসাম যাবার প্রস্তুতি নেয় আর কী।
এরপর আমি ঐ লজ্ ছেড়ে দিয়ে যাতায়াতের অসুবিধার জন্য আমার অফিসের কাছাকাছি চলে যাই। আমার আগে শুভাশীষও চলে গেছিল। মাঝে একবার দিন দশেকের জন্য আবার পুরানো শহরে থাকতে হয়েছিল। আমার কাছে খবর ছিল, স্বপন আর সেই ঘরকে আগের মতো রাখে নি। আমার আর তাই ঐ ঘরে গিয়ে স্বপনের সাথে থাকতে প্রবৃত্তি হ’ল না। ফলে ওর কাছে না গিয়ে, কাছেই অন্য আর এক সহকর্মীর ঘরে দশ দিন ছিলাম।
অনেক দিন, তা প্রায় তিন, সাড়ে তিন বছর এক ঘরে সুখে দুঃখে পাশাপাশি আমরা দু’জনে ছিলাম। ফলে এতদিন পরে তার দেখা পেয়ে ভালই লাগলো। ও কেমন আছে, কী করছে, ইত্যাদি কিছু কথা হ’ল বটে, তবে স্বপনকে আর জিজ্ঞাসা করা হ’ল না, যে ও কাকে বিয়ে করেছে, কত টাকা যৌতুক পেয়েছে, ক’টা কাচ্ছাবাচ্ছা নিয়ে ওর স্ত্রী ওর কাছে এসেছিল, ও এবং ওর স্ত্রী, যে যার পছন্দ ও ইচ্ছামতো যত্রতত্র অন্যের সাথে ঘোরাফেরা করে কী না। তবে ওকে দেখে মনে হ’ল, ও বেশ ভালই আছে।