গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৫

সুবীর কুমার রায়


স্বপন


দীর্ঘ তের বছর পর হঠাৎ গড়িয়াহাটের মোড়ে স্বপনের সাথে দেখানা, ঠিক বললাম নামধ্যে বার দুএক ওর সাথে দূর্গাপুর বা পানাগড়, কোথায় যেন, হাওড়া আসার পথে খুব অল্প সময়ের জন্য দেখা হয়েছিলভিড় ট্রেনে সে ভাবে কথা বলার সুযোগ ছিল নাতবু ওরই মধ্যে সামান্য দুচার কথায়, তার পুরানো স্বভাবের ছবিটাই ফুটে উঠলোমানুষের জীবনে শেষ পরণতি মৃত্যু, আর কথায় বলে স্বভাব যায় না লে….কাজেই মরলেও যে স্বভাবের পরিবর্তন হয় না, কর্মস্থল সামান্য এক জেলা থেকে অন্য জেলায় স্থানান্তরিত হলে স্বভাব পরিবর্তন হবেকোন হালায় কয়?

মেয়ের বিয়ের বাজার করতে গিয়ে, গড়িয়াহাটের মোড়ে হঠাৎ স্বপনের সাথে একবারে মুখোমুখি দেখাঅল্প কথায় জানতে পারলাম যে, সে চাকরী থেকে বছর পাঁচেক আগে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে, এখন টিউশন করেগড়িয়াহাটের এক বহুতল ফ্ল্যাটে সে এখন থাকেতার স্ত্রী চাকরী করেদুজনের আয়ে তাদের বেশ স্বচ্ছলতায় দিন কাটেফ্ল্যাটটা কিনেছে, না ভাড়া নিয়েছে, জিজ্ঞাসা করা নাতবে মনে , সে নিজের ফ্ল্যাটেই থাকে

চাকরীসুত্রে আমাকে মেদিনীপুর জেলার একটা প্রত্যন্ত গ্র্রামে বদলি হয়ে যেতে হয়েছিলপ্র্রায় কুড়ি কিলোমিটার দুরের একটা মহকুমা শহর থেকে, অফিস যাতায়াত করতাম একই সময় আরও অনেকের মতো, স্বপনও বদলি হয়ে মহকুমা্ শহরেই পোষ্টিং পায়আমরা জনা পাঁচেক ছেলে, শহরেই একটা তিনতলা বাড়ির ওপর তলায় আস্তানা গাড়লামবাড়িটার তিনতলায় খানকয়েক ঘরসবকটা ঘরই লজ্ হিসাবে ভাড়া দেওয়া হয়আমাদের এই পাঁচজনের মধ্যে স্বপন একজনকিছুদিন পরে যে যার নিজের নিজের পছন্দ সুবিধা মতো ব্যবস্থা করে নিলেও, স্বপন আর আমি একটা বেশ বড় ঘরে থাকতামআমাদের এই ঘরটা ছাড়া আর সব ঘরে লোক আসতো, একদিন দুদিন থেকে চলে যেতএকমাত্র এই ঘরটাতে, আমরা দুজনে মাসিক ভাড়ায় থাকতামঘরটার মুখোমুখি দুটো দরজাসিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে পাশাপাশি দুটো চৌকিউল্টো দিকে আর একটা দরজা, সেটা দিয়ে বেরলে খানিকটা খোলা ছাদ, যাকে ওপন টেরাস বলেঠিক পাশ দিয়ে বাস রাস্তাকলকাতা, হাওড়া থেকে আসা বাস, রাস্তায় যাতায়াত করে
বাড়িওয়ালা ব্রজেনদার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বেশ ভালআমাদের তিনি খুব সম্মান করতেনঘরের চৌকি, বিছানা, চাদর, বালিশ, মশারি, টেবিল, আয়না, সব ব্রজেনদারএমন কী প্রতি শনিবার আমরা বাড়ি চলে এলে, বালিশের ঢাকা, বিছানার চাদর, কেচে ভাঁজ করে আমাদের বিছানায় রেখে দেবার দায়িত্বও, ব্রজেনদার স্ত্রীর ছিলছাদের দরজা খুলে প্রতিদিন ভিজে গামছা বা টুকটাক কাচাকাচি করা জামা প্যান্ট তুলে যার যার বিছানার ওপর ভাঁজ করে রাখার দায়িত্বও বৌদির ছিলঘরের দরজার চাবি আমরা বৌদির কাছে রেখে অফিস যেতামসন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে দেখতাম, ঘরে ধুপ জ্বলছেধুপদানি ধুপ, দুই- ব্রজেনদারআমরা শুধু মাস গেলে একটা টাকা ধরে দিতামসেটাও  খুব ন্যায্য, হয়তো কম বলা- ঠিক হবে

আমি অফিস থেকে ফিরে, স্নান সেরে, বিছানায় শুয়ে বই পড়তামস্বপন পাশের চৌকিতে গালে হাতের ভড় দিয়ে শুয়ে, ব্যাঙ্কিং পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতমাঝে আমি অঞ্জনের ঝুপড়িতে খেতে যেতামস্বপন তার সময় মতো অঞ্জনের ঝুপড়িতে বা অন্য কোথাও খেতে যেত

আমি চিরকালই নিশাচরঅনেক রাত পর্যন্ত জেগে, শুয় শুয়ে বই পড়তামদশটা-সাড়ে দশটার মধ্যেই স্বপন ঢুলতে শুরু করতোমাঝে মাঝে গাল থেকে হাত সরে গিয়ে, চৌকি থেকে পরে যাবার উপক্রম আমি ওকে ডেকে শুয়ে পড়তে বলতাম কোন কথা না বলে, মশারি খাটিয়ে শুয়ে পড়তো কিন্তু বেশ ভোরে উঠতো, এবং আমাকে সময় মতো ডেকে দিত ডেকে না দিলে আমার অফিস কামাই হবার সম্ভাবনা ছিল যথেষ্ট

অবিবাহিত স্বপন কলকাতায় কোন গভর্নমেন্ট কোয়ার্টার্সে থাকতোসম্ভবত তার বাবা চাকরী সুত্রে কোয়ার্টার্সটি পেয়েছিলেন, এবং স্বপনের কথায় মনে , কোয়ার্টার্সে যারা একবার ঢোকে, তারা কেউই আর সে কোয়ার্টার্স ছেড়ে যায় নাঠিক মতো  ভাড়া দিলে, ছাড়তেও  হয় না

উচ্চতায় সামান্য খাটো হলেও, স্বপন ছিল অত্যন্ত স্মার্ট, বেশ ফরসাডীপ্ কালারের গেঞ্জি পরলে তাকে বেশ সুপুরুষ বলা  যেতেই পারতোসে খুব স্বাস্থ্য সচেতনও ছিলরোজ না হলেও, প্রায় প্রতিদিনই সে একটা সুন্দর লাফদড়ি নিয়ে স্কিপিং  করতোখাওয়া দাওয়াও ছিল যথেষ্ট পরিমিতকিন্তু তার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গোটা রুটিনটাই, এমন কী তার দৈনন্দিন কাজকর্ম, কথাবার্তা, সব কিছুই ছিল, নারীপছন্দ দিয়ে নিখুত ভাবে বোনানারীরা কী পছন্দ করে, সেটা সে নিজেই নিজের ধারণা দিয়ে ঠিক করে নিত, এবং একই কারণে সে খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ফিটফাট্ থাকতে ভালবাসতো

সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে লজে ফিরে প্রায়ই দেখতাম, সে অফিস থেকে বাসায় ফেরে নিযদিও তার অফিস ছিল লজ্ থেকে মাত্র পাঁচ-সাত মিনিটের হাঁটাপথ, আর আমার অফিস ছিল প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দুরেকোথায় যেত জানি নারাস্তায় কোন কোন সময় তাকে অন্য ছেলেদের সাথে গল্প করতে দেখতামতাদের হাবভাব, চেহারা, স্বপনের সাথে খাপ খেত নাআর স্বপনের সাথে তাদের আলোচনার একমাত্র বিষয়বস্তু ছিল– “স্বপনদা, আজ একটা যা দারুণ দেখতে মেয়েকে দেখলাম না, একবারে চাবুক”  গোছের কিন্তু সবার সামনে স্বচ্ছন্দে এসব আলোচনা করতোকোন কোন দিন লজে ফিরে দেখতাম দুচারজনকে নিয়ে স্বপন আমাদের ঘরে আসর জমিয়ে বসেছেওর অফিসের ম্যানেজারকেও মাঝে মাঝে এই আসরে অংশ গ্রহণ করতে দেখতামকোন না কোন স্পনসর ম্যানেজ করে আমাদের ঘরে খানা পিনার আসর বসাতোযেহেতু এলাকাটা ট্রান্সপোর্ট ব্যবসার জন্য বিখ্যাত, তাই স্পনসর করার লোকেরও অভাব ছিল নাতবে এই আসরেও আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল নারী, এবং মুখ্য বক্তা ছিলঅবশ্যই স্বপনতবে এইসব আসরে তাকে কিন্তু কোনদিন বেহেড হতে  দেখি নিবিনামূল্যে, অথচ পরিমিত পানাহার এর পিছনে হয়তো স্বাস্থ্য সচেতনতা, এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার পিছনে হয়তো মেয়েদের পছন্দ কাজ করতো

অদ্ভুত চালচলন ছিল তার, যার সাথে কারো মিল খুঁজে পেতাম নাপ্রসাধনের জন্য নানা রকম ক্রী্, নানা আকারে্ আকৃতির চিরুণী, শ্যাম্পু, সাবান, মাথায় মাখার তেল ইত্যাদি, তার ভান্ডারে সব সময় মজুদ থাকতোএমন কী যে কোন সময়ে প্রয়োজন হতে পারে ভেবে চৌকির ঠিক পাশে, টেবিলে সব কিছু হাতের কাছে সাজানো থাকতোচিরুণী যে কত প্রকারের হতে পারে, তার সংস্পর্শে এসে জেনেছিলামসরু দাঁতের, মোটা দাঁতের, খুব সরু দাঁতের গোঁফ ছাঁটার, গোল এবং তার চার পাশে দাঁত, খুব মোটা মোটা ফাঁক ফাঁক দাঁতের ইত্যাদি, ইত্যাদিআমরা সাধারণত ভোরে ঘুম ভাঙ্গার পরে, আলস্য ভাঙ্গার জন্য আড়মোড়া ভেঙ্গে একটু শুয়ে থেকে, মশারি থেকে বেড়োইস্বপন কিন্তু ভোরে চোখ মেলেই এক টানে মশারি ফাঁক করে চৌকি থেকে নীচে নেমে, নানা আকারের চিরুণী দিয়ে, নানা ভাবে চুল আঁচড়ে নিতঅত সকালে ঘরের মধ্যে কেন যে ঘুম থেকে উঠেই তার চুল আঁচড়াবার প্রয়োজন , সেই বলতে পারবে

বিবাহিত জীবন সম্বন্ধে তার বক্তব্যও ছিল পরিস্কার বাঁধিয়ে রাখার মতোকোন রকম রাখঢাক্ না রেখে সে বলতো যে, সে এমন মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, যে হয় চাকরী করবে, না হয় অনেক টাকা যৌতুক দেবেবাচ্ছা সমেত কোন মেয়েকে বিয়ে করতেও তার আপত্তি নেই, তবে সে ক্ষেত্রে কিছু অ্যাডিশনাল শর্ত আছেচাকরী অথবা অনেক টাকা যৌতুক ছাড়া বাচ্ছার খরচ স্ত্রীকেই যোগাতে হবে, এবং তার জীবনের গতিবিধিতে কোন রকম বাধা দেওয়া চলবে নাকনট্র্যাকট্ অ্যাকট্ আইন বলে, কনসিডারেশন ছাডা কোন চুক্তি আইনসিদ্ধ নয়স্বপনও বোধহয় সেটা জানতো, বুঝতো এবং মানতোতাই কনডিশনাল বিবাহের কনসিডারেশন হিসাবে তার বক্তব্য ছিল, তার ভাবী স্ত্রী- তার নিজের পছন্দ মতো যার সাথে খুশী, যেখানে খুশী ঘুরে বেড়াতে পারবে, তাতে স্বপনের কোন আপত্তি থাকবে না, এবং ব্যাপারে সে কোন প্রশ্নও করবে না, বা বাধাও দেবে না

যাহোক্, হেন স্বপনের দিন শুধুমাত্র মেয়েদের নিয়ে আলোচনা কল্পনায় সীমাব্দ্ধ থেকে ভালই কাটছিলসকালে ঘুম থেকে উঠে নানা আকারের চিরুণী দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে যত্ন করে চুল আঁচড়ে, দাঁত মেজে, হাত মুখ ধুয়ে চা খেতে যাওয়াতারপর আমি অফিসে বেড়িয়ে যাবার পর, কোন এক সময় টুকটাক কাচাকাচি করে, স্নান সেরে, কোন হোটেল বা ঝুপড়িতে খেয়ে নিয়ে, অফিস যাওয়াঅফিস থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে, মুখে ক্রীম দিয়ে নীচ থেকে ওপর দিকে ম্যাসাজ্ করে সেই ক্রীম মাখা ভাবে ক্রীম না মাখলে, অর্থাৎ মুখের ওপর থেকে নীচের দিকে হাত দিয়ে ঘষলে মুখের চামড়া ঝুলে যাবে, যেটা কোন মেয়েই পছন্দ করবে নাতারপর বই নিয়ে পড়তে বসা, কারণ ব্যাঙ্কিং পরীক্ষায় পাশ করতেই হবে

তবে মাঝে মাঝে মন মেজাজ ভাল করতে শহর ছেড়ে আট-দশ কিলোমিটার দুরে একটা ছোট সিনেমা হলে, নাইট শোতে মালয়ালাম সিনেমা দেখতে যাওয়াযদিও ছবির নাম হিন্দীতেই লেখা থাকতো, এবং ছবির নাম দেখে নদের নিমাইগোছের কোন নিরীহ ছবি বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিকসিনেমা দেখে অত রাতে লজে ফেরার অসুবিধার জন্য ভ্যান রিক্সাওয়ালাকে টিকিট কেটে তার সাথে সিনেমা দেখানোর বুদ্ধিটাও তা্, এবং অনেক রাতে সিনেমা দেখে কী ভাবে ফিরেছে, সেটা বেশ গর্ব করে আমাকে গল্পও করতোবেশী টাকা ভাড়া এবং বিনা পয়সায় অত ভাল সিনেমা দেখার লোভ কোন ভ্যান রিক্সাওয়ালা ছাড়তে চায়? স্বপনের মতো সেও তো রক্ত মাংসের মানুষ

অন্যান্য দিন রাতে বাইরে থেকে খেয়ে এসে আবার বই নিয়ে বসা, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ লাল করে ঢুলতে থাকাআমি তাকে ডেকে দিয়ে শুয়ে পড়তে বললে্, মশারি খাটিয়ে শুয়ে পড়া কিন্তু এর মাঝে স্বপনের জীবনে একটা বড় পরিবর্তন এলআর তার জন্য দায়ী তার এক বন্ধু, যে চাকরী সূত্রে না পড়াশোনার জন্য, আমেরিকায় থাকতোস্বপনের কাছে শুনতাম সেই বন্ধু নাকি তার নামে সেখান থেকে ডলার পাঠায়নিজের বাড়ি, নিজের আত্মীয় স্বজন ছেড়ে, সে যে কেন স্বপনের নামে ডলার বা টাকা পাঠাতো, বলতে পারবো না

এই বন্ধু নাকি স্বপনকে জানিয়েছে যে, আমেরিকায় মেয়েরা কলেজে প্রায় বিকিনি পরে আসেএরকম একটা উত্তেজক সুখবর শোনার পরে আর শুয়ে বসে থাকা চলে নাকথায় বলে, যে শুয়ে থাকে তার ভাগ্যও শুয়ে থাকেতাই সে আর এক মুহুর্তও সময় নষ্ট না করে, ব্যাঙ্কিং এর সমস্ত বইপত্র ওপরের তাকে তুলে রেখে, উচ্চ শিক্ষার্থে আমেরিকা যাবার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দিলবিদেশে পড়তে গেলে যে পরীক্ষায় বসতে হয়, তার জন্য বইপত্র কিনে জোর কদমে পড়াশোনা শুরু করে দিলতখন যদি চৈত্র সেলের মতো স্বপনকে কেউ অফার দিত যে, আমেরিকা ছাড়া পৃথিবীর যে কোন দেশের, যে কোন ইউনিভার্সিটিতে, একই কোর্স পড়তে যেতে পারে, এবং তার জন্য তাকে কোন টেষ্ট্ দিতে হবে না, স্বপন রাজী নাআমেরিকা যাবার জন্য সে জীবন বাজি রাখতেও রাজী আছেব্যাঙ্কিং এর পরিবর্তে বিদেশ যাবার জন্য পড়াশোনা, এটুকু অমিল বাদ দিলে, আর সব রুটিন ঠিক আগের মতোই থাকলো

মাঝে একবার স্বপন মানিক হঠাৎ ব্রজেনদার লজ্ ছেড়ে কিছুটা দুরে এক মুসলিম ডাক্তারের বাড়ি ভাড়া নেবার ব্যবস্থা করলোমানিক প্রথম দিকে আমাদের সাথে এই লজেই থাকতো ডাক্তার বিদেশে গেছেন এবং দোতলা বাড়ির একতলাটা ভাড়া দেওয়া হবেআমার সেখানে যাবার কোন ইচ্ছা ছিল নাবাড়িটার ভাড়া অনেক বেশী, অফিস যাবার জন্য আমাকে বাস ধরতে অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হবেতাছাড়া তিনতলার ওপর ব্রজেনদার লজ্ অনেক নিরিবিলি আলো  হাওয়া যুক্তসেখানে ভাড়া অনেক কম, অথচ স্বাধীনতা সুযোগ সুবিধা অনেক বেশীব্রজেনদার স্ত্রী মা আমাদের বেশ ভালবাসতেনএকপ্রকার লোকাল  গার্জেন সুলভ ছিলেনআমাদের দ্বারা রান্না করে খাওয়া বাস্তবে সম্ভব হবে না, তাই শুধু শুধু অত বড় বাড়ি ভাড়া নেওয়ার কোন কারণই, আমার কাছে যুক্তিযুক্ত বলে মনে না

তবু ওদের সাথে ওদের অনুরোধে, নতুন বাড়ি দেখতে যেতেই একতলায় চারটে বড় বড় ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম পায়খানাএকতলাটা ডাক্তার এখানে থাকার সময় নার্সিং হোম ছিলএকতলার ভিতর দিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, সিঁড়ির মুখে কোলাপসিবল্ গেট্আবার একতলায় না ঢুকেও, পাশের প্যাসেজ দিয়ে দরজা খুলে একই সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠা যায়যাহোক্, একতলায় তিনটে ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম পায়খানা নিয়ে আমাদের নতুন সংসার শুরু একটা ঘর বন্ধ করে দেওয়া প্রথম দিনই রান্না করা, বাজার করা নিয়ে ঝামেলা আমি অনেক সকালে অফিস বেড়িয়ে যেতাম, ফেরারও আমার কোন ঠিক ছিল নাকোনদিন সন্ধ্যাবেলা, আবার কোনদিন বেশ রাত হয়ে যেতআমি বললাম আমার পক্ষে বাজার করা বা রান্না করা, কোনটাই সম্ভব হবে নাতাছাড়া সকালে আমি যখন অফিস যাই, সেই সময়ের মধ্যে সকালের রান্নাও কোনদিন শেষ করা সম্ভব হবে না

ওদের দুজনের পক্ষে অতবড় বাড়িটা নেওয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে যাবে বলে, ওরা আমাকে ছেড়ে দিতেও পারছে নাশেষে ওরা বাধ্য হয়ে বাজার করা রান্না করার দায়িত্ব নিজেরা নিলদিন দশ পনের কাটার পর, একদিন সকালে স্বপন সংবাদ দিল যে, গতকাল রাতে একটা আওয়াজ পেয়ে ওঠে, এবং একজন মহিলাকে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুতবেগে ওপরে উঠে যেতে দেখেআমি বললাম সিঁড়িতো একটাইবাইরের দরজা দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে তো ওঠাই যায়তাছাড়া সিঁড়ির মুখে কোলাপসিবল্ গেটে তো ওদের আমাদের দুদুটো তালা লাগানো, আমাদের এদিকে কেউ আসবেই বা কেন এবং কী ভাবেই বা আসবে? স্বপন জানালো, ডাক্তারের স্ত্রী বোধহয় কোন কারণে নেমে এসেছিলওর পায়ের আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি ওপরে ফিরে যায়বেলা যত বাড়তে লাগলো, স্বপনের বর্ণনায় ডাক্তারের স্ত্রীর সৌন্দর্যও তত বাড়তে থাকলোঅথচ নিজেই বলছে আগন্তুককে সে ভালভাবে দেখতেই পায় নি

এরপর ওর ধারণা ডাক্তারের স্ত্রী রাতে আবার আসবে, এবং আমরা না থাকলে সেটার সম্ভাবনা অনেক বেশীকয়েক রাত আধো জাগরণেও যখন্ কাউকে আসতে দেখা গেল না, তখন আশায় আশায় পরপর দুটো শনিবার কলকাতার বাড়িতে না ফিরে, ওখানে একা থেকে গেলবেচারা স্বপন, সত্যি কাউকে দেখেছিল বলে আমার মনে হয় নাযদি দেখেও থাকে, সে শুধু স্বপনের কল্পনার ছিপে ফাৎনা নাড়িয়ে চলে গেছেটোপ খেতে কোন শনিবারই সিঁড়ি ভেঙ্গে আসে নিশেষে আর কিছুদিন পরে ব্রজেনদার অনুরোধে, আমরা আবার ব্রজেনদার লজের সেই পুরানো ঘরে ফিরে গেলামস্বপন বোধহয় এই বাড়িটা নেহাত অপয়া বলেই, ফিরে যেতে আপত্তি করলো নামানিক অন্য জায়গায় আলাদা ঘর ভাড়া নিল

কলেজ বা চাকরী জীবনে দেখেছি, যাকে নিয়ে আর সকলে মজা করে, যে আর সকলের কাছে আনন্দের, মজার রসদ হয়ে দাঁড়ায়, তাকে মুরগী বলেআমি আমার জীবনে এরকম  অনেক, অনেক মুরগীকে দেখে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি  যে, শতকরা দশজনকে আর সকলে মুরগীতে রুপান্তরিত করেবাকী নব্বই শতাংশ, মুরগী হয়েই ধরাধামে প্রবেশ করেযেন মুরগী হবার জন্যই তারা বলিপ্রদত্তস্বপন অবশ্যই দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত লেগহর্ন মোরগফলে তাকে নিয়ে কষ্টের দিনেও আনন্দে সময় কাটাতে, আমাদের বিশেষ কোন বেগ্ পেতে হয় নি

কোনদিন সন্ধ্যার পর অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরলে, আমি আমার অফিসের সহকর্মী, শুভাশীষ বাসায় না ফিরে বাজারে গিয়ে, বাজার দর করে, চা খেয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে, যে যার বাসায় ফিরতাম আমার লজের কাছেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে একা থাকতোমাছের দর, আলুর দর, সবজীর দর, চালের দর ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করে, যদিও জানতাম আমাদের বিনা পয়সায় সব সামগ্রী দিলেও নেবার উপায় ছিল না, তবু একা একা ঘরে বসে না থেকে, এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ  সময় কাটাতামএই সান্ধ্য ভ্রমনে মাঝে মধ্যে স্বপনকে পাওয়া যেতসেদিন আর সময় কাটাবার জন্য বাজার দর করতে নাস্বপনই আমাদের বাজার দরের বিকল্প রসদ হয়ে যেতস্বপনের নারী সংক্রান্ত আলোচনায় আমার নঞর্থক মতামত প্রায়ই তার উৎসাহে বিঘ্ন ঘটাতোফলে সে আমাকে প্রায়ই বলতো– “তোর কোন বাইয়লজিক্যাল নীডই নেই

একদিন সন্ধ্যার সময় আমি, স্বপন শুভাশীষ, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিহঠাৎ স্বপন বললো, “ মেয়েটাকে দ্যাখরাস্তার পাশে একটা বাড়িরাস্তার ঠিক পাশে লম্বা গ্রীল দেওয়া বারান্দাবারান্দার  পরে পর পর ঘর, ঘরেরও পরে বোধহয় বাইরের বারান্দার সমান্তরাল প্যাসেজসেই প্যাসেজের  দিকে স্বপনের নির্দ্দেশ মতো চোখ যেতে মনে , লাল রঙের কিছু একটা চলে গেলসে মহিলা না পুরুষ, সালোয়ার কামিজ না শাড়ি না জামাপ্যান্ট পরিহিত তাও বোঝার আগেই, সে অদৃশ্য হয়ে গেলস্বপন পুলকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো- শুভাশীষ, মেয়েটাকে কেমন দেখলি”? শুভাশীষ বললো ওঃ. স্বপনদা, চমৎকারএত সুন্দরী একটা মেয়ে এখানে থাকে, আগে কোনদিন দেখিনি তো”? স্বপন বেশ গর্ব ভরে জানালো ওর সাথেই আমার বিয়ের কথা হচ্ছেমনে পড়লো কিছুদিন শুনছিলাম স্বপনের অফিসের ম্যানেজার, স্বপনের জন্য পাত্রী দেখছেবোধহয় স্বপনের অনুরোধেই

শুভাশীষ গদগদ হয়ে  বললো আপনার পছন্দ আছে স্বপনদা, অসাধারণআপনার  সঙ্গে খুব ম্যাচ করবেঅভিজ্ঞতায় শিখেছি মুরগী করার প্রথম প্রধান নিয়ম , সকলে মিলে পক্ষে বা বিপক্ষে বললে  খেলা তেমন জমে নাপক্ষে বিপক্ষে, উভয় পক্ষেই, কথা বলার মতো লোক থাকতে হবেস্বাভাবিক ভাবে শুভাশীষ স্বপনের পক্ষ নিয়ে মেয়েটার সৌন্দর্যের তারিফ  করতে লাগলোযদিও আমার মতো  সেও কাউকে স্পষ্ট দেখতে পায় নি, দেখার কোন সুযোগও ছিল না
রকম মেয়ে আমারও খুব পছন্দঠোঁটদুটো একটু ভিজেভিজে থাকবেস্বপন উল্লাসিত হয়ে বললো– “বল্ শুভাশীষ বল, আমিও ঠিক তাই পছন্দ করিআমার দিক থেকে কোন মন্তব্য না আসায়, শুভাশীষ আবার শুরু করলো– “হালকা মেক্ আপ নেবে, ছোট্ট টিপ পরবেস্থান কাল পাত্র ভুলে, স্বপন প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো– “তোর পছন্দ ঠিক আমার মতোশুভাশীষ একটু সময় নিয়ে আবার বললো- চিবুকে একটা তিল থাকবে, আর…..”কথার মাঝে আমি বললাম, “চোখের কোনে পিঁচুটি থাকবেব্যাস, স্বপন ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার করে বললো– “অ্যাই, তুই চুপ করতো, তুই আমার জীবনের শনিতোর জন্য আমার কিছু হবে নাতুই কী বুঝবি, তোর তো কোন বাইয়লজিক্যাল নীডই  নেই

উত্তেজনা কমাতে শুভাশীষ নতুন করে শুরু করলো– “স্বপনদা, ওর কোন বোন নেই”? স্বপন বললো নিশ্চই, ওর একটা বোন আছেওর বাবার স্বভাব চরিত্র ভাল নয়সে অন্য কারো সাথে আলাদা থাকেমাঝেমাঝে আসেআমি ভাবছি ওর মা আর বোনকে নিয়ে গিয়ে, কলকাতায় আমার নতুন কেনা ফ্ল্যাটে রাখবোবুঝলি না, বাবার টাকা, বাড়ি সবই তো আমার হবে, সঙ্গে বোনটাকেও ফাউ হিসাবে পাওয়া যাবেমাটাকে তো দেখিস নি, দেখলে মাথা ঘুরে যাবেভারী সুন্দরশুভাশীষ বললো স্বপনদা, বোনটার সাথে আমার সম্বন্ধ করুন নাআমার কোন সম্পত্তি চাই নাআপনি চেষ্টা করলে নিশ্চই রাজী হবে

তুই রাজী আছিস? একবার বল্, ব্যবস্থা করে দেবকিন্তু মুশকিল আমি এখনও মনস্থির করে উঠতে পারি নি, কোন বোনটাকে বিয়ে করা যায়মানে দুজনকে তো আর অফিসিয়ালি বিয়ে করা যায় নাতবে তুই যদি রাজী থাকিস, তাহলে বড়টাকে আমি বিয়ে করে, বোনটার সাথে তোর সম্বন্ধ পাকা করে দিতে পারি যেন গুপি গায়েন বাঘা বায়েন এর কন্যা কম পড়িয়াছে?” এর মতো কেস্স্বপন এমন ভাবে কথাগুলো বলছিল, যেন গোটা ফ্যামিলিটাই ওর সম্পত্তি

সারা রাস্তাটা আমাকে কোন কথা বলার সুযোগ দিল নাকলকাতায়   যেখানে থাকে, তার প্রায় আশেপাশেই একটা এক কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাট কিনেছেসে ফ্ল্যাট আমাকে দেখাতেও নিয়ে গেছেভীষণ ছোট, দরজা খুলেই খাটে উঠে পড়তে হবেওকে বলেছিলাম, ফ্ল্যাট যদি কিনলিই, তো এত ছোট ফ্ল্যাট কিনতে গেলি কেন? উত্তরে বলেছিল এখানে তো আর থাকবো নাধর্ কোন বান্ধবী টান্ধবী দুদিনের জন্য এল, তাকে তো আর নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখা যায় নাতখন দুএকদিন এখানে থাকলামঅর্থাৎ ফ্ল্যাট কেনার পেছনেও সেই একই গল্প, এবং এতদিনে, সম্ভব  হলে সে গল্পের বাস্তব রুপ দিতে চায়

রাতে স্বপন আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “তোর কোন বোনটাকে পছন্দ রে”?
একটার সম্ভবত লাল রঙের পোষাক  দেখেছি, আর একটাকে চোখেই দেখি নি, স্বপনের মাধ্যমে শুধু বাঁশী শুনেছিআমি কবি নই, তাই মন প্রাণ যাহা ছিল দিয়ে ফেলা তো দুরের কথা, পছন্দ করাও সম্ভব নয়, অবস্থায় কী বলবো আমি বললাম–“তুই তো বলিস আমার  কোন বাইয়লজিক্যাল নীড নেইকাজেই আমার পছন্দ জেনে তোর কী লাভ? আমার পছন্দ কী আর তোর পছন্দ হবে”?
তবু বল না শুনিতোর কোন  বোনটাকে পছন্দ”?
পছন্দ বলতে কী বোঝাতে চাইছিস”?
মানে তোর কোন মেয়েটাকে বেশী ভাল বলে মনে হয়? মানে তুই হলে কাকে বিয়ে করতিস”?
সে কী আর এক কথায় বলা যায়? ছোট বোনটাকে তো চোখেই দেখি নিতাছাড়া ওরা দুজনেই যেরকম সুন্দরী বলছিস, আমার মতো বাইয়লজিক্যাল নীডলেস্ একটা দোজবরে আধবুড়োকে তারা বিয়ে করতে রাজী হবে কেন? আবার ধর শুভাশীষ যদি সত্যিই ছোট বোনটাকে বিয়ে করে, তাহলে আর আমার পছন্দ করার বা বিয়ে করার সুযোগ কোথায়? দুটি বই মেয়ে তো ভদ্রমহিলার নেই
আহা, তবু তুই বলই নাতোর মতামতটা জানতে চাই
এইভাবে যখন সে ব্যাকুল হয়ে আমার মতামতের অপেক্ষায় আকুল, যখন আমার একটা মুখের কথায় তার, দুই বোনের এক বোনের, ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে, যখন্ বুঝতে পারছে এত রাতে আর দ্বিতীয় কারোর মতামত পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, তখন বললাম, “আমার মতামতের কী আর কোন মূল্য আছে? তবে আমি লে মাটাকেই বিয়ে করতাম
স্বপন বিরক্ত হয়ে আলোচনা বন্ধ করে দিলপরদিন থেকে আবার আগের জীবন, আগের রুটিন

ভাস্কর নামে একটা ছেলে ইনসুরেন্সের কাজে আমার অফিসে আসতো, স্বপনের অফিসেও তার যাতায়াত ছিলঅত্যন্ত ভদ্র ছেলেটা আমাকে দাদা দাদা বলে ডাকতো, ভীষণ শ্রদ্ধা করতোএকদিন সন্ধ্যায় একটা কাজে সে আমার সাথে আমার লজে এসে উপস্থিত স্বপন তখনও অফিস থেকে ফেরে নিদরজা খুলে ঘরে ঢুকে আমার তো চক্ষুস্থিরলজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার অবস্থাসারা ঘর জুড়ে দেওয়ালে একটা মদের কোম্পানীর বিভিন্ন পোজের অর্ধ উলঙ্গ মেয়েদের ছবি লাগানোতার মানে ব্রজেনদার স্ত্রী বা মা, অথবা দুজনেই এগুলো দেখেছেন
ভাস্করকে বললাম কিছু মনে কোর নাতুমি তো জানই আমার রুমমেট…..”
কথা শেষ করতে না দিয়ে সে বললো, “আপনাকে এত বলতে হবে নাআমি ওকে জানিশুধু আমি না, এখানে প্রায় সকলেই ওকে জানেআপনি আর কী করবেন”?
আর একদিন সান্ধ্য ভ্রমনে হঠাৎ শুভাশীষ শুরু করলো– “জানেন স্বপনদা, মেয়েরা গান ভীষণ ভালবাসেবিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত
কী করে বুঝলি”?

কাল বাড়ি থেকে আসার সময় বাসে আমার পাশে একটা বেশ সুন্দর মেয়ে বসেছিলআমি গুনগুন করে একটা রবীন্দ্র সংগীত গাইছিলামহাইরোডে বাসটা দাঁড়াতে, আমি চা খেতে নীচে নেমে যাইফিরে এলে মেয়েটা আমাকে হেসে বললো আমি জানলার ধারটায় বসবো”? অন্য কেউ হলে রাজী হতাম নাকিন্তু মেয়েটাকে দেখতে এত সুন্দর, যে খুশী হয়েই বললাম বসুনমেয়েটা যেন ইচ্ছে করেই আমার গা ঘেঁসে বসে পড়লোকিছুক্ষণ পর দেখি মেয়েটা আমার গাওয়া রবীন্দ্র সংগীতটা গুনগুন করে ভাঁজছেরাস্তায় অনেক কথাও বললোভাবছি গান শিখবো
বললাম গান শিখতে যাস্ নাতোর যা গলা, তোর গলায় গান শুনলে কোন মেয়ে তোকে বিয়ে করবে নাকরলেও পালিয়ে যাবে
তুই চুপ করতোতোর শুধু নেগেটিভ কথাবার্তাএবার সে শুভাশীষের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলো, “মেয়েটা কোথায় থাকে, কোথায় যাচ্ছিল জিজ্ঞাসা করেছিলি”?
শুভাশীষ আমার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে বললো, “না তো, ঠিকানাটা জিজ্ঞাসা করা হয় নি
এই তো, এখানেই তো চালে ভুল করিসআচ্ছা শুভাশীষ, হারমোনিয়ামের কী রকম দাম হবে বলতো”?
ব্যাপারটা ক্রমে এমন অবস্থায় দাঁড়ালো যে, ভয় পরদিনই না একটা হারমোনিয়াম নিয়ে লজে ফেরে
আর এক সন্ধ্যায়, অনেকদিন পরে তিনমূর্তি এক জায়গায় হয়েছিহঠাৎ শুভাশীষ আরম্ভ করলো– “বুঝলেন স্বপনদা, মেয়েরাই হচ্ছে এনার্জিযে, জীবনে কোনদিন কোন মেয়ের সংস্পর্শে আসেনি, তার জীবনটাই বৃথা
ঠিক বলেছিস্আমার এই ব্যাঙ্কে চাকরী আর ডেবিট ক্রেডিট, একদম ভাল লাগছে নাঘেন্না ধরে গেলআমি এমন একটা কিছু করতে চাই, যাতে টাকাও প্রচুর আসবে, আর অনেক মেয়ের সান্নিধ্যে আসা যাবে
শুভাশীষ করুণ মুখে বললো– “সে সুযোগ কী আর আমাদের জীবনে আসবে”?
স্বপন বেশ উত্তেজিত হয়ে বললো, “তবু চেষ্টা করতে দোষ কী”?
এতক্ষণে আমি বললাম,  “শুভাশীষ তো একটা খোদার খাসী, ওর দ্বারা কিছু হবে নাতবে স্বপন যথেষ্ট স্মার্ট, চালাক চতুর, দেখতেও সুন্দর এনার্জেটিকওর কিন্তু সে সুযোগ ক্ষমতা, দুই- যথেষ্ট আছেতবে কী আর করতে পারবে”?
স্বপন আমার ওপর ভীষণ খুশী হয়ে বললো– “কী কাজ বল্, না পারার কী আছে? আমি তোর মতো নেগেটিভ অ্যাটিচুডের ছেলে নইআমি পারিনা এমন কাজ এখনও জন্মায় নি
নাঃ, তোর দ্বারা হবে বলে মনে হয় না
তুই একবার বলেই দেখ নাতুই রাস্তাটা বাতলে দে না, তারপর আমার ক্যারিশমা দেখবি
ঠিক আছে, পরে একদিন বলবো
আরে, তোর এখন বলতে কিসের আপত্তি? বল্ না
শুভাশীষ বিরক্তি প্রকাশ করে বললো– “আপনার এই এক মহা রোগ, বলবেনই যখন, তখন এখন বলতে আপত্তিটা কোথায়? নাই যদি বলবেন, তো এত কথা বলার দরকারটাই বা কী ছিল”?
এইভাবে স্বপন যখন তার ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লো, তখন বললাম– “বলছি, কিন্তু তুই কী করতে পারবি? পারলে অনেক টাকা, অনেক মেয়ের সান্নিধ্য, দুই- যথেষ্ট আছে
বেশ, তুই বলেই দ্যাখ না
রেড লাইট এলাকায় যেমন মাসী থাকে, তুই সেরকম মেসো হয়ে যা
শুনে তো প্রায় আমাকে মারতে আসে

কোর্ট চত্বরে অঞ্জনের ঝুপড়িতে রাতে খেতে যেতামএকদিন রাতে খাবার জন্য টেবিলে বসেছিটেবিলগুলো এত নোংরা আঁশটে গন্ধযুক্ত, যে রাতের বেলাও মাছি ভনভন্ করছেহঠাৎ দেখি স্বপন এসে হাজিরঅঞ্জন আমাকে রুটি তরকারী দিয়ে গেলস্বপনের কথামতো আমার উল্টোদিকে বসা স্বপনকে, মাছ ভাত দিয়ে গেললক্ষ্য  করলাম ওকে মাছের একটা বেশ বড় ল্যাজা দিয়েছে মাছটা খুব যত্ন করে কাঁটা বেছে খেয়ে, ল্যাজার একবারে শেষ অংশ, যেখানে কোন মাছ থাকে না, শুধু শক্ত কালো কাঁটার মতো অংশ থাকে, সেটা টেবিলে ফেলে দিলঅত্যন্ত  নোংরা  টেবিলস্বপন কিন্তু অত্যন্ত পরিস্কার পরিচ্ছন্নআমি  বললাম ল্যাজার অংশটা  ফেলে দিলি”? খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো এটায় কিছু নেইআমি বললাম ওখানে কিছু থাকেও না, তবু সাহেবরা অংশটার সুপ্ খায়যেমন টেংরিতে কিছু না থাকলেও, অনেক দাম দিয়ে লোকে টেংরি কেনে অংশটায় নাকি প্রচুর প্রোটিন থাকেএকটু সময় নিয়ে বললাম, “তাছাড়া ওটা খেলে নাকি স্কিন খুব ভাল থাকে
সম্ভবত স্কিনের কথা শুনেই বললোতাই? এবং সঙ্গে সঙ্গে নোংরা টেবিল থেকে ল্যাজার অংশটা তুলে নিয়ে, চিবতে শুরু করে দিলআমি জানি এখানেও সেই একই কারণ কাজ করেছিল হঠাৎ দেখলাম রোজ খেজুর কিনে নিয়ে এসে, লজে সকাল সন্ধ্যা খেজুর খাওয়া শুরু করলো ওর কথায় জানতে পারলাম খেজুর নিয়মিত খেলে পুরুষত্ব বাড়েআমার কাছ থেকে গোপন সংবাদটা পেয়ে, শুভাশীষ একদিন ওকে জানালো যে গন্ডারের শিংটা আসলে শক্ত লোম দিয়ে তৈরী লোম গুঁড়ো করে খেতে পারলে পুরুষের শক্তি বাড়েপ্রৌঢ, বৃদ্ধ পুরুষরাও, যৌবন ফিরে পায়ফলমূল, শিকড় বাকড়েরও সে শক্তি নেইউদাহরন স্বরুপ সে জানালো  শিলাযুতের থেকেও অনেক শক্তিশালী, তবে জোগাড় করা মুশকিল, এবং দামও অনেকতাই শুনে স্বপন তো প্রায় তখনই গন্ডারের শিং জোগাড়ে, আসাম যাবার প্রস্তুতি নেয় আর কী

এরপর আমি লজ্ ছেড়ে দিয়ে যাতায়াতের অসুবিধার জন্য আমার অফিসের কাছাকাছি চলে যাইআমার আগে শুভাশীষও চলে গেছিলমাঝে একবার দিন দশেকের জন্য আবার পুরানো শহরে থাকতে হয়েছিলআমার কাছে খবর ছিল, স্বপন আর সেই ঘরকে আগের মতো রাখে নিআমার আর তাই ঘরে গিয়ে স্বপনের সাথে থাকতে প্রবৃত্তি নাফলে ওর কাছে না গিয়ে, কাছেই অন্য আর এক সহকর্মীর ঘরে দশ দিন ছিলাম

অনেক দিন, তা প্রায় তিন, সাড়ে তিন বছর এক ঘরে সুখে দুঃখে পাশাপাশি আমরা দুজনে ছিলামফলে এতদিন পরে তার দেখা পেয়ে ভালই লাগলো কেমন আছে, কী করছে, ইত্যাদি কিছু কথা বটে, তবে স্বপনকে আর জিজ্ঞাসা করা না, যে কাকে বিয়ে করেছে, কত টাকা যৌতুক পেয়েছে, টা কাচ্ছাবাচ্ছা নিয়ে ওর স্ত্রী ওর কাছে এসেছিল, এবং ওর স্ত্রী, যে যার পছন্দ ইচ্ছামতো যত্রতত্র অন্যের সাথে ঘোরাফেরা করে কী নাতবে ওকে দেখে মনে , বেশ ভালই আছে