গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৫

দুটি অনুগল্প - সাঈদা মিমি


পিকনিক

পিকনিকটা আমাদের হলেও রেঁধেছিলেন বিলকিস খালাম্মা, আমরা আসলে রাঁধতে শিখিনি তখন, তবে মাটির পাতিলে চালডাল মশলা মাখিয়ে খিচুরির মত একটা জিনিস পাকাতে পারি, বলছিলাম পিকনিকের কথা, আমরা বলতাম চড়াইভাতি আহা, তালাবের টাটকা কালবোশ মাছ, নানান সবজির চচ্চরি, মাসকলাই ডাল, দশমিশালী শাক আর ধোঁয়া ওঠা আউশ চালের লাল মিস্টি ভাত, খালাম্মা হাসি মুখে বেড়ে দিচ্ছেন, আমরা নয়জন মজা করে খাচ্ছি, দৃশ্যটা ফ্রেমবন্দী হয়ে গেলো
সেবার শীত পড়েছে অন্যবারের চাইতে বেশি, বিলকিস খালাম্মাদের বাড়ি জমজমাট, আজ তার গায়ে হলুদ, অন্দর মহল ব্যস্ত, হলুদ-মেহেদি-গিলা-সন্ধ্যা-শংখচূর্ণ একটা কুলায় সাজানো, লালপাড়ের হলুদ শাড়ি পড়া খালাম্মাকে অপ্সরীর মত লাগছে, সেই ফ্রেমবন্দী দিনটার পর ঢলে গেছে অনেক বছরের সূর্য, আমার বয়স এখন পনের
তখন বিয়েবাড়িতে মাইক বাজতো দিনরাত, হ্যাজাক বাতির আলো সারা পাড়ায় আভা ছড়াতো, পাড়াগাঁয়ের সেরা গায়করা আসতো, খালাম্মার বিয়েতে বাড়তি আরো কিছু হলো, ঢাকা থেকে আমাদের এক গায়ক মামা এলেন ঢোলক সঙ্গী নিয়ে, আমরা শীতের রাতে খাদির চাদর জড়িয়ে সব ঠাসাঠাসি হয়ে বসলাম
মামা হারমোনিয়াম ধরেছেন, ঢোলক মামার আঙুল নাচছে বায়া তবলায়, একের পর এক গান চলছে, এভাবে সুরের মগ্নতায় আরেক সুর ভুলতে পারো বন্ধু তুমি আমি ভুলিনাই, পরকালে যেন বন্ধু একবার তোমায় পাই, যদি না পাই সেকালে প্রেম যাইবো বিফলে…. আমার সোনা বন্ধুরে তুমি কোথায় রইলারে..” এত ভীড়ে কারও দেখার কথা নয়, হাসিনা খালা আমার চোখের পানি দেখে ফেললো, ‘ মা তুমি কানতাছাও কেন? মা রে, কি অইছে?’ এত লজ্জা নিয়ে কিভাবে খালাকে বলি, উঠতি বয়সের মেয়ের আবেগের কথা এভাবে জানতে নেই গো


ময়নাবু

চাল ঝেড়ে খুদ বের করার কৌশল সবাই জানে না, ময়নাবু জানতেন, খুব যত্ন করে খুদ বের করতেন বুবু, তারপর সেই খুদ ঝেড়ে মিহিন তেতো গুড়োগুলি ফেলে দিতেন, সকালের নাস্তায় আমরা মাঝে মাঝে বৌয়া খেতাম, খুদ দিয়ে রান্না করে তেলে ভাজা ভাত, সাথে রকমারী ভর্তা, শুঁটকি, কালিজিরা, মরিচ, ধনেপাতা, কুচো চিংড়ি, কাঠাল বিচি, কুমড়ো পাতা আর ঘি দিয়ে মাখানো আলুভর্তা, সেই ঘি আসতো আমাদের রাঙা গাইয়ের দুধ থেকে, ময়নাবু প্রতিদিন দুধের সর তুলে রাখতেন, তারপর সাতদিনের জমানো সর মিহিন করে পিষে জাল দিলে ঘি, বাটা সর পরিষ্কার পানিতে ধোয়া হতো আর ধীরে ধীরে সেটা হয়ে উঠতো মাঠা, আমরা সেটাও খেয়ে ফেলতাম
-কি আশ্চর্য এত খাই খাই করছিস কেন?
-আমার খুব মনে পড়ছে, একুশটা বছর! ময়নাবুর কথা বড্ড মনে পড়ছে 
-একুশ বছর তাকে দেখিসনি!
-কি করে দেখবো বল, মা বাবা তাকে ঘরে ঢুকতে দিলো না আর
-কেন?
-মোছলমানের মেয়ে প্রেম করে খেরেস্তান বিয়ে করলো বলে
-কি বলি?
-কি বলবি?
-বুবুর বর ছিলো ক্যাথলিক পাদ্রী, চরিত্র দূষণের অপরাধে তাকেও গির্জা থেকে বের করে দেয়া হলো 
-জানি
-জানিস! কিভাবে? এই শহরের কেউ এসব জানে না, ওই ঘটনার পর আমরা শহর ছাড়লাম
-নিজস্ব ভিটেবাড়ি সব বেঁচে দিলি
-সে কি! এসব কথা তুই কিভাবে জানিস!
- মা, জানবো না, আমার মায়ের নাম ময়না, বাবা আলফ্রেড অধিকারী