গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৫

আফরোজা অদিতি


কমরেড

সকালে হাঁটতে বের হয়েছে একসময়ের কমরেড বয়স আশির কাছাকাছি ডায়াবেটিক- ধরেছে ডাক্তার হাঁটতে বলেছে হাঁটলে ভালো লাগে   একটা সময় ছিল তখন দেহে শক্তি ছিল কাজ করেছেন হেঁটেছেন খুব কম গাড়ি ব্যবহার করেছেন মনে পড়ে হেঁটে হেঁটে মিছিল নিয়ে মিটিংয়ে অংশ নিতে যাওয়ার কথা হাঁটার অভ্যাস পুরোপুরি যায়নি এখনও আছে

আজ হরতাল আরও ভালো লাগছে হাঁটতে আজ বের হতে একটু দেরি হয়েছে হরতাল ছাড়া অন্যদিন এই সময় এই পথে হাঁটা যেতো না কমরেড থাকেন বাসাবো সাবলেট শুধু স্ত্রী আছেন যুদ্ধের সময় তার  চৌদ্দ বছরের ছেলে নিহত হয়েছে কারা হত্যা  করেছে আজও জানেন না আর এক মেয়ে একরকম  বিনা চিকিৎসায় ক্যানসারে মারা গিয়েছে স্ত্রী স্কুলের শিক্ষক ছিল পেনশন পান আর এখনও ছাত্র পড়ান এই দিয়ে দুইজনের চলে যায় কখনও তো এর বেশি কিছু তো চাননি তিনি

তিনি ছিলেন কৃষক আন্দোলনের নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর (ন্যাপ) সমর্থক এরপর গোপন পার্টি চেয়েছিলেন দেশের স্বাধীনতা জনগণের মুক্তি আইয়ুবের বিরুদ্ধে, ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই তার চাকরি চলে গিয়েছিল রাজনীতির কারণে আর কোথাও চাকরি পাননি  এবং জীবনের অধিকাংশ সময় আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতে হয়েছে তাকে পরিবার আর ছেলেমেয়ের উর্ধে ছিল তার দেশ আর দেশের জনগণ তিনি সবসময় মনে করতেন কৃষকের উন্নতি ছাড়া দেশের উন্নতি নাই তাছাড়া আরও বিশ্বাস করতেন জমি যে চাষ করে জমি তার    

অতি সাধারণ জীবন যাপন করেছেন তিনি, এখনও করেন ইচ্ছা করলে অনেক কিছু হতে পারতেন, অনেক কিছু পেতে পারতেন এমনকি দেশের মন্ত্রী পর্যন্ত হতে পারতেন কিন' তা হননি বা হতে চাননি তিনি মনেপ্রাণে কমিউনিস্ট এখনকার কমিউনিস্ট নেতা কর্মীদের মতো নন তিনি তার মনে হয় এখনকার কমিউনিস্টরা বড় সুবিধাবাদী হয়ে গেছে সুখ আর স্বাচ্ছন্দে গা ভাসিয়ে জনগণের ভালো করার নামে ভেক ধরে আছে এরা সব নিজেদের স্বার্থে গা ভাসানো এবং তলে তলে বুর্জোয়া রাজনীতির সমর্থক ওদিকে আবার বিরোধীদলের সাংসদরা সংসদে যায় না অথচ রাষ্ট্রের টাকায় জীবন যাপন  করে কমরেডের বিস্ময় তাদের কখনও কেন মনে হয় না এই টাকা জনগণের অতি কষ্টের টাকা ! যা কর হিসেবে নেওয়া হয় কেমনধারা রাজনীতি ! তার মনে হয় এই প্রজন্মের ভেতর থেকে কেন নতুন ধারার রাজনীতিবিদ বের হচ্ছে নাযারা শুধু দেশকে ভালোবাসবে, জনগণকে ভালোবাসবেযারা শুধুই কথা বলবে জনগণের  যারা কোন ভেক ধরবে না  

এখন মাঝে মাঝেই হরতাল হচ্ছে হরতাল হলে আর কারো নয় কষ্ট হয় সাধারণ মানুষের ধ্বংস হয় দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয় দেশের সম্পদ এখনকার সরকারও গনতন্ত্রের নামে -গনতান্ত্রিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে দেখেশুনে কমরেডের মনে হয় একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্র কায়েম হতে যাচ্ছে দেশে দেশে এমনিতে মৌলবাদের উত্থান হয়েছে মৌলবাদের উত্থানেও বিস্মিত কমরেড ভাবেন কেন এমন হলোউত্তর পান না কারণ আগের মতো তার মাথা আর কাজ করে না বুঝতে না পেরে কষ্টটা শুধুই বাড়ে আর বাড়ে

আহারে আমার দেশ ! তোমার জন্য আমার খুব কষ্ট হয় ! তুমিই তো আমাকে চিরঞ্জীব করেছ ! তোমারই জনগণ আমাকে মনে রেখেছে  আমার দেশমাতৃকা  অন্যমনস্ক হয়ে যায় কমরেড হাঁটতে থাকে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে এসেছে প্রধান সড়ক একজায়গায় জটলা দেখতে পেয়ে ওদিকে এগিয়ে যায় কমরেড একটা শিশু পড়ে আছে মৃত হাত উড়ে গেছে পেট ফেটে রক্ত বের হচ্ছে কীভাবে হলো ! জটলার ভেতর থেকে একজন বললো, ছেলেটা ককটেল বহন করছিল সেটা  বিস্ফোরিত হয়েছে শিশুটি ককটেল বহন করছিল কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কমরেড ওরা এই কুচ্ছিৎ রাজনীতিতে শিশুদেরও ব্যবহার করছে ! হায়রে আমার দেশ ! তুমি কাঁদছো ! এতো নিঃশব্দ কান্না কেন তোমার ! তুমি তো এই সব শিশুদের জন্যই আগামীতে ওরাই তো থাকবে তোমার বুকে তোমার বুক থেকে চলে যাচ্ছে ওরা, চলে যাচ্ছে তোমার ভালোবাসার সন্তানেরা ! কিছুই করতে পারিনি আমি, আমরা সেই সময়ের রাজনীতিবিদরা আমরা রাজনীতির কূটনৈতিক চালে হেরে গিয়েছি আমি চিরঞ্জীব হইনি, তুমি শুধু আমার  বুকে চিরঞ্জীব হয়ে আছো কমরেডের দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নামে

দূরে পুলিশের গাড়ির আওয়াজ জটলা ছত্রভঙ্গ এমন সময় আবার বিস্ফোরিত ককটেলের শব্দ ধূঁয়ায় ছেয়ে যায় ধূঁয়া সরলে দেখা যায় রাস্তায় চিৎ হয়ে পড়ে আছে কমরেড হাতের শক্ত মুঠিতে ধরা লাঠিটা উঁচু হয়ে আছে যেন লাঠিটা যুদ্ধ ঘোষণা করছে চোখ দুটিও বিস্ফোরিত যেন বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আজকের কথিত দেশপ্রেমিদের দিকে ধিক্কার দিচ্ছে ওদের দেশপ্রেমকে

পরদিন খবরের কাগজের খবর হয়ে যায় কমরেড ছোট্ট একটুকরা খবর ককটেল বিস্ফোরণে মারা গিয়েছেন জলিল হোসেন নামে পকিস্তান আমলের  স্বাধীনতাকামী  এক কমিউনিস্ট নেতা