কৈশোরের ঝরা পাতা
শৈশবের পাতা ঝরে যাচ্ছিল। কৈশোর ছুঁয়েছি টের পাচ্ছিলাম দেহে ও মনে। রংবেরঙের স্বপ্ন এসে মন জুড়ে বসছিল। চোখের সামনে নীলাকাশের উদারতা, মনের সামনে আসমুদ্র হিমাচলের বিস্তার। সরল সাদাসিধা একটা ছেলে। একটুতেই আনন্দ ঘিয়ে যায় মন তার। এমনি এক দিনের কথা। আমি আর দেবাশীষ ছিপ নিয়ে মাছ দরতে গিয়েছি চুর্নী নদীতে। নদী একেবারে ছোট নয়, চওড়া যত না তার চে গভীরতা অনেক বেশী। সে কারণে হবে, স্রোতের তোড়ের সঙ্গে ঘূর্ণিপাকও রয়েছে।
ছিপ নিয়ে বেশ কিছু সময় বসে ছিলাম। এত সময়ের মধ্যে একবার মাত্র ছিপের ফাতনা নড়েচড়ে ডুবে ছিল। টান মারতে কিছু একটা লেগেও ছুটে গিয়ে ছিল। বড় মাছটাছই হবে--যেমনটা ছুটে যাওয়া মাছটা বড় সম্ভাবনার ছাপ মনে ছেড়ে যায় ! তারপর ঠায় আরও বেশ সময় ধরে বসে আছি।
হঠাৎ পাশ থেকে ধুপ ধাপ কাঁইমাই আওয়াজ এলো--তারপর ঝুপ ঝাপ শব্দ। এতটা লক্ষ্য করিনি, কারা যেন ঝুপ ঝাপ আমাদের পাশটিতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। খিলখিল খলখল হাসির শব্দে বোঝা গেল অল্প বয়সের মেয়েদের দল স্নানে নেমেছে।
না, ওরা মাছ ধরতে দেবে না--ওদের লাফঝাঁপ জল ছেটানো খেলায় আমরা বেশ বিরক্ত হচ্ছিলাম। দেবাশীষ রেগে গিয়ে তার ছিপ তুলে নিয়ে সামান্য দুরে অন্য জাগায় গিয়ে বসলো। আমি অপেক্ষা করলাম কখন ওরা উঠে যাবে বলে--তবে ওদের লাফঝাঁপ আমার কিন্তু মন্দ লাগছিল না। অন্তত এত সময় ছিপ নিয়ে নিষ্ফলা বসে থাকার চে তো ভাল। তবু মাঝে একবার বলে ছিলাম, এই তোরা ও দিকে গিয়ে স্নান কর না !
--কাঁহি কি রে ? তুরা যা না অন্য জাইগায় ! স্নান করতে করতে একটা মেয়ে বলে উঠল--আর সঙ্গে সঙ্গে অন্য মেয়েরা দমক নিয়ে নিয়ে হেসে উঠলো। এবার মেয়েগুলির দিকে ভাল করে লক্ষ্য করলাম। ওরা অবাঙ্গালী হবে। সাঁওতাল বা আদিবাসী কিম্বা ভিনদেশী শ্রমিক শ্রেণীরও হতে পারে। এমনও হতে পারে কোন যাযাবরের দল আশপাশে কোথাও তাদের ডেরা ফেলেছে।
দেবাশীষও বলে ছিল, আমরা মাছ ধরছি দেখছিস না ?
সেই মুখর মেয়েটাই হবে, বলে উঠলো,কত মাছ ধরেছিস রে বাবুরা ? আবার মেয়ের দল সুর করে হেসে উঠলো। সংখ্যায় ওরা বেশ কজন তাই অনেকটা নির্ভীক--আমাদের পরোয়া করছিল না।
আমি কখন যেন মাছ ধরা ছেড়ে মেয়েদের হাবভাব দেখছিলাম। মেয়েদের প্রায় সব কজন ছিল শ্যামবর্ণা। পরনে লাল নীল সবুজ রঙের সস্তার সাড়ি জড়ানো। অন্তর্বাস কিছুই নেই হবে। সে জন্যে ওদের আদৌ পরোয়া আছে বলে মনে হয় না। লক্ষ্য করলাম ওদের মধ্যে একটি মেয়ে সামান্য ধীর স্থির শান্ত। বেশী একটা হাহা হিহি করছিল না--ওর মুখে হাসির রেখা বারবার ফুটে উঠছিল বটে কিন্তু সেই খলবলি হাসি না। আমি দৃষ্টি একটু ঘন করলাম, মেয়েটির চোখে আমার চোখ পড়ে গেল। বাঃ, ওর চোখ দুটি তো খুব সুন্দর ! একেই কি টানা টানা চোখ বলে ?—ঘন, কালো দুটি উজ্জ্বল চোখ--কালো হরিণ চোখ ? ওদের সবার হাতেই কাঁচের চুড়ি ছিল। যতবার হাত নড়ছিল, টুং টাং, রিনীঝিনি শব্দ হয়ে বেজে উঠছিল। নদীর জলের তিরতির স্রোতের সঙ্গে সুন্দর এক রণন ধ্বনি হয়ে উঠছিল।
চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নিলো সেই শান্ত মেয়েটি। পাঁচ সাত জনের মাঝে ওকে স্বতন্ত্র মনে হচ্ছিল। সামান্য বুঝ অবুঝের মাঝে নম্রতা ওকে ঝুঁকিয়ে রেখে ছিল।
চারদিকের চকচকে সূর্যের আলো নদীর জলে প্রতিফলিত হচ্ছে। ঝকঝকে রুপালী জল উচ্ছলিয়ে ওরা স্নান করছে। না, ওদের মনেও ছিল সরলতা--যেটুকু উচ্ছলতা সেটুকু তো বয়সের ধর্ম। ওদের বয়স বার, তের, চোদ্দর মধ্যেই হবে।
প্রায় একটি ঘণ্টা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ওরা ওদের স্নান সারল। এবার ঝটপট নদীর পারে উঠে আসলো সবাই। গায়ের কাপড় ওদের শরীর লিপ্টে ধরে ছিল। ওদের অনেকেই নিজেদের সাড়ি সামলাতে ব্যস্ত হচ্ছিল। এদিক ওদিক টেনেটুনে উন্নত বন্ধুর জাগাগুলিকে ঢেকে নেবার চেষ্টা চলছিল। আমি তাকিয়ে আছি সেই নতমস্তক মেয়েটির দিকে। ও আগেই নিজের লজ্জার জাগাগুলি পরিপাটি করে ঢেকে নিয়েছে। আমি আরও চকিত হলাম, ওর মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে। জল বিন্দু তার কপাল গাল কপোলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সূর্যের আলোক আভায় মতি বিন্দুর মতই সেগুলি জগমগ করে চলেছে ! মনে হচ্ছিল মেয়েটির মুখ কোন উৎসব সজ্জায় কারুকার্য মণ্ডিত হয়ে আছে। সমস্ত দেহের অন্ধিসন্ধিতে জ্বলজ্বল মুক্তালঙ্কার ঔজ্জ্বল্য এক দেব কন্যার মত তাকে মহিমান্বিত করে তুলেছে । আমি নীরব মুগ্ধতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি।
আর মুহূর্ত মাত্র। মেয়েগুলি ছুটে চলে যাচ্ছে। হা হা, হি হি হাসির লহর নিয়ে ওরা নদীর বালুচরি তীর ধরে ওপরে উঠে যাচ্ছে। সেই মেয়েটি সামান্য পিছনে--ও কি আমাকে লক্ষ্য করছে ? ওর দিকে আবার দৃষ্টি মিলালাম, হ্যাঁ, চোখে চোখ পড়ে গেল। আর হ্যাঁ, স্পষ্ট দেখতে পেলাম, মেয়েটির মুখে আলতো হাসির রেখা ফুটে উঠলো ! কালো মায়াময় সেই চোখ--আয়ত চোখের পত্রপাপড়ি--সূক্ষ্ম চোখের জোর ভ্রূতে ও যেন আমায় নিভৃত আলোকপাত করে গেল ! মুহূর্ত সময় পরে, আঃ, একটা শব্দ কানে এলো। তাকালাম আমি। দেখলাম, মেয়েটি ব্যথা কাতর হয়ে মাটিতে বসে পড়ল। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কি হল ? ওর পায়ে কাঁটা ফুটল নাকি ? দেবাশীষের দিকে একবার নজর দিলাম। ও নদীর দিকে তাকিয়ে চুপ চাপ বসে আছে।
আমি উতলা হয়ে উঠলাম। মেয়েটি তখনও বসে আছে। আমি আর থাকতে পারলাম না, কিছু না ভেবেই ছুটে গেলাম মেয়েটির দিকে। ও সত্যি ব্যথাতুর মুখ নিয়ে বসে আছে। হ্যাঁ, কাঁটা ফুটে আছে ওর পায়ে। আমি, কাঁটা, বলে ওর পাশটিতে বসে গেলাম। ও একটু সংকোচ করে সরে বসার চেষ্টা করল। আমি সে দিকে নজর দিলাম না--হাত নিয়ে গেলাম তার পায়ের কাছটিতে। দেখলাম বড় একটা কাঁটা ফুটে আছে। নীরবে আমি এক হাতে ওর পা ধরে অন্য হাত দিয়ে কাঁটা চিপে ধরে এক টানে সেটা তুলে নিলাম। আঃ, করে ব্যথায় কুঁকড়ে গেল মেয়েটি। পাটা নিজের দিকে টেনে নিলো। এ বার পা থেকে রক্ত ঝরতে দেখলাম। আমি নিজের অজান্তেই মেয়েটির পরনের কাপড়ের এক কোনা টেনে নিয়ে চেপে ধরলাম সেই কাঁটা ফোটা জাগায়। রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেল। এবার আমাদের উভয়ের হুঁশ এলো। মেয়েটি চট করে দাঁড়িয়ে গেল। সংকোচ নিয়ে আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। এত সময় ওর গা আমার গায়ে বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছিল। আমরা কেউ সেটা অনুভব করতে পারিনি। ও এবার আমার দিকে তাকাল, আমিও ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আর কতক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম জানি না।
হঠাৎ মেয়েদের কোলাহলে আমাদের সম্বিত ফিরল। ওকে খুঁজতে মেয়েরা আবার এদিকে ফিরে আসছে মনে হল।
--ব্যথা কমেছে তোমার ? ক্ষীণ আওয়াজ বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে।
ও হেসে মাথা নাড়ল।
ওরা এসে যাচ্ছে।
--তোমার নাম কি ? সসংকোচে আমি প্রশ্ন করি।
ও মাথা নিচু করে বলল, যমুনা।
আমি মনে মনে আবৃত্তি করলাম, যমুনা, যমুনা !
এদিকে মেয়েদের ঝাঁক এসে আমাদের ঘিরে নিলো। উতলা হয়ে কোন শঙ্কিত ঘটনার ইঙ্গিতে ওরা এক সঙ্গে অনেক প্রশ্ন করে গেল। আমার দিকে আড় চোখে তাকাল।
মুহূর্তের মাঝে ওরা জেনে গেল ঘটনা। আমার আর যমুনার সান্নিধ্যের ব্যাপারটা আন্দাজ করে নিয়ে ওরা মুখ টিপে হেসে নিলো। আর খানিক পরেই ওরা যমুনাকে নিয়ে নিজেদের ডেরার দিকে পা বাড়াল।
আমি ঠায় সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওদের যাত্রা পথের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিলাম। যমুনা পা খুঁড়িয়ে হাঁটছিল, তার মাঝে ফিরে তাকাচ্ছিল বারবার। এক সময় নদীর পার ছাড়িয়ে ওরা আমার চোখের বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
তারপর অনেক খুঁজেছি যমুনাকে। পাই নি—ওরা হয়ত ওদের যাযাবরের ডেরা তুলে নিয়ে অন্য কোথায় চলে গিয়ে ছিল হবে। কৈশোরের সেই স্মৃতি আজও ভুলতে পারলাম কৈ ? নিভৃত সময়ের ফাঁকে মন বুঝি আজও যমুনাকে খুঁজে ফেরে!