গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৫

দোলনচাঁপা ধর


একদিন অকস্মাৎ

 আমার জীবনে নিরন্তর শীতকাল, আর সাঁঝ নামলে যে আবছা ধোঁয়াশা ঘিরে থাকে গোটা গ্রাম, তুমি হলে সেই ’—আজ বহুদিন পরে অবন্তীর শেষ চিঠির শেষ লাইনটা আবার মনে এল তিমিরেরহয়ত আসত না কিন্তু কাল নেহাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়াতে আজ এত কথা ভিড় করে আসছে মনেদেখাও হয়ত হত না কিন্তু কাল শনিবার, হাফ ডে ছিল এমনিতেই, যাদবপুরের ঘটনা নিয়ে সারা শহরের মত মনে মনে উত্তাল ছিল সেও, কখন যে পায়ে পায়ে নন্দন চত্বরে উপস্থিত হয়েছিল সে কথা আর মনে আসে নাওখানে মানুষের নদীতে মিশে হুঁশ হল যখন শান্ত বিশাল পাঞ্জার অভিনন্দনসূচক চাপড় টা পিঠে এসে পড়ল
-- চাচু, তুমি আর মিছিলে ?
--  আহ্রে তুই?
-- হ্যাঁ চাচু আমি, আরও আছে গোটা ব্যাচ, তা তুই মিছিলে যে?
-- হ্যাঁরে, না এসে পারলাম না
-- দেখ আরও কতজনের সাথে দেখা হয়ে যাবে, বহুলোক এসেছে তো

শান্ত কি জানত অবন্তীর আসার কথা ? তাই কি ওভাবে বলল ? মিছিলের সাথে পা মিলিয়ে এগোতে এগোতে সত্যিই একে একে দেখা হয়ে গেল কত হারিয়ে যাওয়া চেনা মানুষের সাথেতিমির কোনোদিন মিটিং মিছিল যায় নি, সে বড় আত্মকেন্দ্রিক থাকত বা থাকতে বাধ্য হত তার পারিবারিক অবস্থার কারণে, যেখানে তার বাবা ছিলেন এক সামান্য চাকুরে আর মা নিয়ত ব্যস্ত থাকতেন জোড়াতালি দিয়ে কোনোমতে সংসারটিকে সুখী রাখতে ভালভাবে পাশ করার পর কলেজে যাওয়ার প্রথম দিনেই কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে মা বলে দিয়েছিলেন বন্ধু ভাল কিন্তু তার দায় যতক্ষণ সে নিজে নিতে পারে ততক্ষণ’, বাবা শুধু তাকে কলেজে পড়াবার খরচটাই কষ্ট করে হলেও চালাতে পারবেন তার বেশী এক পয়সাও নয়, তিমিরের ছোট বোন দিবা তখন ক্লাস এইটের ছাত্রী, তার কথাও ভাবতে হবে

অতএব তিমির তার বন্ধুত্ব কলেজবিল্ডিং এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল, বাকি সময় টিউশন পড়ানো আর পড়া, তবু তার মাঝেই কিভাবে চেনা হয়ে গেল অবন্তীর সাথেসেই যেদিন সেদিনকার ছোট একটা দল ধর্মঘট ডেকেছিল আর সবাই বলল ওদের ডাকা হরতাল বিফল হবেসবাই যে যার কাজে বেরিয়ে গেল, তিমিরও কলেজে গেল কিন্তু অর্ধেক ক্লাস হতে না হতেই বেশ কিছু গুন্ডামত ছেলেরা এসে কলেজ বন্ধ করতে বলল, তাদের হাতে ছিল লাঠি, সাইকেলের চেন আরও নাকি উন্নত কিছু ছিলকলেজের বাইরে পা দিতেই শহরের অন্য চেহারা, যেন কি এক জাদুবলে সব এলোমেলো হয়ে গেছে রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাইক বাহিনী, বাসে আগুন অটোরিক্সা গুলো যেখানে সেখানে মুখ গুঁজে নিথর হয়ে আছে, যাত্রীবিহীন ট্রামগুলো মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে হারিয়ে যাওয়া বাচ্চার মতআর কলেজফেরত কত না ছাত্র ছাত্রী রা বিভ্রান্তের মত ইতস্তত দৌড়াদৌড়ি করছে কোন যানবাহনের খোঁজেএকই দিকের যাত্রী এমন ছেলেমেয়েরা ট্যাক্সি পেয়ে গাদাগাদি করে কোনরকমে তাতে চড়ে লাল রুমাল কি ওড়না নাড়াতে নাড়াতে চলে যাচ্ছে লটারি জেতার আনন্দে

তখনই দেখল ট্রেডার্স অ্যাসেম্বলির ফুটপাথে জড়সড় হয়ে দাঁড়ানো মেয়েটাকে, হলদে রঙা সালোয়ার কামিজ পরে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে করুণভাবে,চেনা চেনা ঠেকল আর সাথে সাথেই মনে পড়ল কোনোদিন ট্রামে কলেজে আসলে দেখেছে মেয়েটি মাঝে মাঝে বেকবাগান থেকে ওঠে বা নেমে যায়, মানে ওইদিকেই বাড়ি ওর
হয়ত একটু বেশীক্ষণ তাকানো হয়ে গেছিল মেয়েটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলে
-- আপনি ফিরবেন না?
-- হ্যাঁ মানে কেন বলুন তো
-- আপনি কংগ্রেস এক্সিবিসন রোডে যাবেন তো ?
-- আপনি কি করে...?
-- আমি জানি, আপনি ডিপো থেকে ওঠেন
-- আর আপনি তো বেকবাগানে ?
-- হ্যাঁ ওখানেই নামি, খেয়াল করেছেন আপনি?
-- না মানে ওই আর কি?
-- চলুন যেতে যেতে কথা বলি......।
-- কোথায়?
-- বারে ! বাড়ি যাবেন না?
-- হ্যাঁ তাতো যাব, কিন্তু আজ যা অবস্থা, হেঁটে যেতে হবে মনে হচ্ছে, পারবেন এতটা হাঁটতে?
-- না পারলে চলবে কেন? চলুন......

বাকি পথটা বেশ পুরনো দিনের বাংলা সিনেমার মত কেটেছিল, কখনো তিমিরের মনে হয়েছে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ওই রাজনৈতিক দলের মেম্বার হয় গিয়ে যারা আজ ধর্মঘট ডেকেছে, বাস পুড়িয়েছে, বাইক নিয়ে দাপাচ্ছেআর ভাবতে অবাক লাগে আজ তাদের কুকর্মের প্রতিবাদেই আজ এত মানুষের সাথে সেও পথে নেমেছে
রূপাঞ্জনা দি এসেছেন, ছাতা মাথায় ধীর গতিতে হেঁটে চলেছেন সকলের সাথেইকনমিক্স ক্লাস করতে গিয়ে শিক্ষার চেয়ে শিক্ষিকাই নয়ন জুড়ে থাকত একসময়, সময় কারুকে রেয়াত করে না যেমন করে নি অবন্তীকেঘন নীল শাড়িতে আজকের এই বাদল দিনে যেন শুধু তাকেই মানায়,সেই পুরনো আমলের মত দেশ কাল ভুলে তিমির ওর কাছে যেতে গিয়ে বাধা পেল ওর সুখী গৃহকোণ ছাওয়া কপালের চিলতে সিঁদুরে, আর তখনি অবন্তীর চোখ তিমিরে মিশলপ্রথমে দ্বিধা তারপর রোদ্দুরের মত ঝলমল করে এগিয়ে এসে

-- কেমন আছিস?
-- হ্যাঁ মানে ভাল, আপনি?
-- তুই আর পাল্টালি না, আপনি কে এখানে ?
-- ওই আর কি ; অভ্যেস
-- তুই তো বন্ধু, তুমি বলতাম মনে আছে আমার, তবে এখন থেকে তুইই থাক
-- এখন থেকে?
-- আমি রাসবিহারী তে থাকি এখন, সাউথের দিকে একটা স্কুলে পড়াই, ছেলে সেভেনে পড়ে
-- বাঃ, বড় হয়ে গেছে তাহলে
-- আর তোর ?
-- কি আমার?
-- বাঃ ! তোর কথা বল কিছু
-- আমার আর কি কথা? যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি, সেই কংগ্রেস এক্সিবিসন রোড, শীতকাল
-- তুই ভুলিস নি, না?
-- আসলে কি ভুলতে হবে সেটাই যে মনে নেই, তবে তোর চিঠির শেষ লাইনটা বিশ্বাস করতে ভাল লাগত, সেটা সত্যি কিনা তা কখনো প্রশ্ন করি নি মনকে, ধর একটা আশ্রয় ছিল ওটা
-- সেদিন ওই লাইনটার থেকে সত্য আমার জীবনে কিছু ছিল না রে, তাই লিখেছিলাম
-- সত্যি গুলো সময়ে সময়ে পাল্টে যায়,একসময় একেবারেই অচেনা লাগে,সেই সত্য-মিথ্যার জন্যই তো আজ আমরা পথে নেমেছি, তাই না ?
-- এই তোর নাম্বার টা দে তো, এত কাছে থাকি তবু এতদিন দেখা নেই
-- বললাম না আমি আগের মতই আছি, আমার কোন নাম্বার নেইচলি রে.........
রাজভবন এলাকা থেকে ঝিরঝির বৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে আজ নিজেকে বেশ হাল্কা লাগছিল তিমিরের, প্রত্যেক মানুষই যে অভিনয় করে চলে আজীবন আজ হয়ত তার থেকে মুক্তি পাবে সেপকেট হাতড়ে মোবাইল বার করে প্রত্যুষা কে কল করে
-- রেডি হয়ে থেকো, আমি ফিরছি, আজ রোদ্দুর কে তারামণ্ডল দেখাব
প্রত্যুষার মুখের উপর একুশ বছরের অবন্তীর মুখের আজ পরাজয়, এবার থেকে বিজয়ীর মুখখানাই সে দেখতে চায়গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি তার সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে দিচ্ছিল