গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৪

শৌনক দত্ত


সন্যাস ভুগোল (৩য় পর্ব)

স্নান সেরে বাড়ী ফিরেই এলো কেশে শুয়ে পড়লেন কিরণবালা   কিরণবালা ঘামছেন,হাসফাস করছেন আর শুধু ছেলেমেয়েদের ডাকছেন  খবরটা ঘর থেকে গদিতে পৌঁচ্ছোতে সময় লাগলো না।দৌঁড়ে এলেন নরেনবাবু। উপেনবাবু ছুটলেন ডাক্তার ডাকতে। যোগেশবাবু ছুটলেন দত্ত হাই স্কুলে নির্মাল্যকে আনতে।মতিবাবুরচেম্বারে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো সুভাষ আজ বিকালে ফুটবল ম্যাচে কে কে খেলবে কি হবে তাদের কায়দা সেসব ছক কষছিলো পাপ্পুর সাথে।মাঝে অবশ্য বিশু,মঙ্গল ও এসে জুটেছে।সর্বা মানে সর্বানন্দ খবরটা নিয়ে এলো তুই এখানে বসে ছক কাটছিস শুনলাম তো মার নাকি খুব খারাপ অবস্থা।বাড়ীতে কান্নার রোলপড়ে গেছে।গদি বন্ধ করে দিয়েছে। এতক্ষণ সর্বার কথায় আমল দেয়নি গদি বন্ধ করে দিয়েছে শুনেই সুভাষ উঠে দৌঁড় লাগায় বাড়ীর দিকে। সত্যিই গদির সব দরজা বন্ধ। সারা বাড়ী জুড়ে থমথমে।এক দৌঁড়ে ঢুকে যায় বাড়ীর ভেতর।লোকের ভিড় ঢেলে মার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সুভাষ।বাবা গনু এসেছিস,ভানু কোথায়আমার ভানু।কিরণবালা বিলাপ করতে থাকেন।যোগেশবাবুর সাথে স্কুল থেকে ফিরে এসে মার কাছে যায় নির্মাল্য।কিরণ,কিরণ এই যে ভানু এসেছে চোখ মেলে দেখো।হাতের নাড়ি ধরে আছেন ডাঃবিরু ভট্টাচার্য। ডাঃবীরেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য এই এলাকার নামী ডাক্তার কেউ কেউ ধনান্তরী ডাক্তার বলেও ডাকে। তার চোখে কোন উজ্জ্বলতা নেই।আসার পর থেকে কথাও বলেছেন দুটো গনু আর ভানু কোথায়ওদের আনাও দত্তবাবু।

ডাক্তার বীরেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য দত্তবাড়ীর পারিবারিক ডাক্তার কিংবা বন্ধু বহুকাল।সদাহাস্য এই ডাক্তার আজ যখন গম্ভীর নরেন্দ্রবাবু মোটামুটি মনে ধরে ফেলেছেন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে কিংবা ঘটে গেছে। দত্তবাবু এই দিকে শোনো।বীরু ডাক্তারের ডাকে চেতনা ফেরার মত বাস্তবে ফিরে আসেন নরেন্দ্র দত্ত। অবস্থা খুব একটা ভাল ঠেকছেনা। বৌঠান বুঝি.. নরেনবাবু কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ধৈর্য ধর দত্ত।এখন তোমাকেই শক্ত থাকতে হবে।এইসময় তুমি ভেঙ্গে পড়লে ছেলেমেয়ে গুলোর কি হবে ভাবোবীরুবাবু ময়মনসিংহ,ঢাকা কিংবা কলকাতা নিয়ে গেলে কিরণ কেলাভ নেই।যদি সে পথ থাকতো তবে কি আর নাড়ী ধরে বসে আছি দত্ত। এইদিকে কিরণবালা দেবীর বিলাপে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠছেবাবা ভানু তুমি আমার সোনা ছেলে বাবা ঠাম্মা সহ সব ভাইবোন কে তুই বাবা দেখে রাখিস। মা গো আমার ছেলেমেয়ে কে দেখে রাখিস। তিনি কোথায় গেলেন।উপেনবাবু,যোগেশ­ বাবু আপনরা থাকতে যেন আমার তেনার যেন কোন কষ্ট না হয়।তিনি কৈ গোধুতির কোনে চোখ মুছে নরেনবাবু সামনে এসে দাঁড়ালেন।পেছনে বীরু ভট্টাচার্য।কিরণবালা করজোড় কর হাত দুটি অনেক কষ্টে বুকের কাছে আনলেন। আমায় তুমি ক্ষমা করো। পুষ্পটা কে দেখা হলো না। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে কিরণবালার।চোখ বুজে আসচ্ছে বীরুবাবু নরেনবাবুকে সরিয়ে নাড়ি চাপলেন।বা হাতটা রাখলেন কিরণবালার চোখে সুভাষ মা চিত্কার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো দত্তবাড়ীর ঘর থেকে দেয়াল, দেয়াল থেকে সারাবাড়ী যেন এক পলকে কেঁদে উঠলো।বীরুবাবু নরেনবাবুকে চেপে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ৬ঘন্টা আগে  গদির সামনে বারান্দায় লাশ রাখা হয়েছে।যে যেভাবে কিরণবালার মৃত্যুসংবাদ শুনছে সে সেভাবেই ছুটছে দত্তবাড়ীর দিকে। সধবা নারীদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে  সতী সাবিত্রী গো দেখো কেমন শাঁখা সিঁদুর নিয়ে চলে গেলো, দেখলে মনে হয় লক্ষ্মীপ্রতীমা ঘুমাচ্ছে ঘাটে দেখেও বুঝিনি এই শেষ নাইতে এসেছে।কত কথা কইলো।গদিতে আসা কোন খরিদার কবে একদিন প্রসাদ খেয়েছিলেন তার গল্প বলে যাচ্ছে। কিরণবালার পায়ের কাছে বসে আছে তার ছেলেমেয়েরা। উপেনবাবু কাষ্টের সরঞ্জামাদীর জোগাড়ে বেরিয়েছেন।কিরণবালার মাথার কাছে বসা নরেনবাবু মাথায় হাত রেখে যেন পাথরের মূর্তির মত নিথর হয়ে গেছে।কুলপুরোহিত গীতা পাঠ করছেন।আমীর আলী খান পাঠান আমের চেলা খড়ি আর ঠুম পাঠাতে ব্যস্ত শ্মশানে।যোগেশবাবু সহ অন্যান্যরা শেষ যাত্রার পুষ্পরথ বানাতে ব্যস্ত দত্তবাড়ীর এত ব্যস্ততাতেও যেন অদ্ভুত এক নীরবতা। বাবু এবার মা ঠাকরান কে নেবার যে সময় হলো। আমীর আলী খান পাঠান এসে নরেনবাবুকে ধরে তুললেন  নরেনবাবু কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। সঙ্গে কেঁদে উঠলো নির্মাল্য,সুভাষ,গৌরি,নারায়ণ,সীতা আর শিশু গোপাল ঠাম্মার কোলে বসে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে। হাউমাউ কান্নার মাঝেই।খোল করতালের আওয়াজে হরিনাম সংকীর্তনের সুরে পুস্পরথ উঠে গেলো চারকাঁধে আর খইয়ের সাথে উড়তে লাগলো পয়সা শ্মশানযাত্রা পথে। কিরণবালার পুস্পরথ স্বর্গে না নরকে যাবে তার হিসাব না থাকলেও ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে কাতারে কাতারে মানুষ পা ফেললো তার পিছে পিছে শ্মশানের দিকে।

চিতা সাজানো হয়ে গেছে। কিরণবালার শবযাত্রাও এসে শ্মশানে ঢুকেছে। নাম সংকীর্তন শেষ করে স্নানের জন্য কিরণবালাকে নামানো হলো শ্মশানের পাশ দিয়ে বয়ে চলা মগড়া নদী থেকে সুভাষ জল তুলে আনে সুগন্ধী সাবান ঘসে ঘসে স্নান করায় নির্মাল্য,সুভাষ আর নিহারেন্দু ছোট্ট পবিত্র তার বাবা নরেন্দ্রবাবুর কোলে চেপে তাকিয়ে আছে।আলতা সিদুঁর ধুঁয়ে যাচ্ছে কিরণবালার শরীর থেকে। স্নান শেষে হরি বলো বোল হরি..হরি বলো বোল হরি.. হাঁক ছেঁড়ে কিরণবালার দেহ উঠে যায়চিতায়।নির্মাল্য,সুভাষ আর নিহারেন্দুর কান্নায় কিরণবালার নিথর দেহ ঢেকে যেতে থাকে আম আর চন্দনের চেলা কাঠে। পাটকাঠি সেজে উঠে আমের পাতা আর ঘি এ উপেনবাবু নীচ থেকে উঠে এলেন  মুখাগ্নিটা ওরা সেরে ফেলুক কর্তাবাবু   নরেন্দ্রবাবু নির্বিকার চার সন্তানের সাথে নেমে এলেন সজ্জিত চিতার সামনে কিরণবালাকে শেষ দর্শন করতেই পাটকাঠির গুচ্ছ জ্বলে উঠলো পবিত্রকে কোলে রেখেই পবিত্রর পাটকাঠি ধরে চিতার চারপাশে নির্মাল্য,সুভাষ,নিহারেন্দুর পিছেন পরিক্রমা করে একে একে সবাই আগুনভরা পাটকাঠি গুচ্ছ ছোঁয়ালেন কিরণবালার মুখে এভাবে সাতটি পরিক্রমার পর সমস্ত পাটকাঠি চিতার নীচে ধরতেইদাউদাউ জ্বলে উঠলো চিতা আর কান্নার সাথে মিলে মিশে গেলো হরি বলো বোল হরি.. রোদ্রৌজ্জ্বল আকাশ কাল হয়ে আসে। চিতার আগুন আরো বেড়ে যায়।পুড়তে থাকে কিরণবালা একটি নাম কিংবা একটি আকাশ।

কোচবিহারের বর্ষা বেশ রোমান্টিক। শুধু কোচবিহার নয় সারা উত্তরবঙ্গজুড়ে বর্ষার এক অন্য মাত্রা আছে। মধুবাবা যখন ঘর থেকে বের হলেন সূর্য তখন মেঘেরসাথে হারিয়ে গিয়ে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। ঈশান কোণে তখন ভূসা কালির মত মেঘ জমছে।বাতাসের বেগ বাড়ছে। হিমালয় ছুঁয়ে আসা বাতাসে যেন চিনচিনে ঠান্ডার বেদনা।মধু বাবার প্রতীক্ষায় বসে থাকা চ্যালা ও ভক্তদের দিকে তাকালেন একপলক। মধুবাবার এই শীতল দৃষ্টিতে যেন আষাঢ়ে আকাশ।একজন এগিয়ে গিয়ে বললো বাবা সেবা নেবেন নামধুবাবা মাথা নেড়ে না বললেন। ঘরের দাওয়ায় পাতা আসনে গিয়ে বসলেন।সরোদে পরম ভালবাসায় ক্ষাণিক হাত বুলিয়ে টুং টাং করতে করতে মেঘমাল্লারের সুর বাজাতে বাজাতে মগ্নতায় গাইতে লাগলেন। বৃষ্টিবাতাসের জোর যত বাড়ছে ততই চড়ছে আলাপ বিস্তার।মধুবাবা যখনথামলেন সন্ধ্যাবাতির প্রস্তুতি চলছে। মগ্ন মধুবাবা মেঘমল্লারের সুরেই আওড়াতে লাগলেন মন্ত্র। নিউকোচবিহার যেন আষাঢ়ের এই বৃষ্টির সাথে মন্ত্রসুরে এক নতুনমাত্রায় ভাসচ্ছে।কেউ বা ছাতি মাথায় কেউ বা ভিজে আসচ্ছে। ঘন্টাধ্বনি মন্ত্রসুরে মিলেমিশে যেন আজ নতুন করে পাওয়া এক আধ্যাত্বিক সন্ধ্যা। যারা অন্যদিন এসে ছিলিম বানাতে বসে পড়ে আজ তারাও যেন কেমন নিথর।যেন পরজগতের মায়ার পাশে পলকে পলকে বন্ধী হয়ে উঠছে। এমন বর্ষা যেন এর আগে কেউকখনো দেখনি এমন বর্ষাসন্ধ্যা যেন আগে কখনো আসেনি এইখানেপরামার্থ যেন বৃষ্টিতে সঙ্গীতে মন্ত্রে উদভাসিত। যেন কোন জরা নেই এইখানে,জন্ম নেইমৃত্যুর তাই প্রশ্নই আসে না!