গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৪

দেবাশিস কোনার


অচেনা আগুন

রহমত আলির একটাই নেশা,সেটা হল ঘন ঘন চা পান করা আর চেনা বা অচেনা যেই হোক সবার সাথে সেধে আলাপ জমানো । তার মা এখনও বেঁচে আছেন , তিনি বলেন এমন নেশা নাকি তার বাপেরও ছিল । তার আব্বার নাম ছিল আকবর আলি ,লোকে তার ওই বিশেষ গুনের জন্য আলাপ আলি বলে ডাকতেন ।তাতে আব্বু রাগ করতেন না । উল্টে যারা তাকে আলাপ নামে ডাকতেন,তাদেরকে তিনি চা খাইয়ে বকশিস দিতেন । এখনও এই গঞ্জের মুরুব্বি যারা ,তারা তাকে আলাপের বেটা বলেই উল্লেখ করেন । রহমতও সে জন্য রাগরোশ করে না ।তার কাজ হল সকাল হলেই মোরের মাথায় এসে কাজলের চায়ের দোকানে বসা । এখন সকাল সাতটা । এর মধ্যেই সে তিন কাপ চা হজম করে ফেলেছে । রহমত এখন খড় কেনাবেচার ব্যবসা করে । এবার তাকে কাজের জায়গায় যেতে হবে । এই এলাকায় যত গ্রাম আছে প্রায় সব গ্রামের চাষিবাসি মানুষই তার পরিচিত । তার কথার দাম আছে । আব্বার কাছ থেকেই সে এই ব্যবসাটা শিখেছে । তিনি বলতেন , 'বেটা ব্যবসায় কথার দাম রাখাটাই আসল কাজ । এই কাজটা ঠিকমত করতে পারলেই দেখবি তোর ব্যবসা তড়তড় করে এগিয়ে যাবে ।রহমত নিজের অভিঙ্গতায় দেখেছে আব্বার বলা উপদেশ কতটা সত্য । মনে মনে সে আব্বাকে সালাম জানায় । তার দোয়ায় সে আজ করে কম্মে খাচ্ছে ।

আকাশে আজ ঘন মেঘের আনাগোনা । রহমত ভয় পায় । এখন যদি বৃষ্টি নামে তাহলে সর্ব্বনাশ । তার একদল লেবার গেছে নন্দপুরে খড় বাঁধতে । সেই খড় গাড়িতে লোড করার কথা ঠিক দুপুর তিনটেয় । বৃষ্টি হলে প্রথমত লেবাররা কাজ করতে পারবে না ।দ্বিতীয়ত বোঝা বাঁধা খড়ের ওজন বেড়ে যাবে । গৃহস্থ ভুল বুঝবে । ভাববে রহমত বুঝি বেশি খড় নিয়ে তাদের ঠকিয়েছে । তার যতটুকু নামডাক তার পিছনে সততার হাত আছে । যদি সেই সততা না থাকে তাহলে বিশ্বাসের ভিতটা নড়ে যাবে । রহমত তখন আর ব্যবসা করেখেতে পারবে না । সেজন্য সে এসব বিষয়ে খুব সচেতন ।
তার জীবনের একটাই দুঃখ , বোনটি পোলিও রোগাক্রান্ত । ওর পা দুটো দিনদিন যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে । অনেক চেষ্টা করেও রহমত রুকসানার পা দুটো ভালো করতে পারে নি । এখনো সে চেষ্টার কসুর করে না । যে যা বলে রহমত তাই করে ।কেউ হয়তো বলল কোন একজন ম্নত্রপুত তেল বানিয়ে দেয় , যা মালিশ করলে পা সোজা হয়ে যাবে । রহমত সেই তেল এনে দেয় , আম্মা সেই তেল নিয়মিত মালিশও করে দেয় । কিন্তু রুকসানার পা তাতেও দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে । কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না । বোনকে সে একটা তিন চাকা হাতে চালানো ভ্যান কিনে দিয়েছে । ফলে ঘরে চুপচাপ বসে থাকা থেকে সে রেহাই পেয়েছে । এখন মাঝে মাঝে সে এদিক সেদিক যেতে পারে । মেয়েটার মনের জোর আছে বটে । গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকে পাশ করার পর আম্মা বলেছিল আর ওকে পড়াবার দরকার নেই । রুকসানা কারো কথা শোনে নি ।তিন কিমি দূরের হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে  সে । রহমত আপত্তি করে নি । তবে আম্মার কথার অবাধ্য হয়ে রুকসানা হাই মাদ্রাসায় না পড়ে সাধারণ হাই স্কুলে জেদ ধরে ভর্তি হওয়ায় সে একটু বিরক্ত যে হয় নি , তা কিন্তু নয় । বোনের কথার যুক্তিতে সে হার মেনেছিল । রুকসানা বলেছিল , 'এখন পৃথিবীটা আর ছোট নয় ,মুসলিম জাহান নিয়ে দুনিয়া চলে না বড়ভাই । পড়তে হলে ভাল করে পড়াটাই উচিত । ওখানে সুযোগ এবং প্রতিযোগিতা দুটোই পাওয়া যাবে ' তাই রহমত আর কিছু বলে নি । ছোট বোনটার জন্য করতে পারে না এমন কাজ এই জগতে নেই । রুকসানা তার সাধের তিন চাকা গাড়িটাকে প্রচণ্ড যত্ন করে । নিয়ম করে ধুয়ে-মুছে সাফসুতরো করে সপ্তাহে এক দিন ।

এ বছর বড় পূজার আগেই ঈদ হয়ে গেছে । আর পূজার ঠিক পরেই কুরবানি ঈদ ।আর পূজার ঠিক পরেই কুরবানি ঈদ । রুকসানার মনে ভীষণ আনন্দ । ওর শরত কালটা খুব ভালো লাগে । বড় ভাই আর মা এদের দু'জনের উচ্চারণেই অনেক খামতি আছে । আসলে মুসলিম সমাজে বড় হওয়া মা কখনও বাড়ির বাইরে বের হয় নি । শুনে শুনে যা শিখেছে তাই বলে এসেছে । মা কে দোষ দিয়ে লাভ নেই ।বড় ভাই রহমত বাইরে ঘোরে বটে কিন্তু সেও বেশি দূর শিক্ষার আলো গ্রহণ করতে পারে নি । ফলে নিজে যতটুকু শিখেছে সবটাই শুনে এবং দেখে । পড়াশুনা করলে ঘাটতি থাকত না । বাড়িতে এই নিয়ে প্রায় প্রতিদিন মা-মেয়ে নয়তো ভাইবোনে তর্কাতর্কি হয় । শেষমেশ মা বা বড়ভাই তার কাছে হেরে যায় । হারলেও তারা গর্বিত হয় । কারন রুকসানা যে এত কিছু জেনেছে তাতে তাদের খুশি হওয়া ছাড়া উপায় কি !

                রহমত পাশের গ্রামে এক চাকুরীজীবী যুবককে তার বোনের কথা বলেছে । যুবকটি কোলকাতায় বড় চাকরি করে । রুকসানার জীবন সংগ্রামের কথা শুনে সে তো অবাক। স বলেছে শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা আছে । রুকসানার জন্য সে চেষ্টা করবে । তবে সেটা এখনই নয় । নন্দপুরের পাঁজা ফ্যামিলির নাম সকলেই জানে । ওরা খুব শিক্ষিত এবং পরোপকারি । মনে মনে সে তার প্রতিবন্ধী বোনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে । রুকসানা শারীরিক ভাবে অক্ষম তো কি হয়েছে ? সে শিক্ষায় , বিদ্যায় , ঞ্জানে ,বুদ্ধিতে একদিন সকলকে ছাপিয়ে যাবে ।

                রহমত কিছুতেই চায় না এখন বিয়ে করতে । কিন্তু বাড়িতে তার মা আর বাচাল বোনটি উঠেপড়ে লেগেছে তার বিয়ে দেবার জন্য । আয়েসা বলে একটি মেয়ে ইদানিং খুব আসাযাওয়া করছে তাদের বাড়ি । ওর আব্বা ইদ্রিশ চাচা । এই গ্রামেরই। তার আব্বার সাথে দহরম মহরম ছিল খুব । ছেলেবেলায় দুই বন্ধুতে নাকি বেয়াই পাতাবার কসম অবধি খেয়েছিল । কিন্তু সে সব বহুদিন আগের ঘটনা । তার আব্বা আজ বেঁচে নেই । সুতরাং কসম বা ওয়াদা যাই হোক , সেটা পূরণ করার দায় বা দায়িত্ব কোনটাই রহমতের ওপর বর্তায় না ।

                পোলিও একবার হয়ে গেলে সে রোগ নাকি সারে না । রুকসানা ওড়গ্রামে , গুশকরায় এমনকি বর্ধমান অবধি বহু ডাক্তারের সাথে আলোচনা করেছে । সকলেই বলেছে এ রোগ সারবার নয় তাই সে তার অক্ষমতাকে আর কোনভাবেই আড়াল করার চেষ্টা করে না । রুকসানা শুধু মন দিয়ে পড়াশুনা করে । ও বুঝে নিয়েছে শিক্ষাই তাকে দিতে পারে মুক্তি । আর সে চায় তার বড়ভাইটিবিয়ে-থা করে সংসারী হোক । তার জন্য যেন পরিবারের কারোর কোন সমস্যা না হয় । আয়েসা তার সমবয়সী । একসময় সে স্কুলে যেত । এখন আর যায় না । ওর আব্বা বলে দিয়েছে ,'মেয়ে মানুষের বেশি লেখাপড়া শেখার দরকার নেই ।বেচারা আয়েসা ! বিয়ে করে সংসার আর ছেলেপুলে মানুষ করাই ওর ভবিতব্য । অবশ্য তার অবস্থাও আয়েসার মতোই হত , যদি সে আর পাঁচটা গড়পড়তা মুসলিম মেয়েদের মতো স্বাভাবিক হত । রুকসানা মনে মনে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবে । খুশিতে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ।

                আয়েসা এখন যে কোন ছুতোয় ঘন ঘন তাদের বাড়ি আসে । রুকসানা ঘরে বসে একমনে পড়ছিল । সবে গৃহস্থের বাড়িতে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে । রহমত দিবানিদ্রা দিচ্ছে । মা এঁটো বাসন কোসন ধোয়ায় ব্যস্ত কলতলায় । ঠিক এসময়ে আয়েসা একবাটি কয়েত বেল বেশ জম্পেশ করে নুন , লঙ্কা ,তেল সহযোগে মেখে হাজির হয় রুকসানার ঘরে । ক'ত বেল খেতে রুকসানাভীষণ ভালোবাসে । হৈ হৈ করে ওঠে রুকসানা । বলে ,' তুমি আমার ভাবি হবার উপযুক্ত আয়েসা । আমি কি খেতে ভালোবাসি , কি পড়তে ভালোবাসিকোন গান আমার পচ্ছন্দ - সব তুমি জান আর খেয়াল রাখ । বড় ভাইকে বলে আমি আজই রাজি করাব ।'
                আয়েসা লজ্জ্বায় রাঙ্গা হয়ে বলে ,' আহা , আমি যেন সেজন্য তোমার কাছে এসেছি ? মরণ আর কি ! '
                'আচ্ছা বাবা আমার ঘাট হয়েছে । তবে তোমাকে ভাবি হিসাবে পেলে আমার যে কি উপকার হবে ,তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না । বলো না ,আমার বড়ভাইকে তোমার পচ্ছন্দ কি না ?'রুকসানা জটিল বিষয়টাকে হাল্কা করে দেয় ।
                আয়েসা আরও লজ্জা পেয়ে বলে , ' জানি না যাও ! তুমি না ভীষণ বদ !'
                রুকসানা সুযোগ পেয়ে আয়েসাকে জড়িয়ে ধরে ,তারপর চুমায় চুমায় ভরিয়ে দেয় । কাতুকুতু একদম সহ্য করতে পারে না আয়েসা । সে খিলখিল করে হেসে ওঠে । আম্মা এবং রহমত দু'জনেই ওদের উপস্থিতি টের পায়। মায়ের পশ্রয় আছে । রহমতের কাঁচা ঘুম ভাঙ্গানোর মাশুল গুনতে হল আয়েসাকে । ' কি হচ্ছেটা কি ? নিজে তো লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছ কবে ? এখন আমার বোনের পড়াটা নষ্ট করতে এসেছ ,না ?'

                কয়েকটা মুহুর্ত কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে আয়েসা । তারপর ঝরঝর করে তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরতে থাকে । রুকসানা বিহ্বলতা কাটিয়ে কি করবে ভেবে পায় না ? মা হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে আসে , বলে , ' এ আবার কি কথার ছিরি ? মেয়েটাকে শুধু শুধু কাঁদিয়ে ছাড়লি তো ? ' মাআয়েসার চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলে , ' ওর কথা ধরিস নে মা ! আমার ছেলেটা ওরকমই। কখন কাকে কোন কথাটা বলতে হয় ও জানেনা ।তবুও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে আয়েসা ।

                রুকসানা এই সময়ে হুইল চেয়ারে চেপে বাইরে আসে । রহমত তার পিছন পিছন যায় । সে এই ঘটনার আক্যসিকতায় বিমূঢ় । কোন বিপদে পরলে সে তার আদরের বোনকে বুনি বলে ডাকে । আজ সে তাই করল । ' বুনি এখন কি হবে ?মেয়েটা তো এখনও কাঁদছে ! ' আমি কি বলব ? তুমি এমন কাজ করবে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি । ' রুকসানা বিরক্তি প্রকাশ করে ।
                ' তুই একটা উপায় বের কর বুনি ! তোর তো অনেক বুদ্ধি ! মুখ কাঁচুমাচু করে বলে রহমত ।
                ' এখন কি উপায় বের করি বল তো বড়ভাই ?' অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবে রুকসানা ,তারপর বলে ,' উপায় একটা আছে । তবে সেটা তুমি মানতে পারবে কি না দেখ ?'
                ' বল না বুনি ! আমি তোকে কথা দিচ্ছি ,তুই যা বলবি তাই মানবো ! ' রহমত প্রবল আগ্রহে রুকসানার মুখের দিকে চেয়ে থাকে ।
                ' তুমি আয়েসার কাছে গিয়ে মাফি চাও ! ' রুকসানা বলে ।
                ' মাফি ! যাঃ , ওইটুকু মেয়ে , ওর কাছে আমি মাফ চাইবো ? ' রহমত বলে , ' তুই অন্য কিছু ভাব ?'
                ' দেখ বড়ভাই আমি যা ভাবার ভেবে নিয়েছি । তুমি যদি ক্ষমা না চাইতে পার চেয়ো না । আমি এখন আসছি । আয়েসার প্রতি তুমি খুব খারাপ ব্যবহার করেছ ।হুইল চেয়ারটা নিয়ে আবার রুকসানা নিজের ঘরে আসে ।আয়েসা কিছুটা ধাতস্ত হয়েছে । মা বলে ,' তোরা বসে গল্প কর ! আমি থালা বাসনগুলো তুলে রেখে আসি ! ' মা কাজে চলে যায় ।

                ' তোমাকে বলেছিলাম না আজকেই আমি বড়ভাইকে রাজি করাব , দেখ আমার কারসাজি ! ' রুকসানা যেন ভুলে গেছে কিছুক্ষন আগের ঘটনা । আয়েসা তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়ায় । আর ঠিক এই সময়ে রহমত এসে গলা ঝেড়ে বলে , ' রুকসানা ওকে বল , আমার ভুল হয়েছে । আমাকে যেন মাফ করে । 'রুকসানা তার গাড়িটা নিয়ে দ্রুত বের হয়ে আসে । সে রহমতকে বলে ,' অমন করে কি কেউ ক্ষমা চায় ? তুমি ঘরে যাও , গিয়ে যা বলার বল ! ' মা কলতলার কাজ শেষ করে রসুই ঘরে ছিল । সেদিকে এগিয়ে যায় রুকসানা। চিৎকার করে মাকে বলে , ' মা আজ খুশির দিন ।মিষ্টি মুখ করাও !ওদিকে রহমত আয়েসাকে বলে, ' আমার বুনিটা একটা পাগলি । ও যখন চাইছে তখন আমি তুমাকে শাদি করতে রাজী । আর আজকের ঘটনার জন্য সত্যি করেই ক্ষমা চাইছি ।
'
                আয়েসা বলে , ' তুমাকে অত কথা বলতে হবে না । আমি তুমার মুখ দেখেই বুজেছি তুমি কষ্ট পেয়েছ । আর রুকসানা আমার সাঙাত । ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসি । '

                রহমতের মতো ছেলে খুব কমই আছে । পেটে বিদ্যে একটু কম আছে বটে , কিন্তু তার মতো রোজগার এ তল্লাটে খুব কম জনই করে । নেশাভাঙ্গ করে না । স্বভাব চরিত্র ভাল । ইদ্রিশ চাচা এক কথায় রাজী ।