গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৪

তাপসকিরণ রায়


রমাকান্ত নামা--পাখি দি 


পাখিদি রমাকান্তর চেয়ে অনেক বড়--তা প্রায় বারো চোদ্দ বছরের হবে। পাখির সঙ্গে তাঁর একটা অন্য রকম সম্পর্ক ছিল। রমাকান্ত জানলা দিয়ে পাখি দেখতে ভালবাসতেন তখন রমাকান্তর কত হবে, এই বার তের বছর বয়েস !

একদিন একটা ফিঙে পাখির দেখা পেয়েছিলেন তিনি। পাখিটা তার লেজ নেড়ে কি সুন্দর শিস দিচ্ছিল ! কিন্তু হঠাৎ ফুরুত উড়ে গিয়ে ছিল। রমাকান্ত তারপর জানালার ওপরে উঠে অনেক উঁকি ঝুঁকি মেরেও ফিঙের দেখা পাননি। ঠিক এমনি সময় পাখি দি ঘরে ঢুকে যখন জানতে পেরেছিল রমাকান্তর ফিঙে পাখি উড়ে গিয়েছে তখন পাখি দিও জানলার কাছে এসে সেই পাখিকে খুঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু সে পাখি তখন অদৃশ্য হয়ে গেছে।  পাখি দি তখন চটুল হেসেছিল--সটান হাত দিয়ে ধরে ফেলেছিল রমাকান্তর পাখিটাকে আর রমাকান্ত নিজের দেহে এক ধরনের শিরশির ভাব অনুভব কর ছিল ! পাখি দির মুখে তখন রমাকান্ত দেখতে পেয়ে ছিলেন এক ধরনের দুষ্টু মিষ্টি হাসি। সে অনুভব তাঁর জীবনের এক অদ্ভুত অনুভব--গোপন অথচ ধারালো !

পাখির চেহারা মোটেও ভালো ছিল না। যেমনি মোটা বেঢপ তেমনি মিশমিশে কালো। তবে রমাকান্তর কাছে মনে হত--এত কিছুর পরেও কথাও দুষ্টু মিষ্টি একটা হাবভাব তার মধ্যে ছিল--দেহের কোথাও তো লাবন্য ছুঁয়ে ছিল তার। কিন্তু তাঁর মা ঠাকুমার কাছে কিন্তু তিনি  অন্য কথা শুনে ছেন,ওঁরা বলাবলি করতেন,পাখি দির কোনো দিন নাকি বিয়ে হবে না--কে এমনি মেয়েকে ঘরে বউ করে তুলবে ?
এহেন পাখিদির বিয়ের খবর যখন শুনেছিলেন রমাকান্ত যেন আকাশ থেকে পড়ে ছিলেন--পাখি দির বিয়ে--সত্যি? নিজের কানেই প্রশ্নটা বারবার  ফিরে এসেছিল। পাড়ায় তখন এটাই সবচে মুখরোচক খবর ছিল, পাখির বিয়ে ! যে শোনে সেই আশ্চর্য হয়ে যায়--তার ওপর আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, প্রেমের বিয়ে !
রমাকান্ত ভারি আশ্চর্য হয়ে ছিলেন--পাখি দি আবার কাকে, কবে ভালো বসলো ! আর যদি বেসেই থাকে তবে তার এত কাছের রমাকান্তকে তা বলে নি ? এমনটা যেন ভাবতেই পারেন নি তিনি। মনটা বড় উসখুস করছিল--তখন তিনি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছেন, কলেজে আসার পর একটা বছর কি ভাবে যে হওয়ায় উড়ে গেল--বলতে গেলে পাখি দির কথা তাঁর মনেই পড়েনি। ইতিমধ্যে তিনি কত যে রঙিন চিড়িয়ার দেখা পেয়েছেন, সময় যেন তার রঙিন ডানা নিয়ে উড়ে বেড়িয়েছে আই বাস ! এমনি অবস্থা,ওরাও পাখি বটে, ছোটবেলার লাল ফ্রক পরা মেয়েটাকে তিনি কখনো তেমন ভাবে দেখেন নি। কিন্তু বয়েস খুলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে চোখের রংও একনি রঙিন হয়ে যায় কে জানত ! রঙ ফানুসের জীবনের একটা বছর কি ভাবে যেন ফুরিয়ে গিয়ে ছিল !

এর মধ্যে একদিন হলুদ রঙা ডানাকাটা এক পরীর হাত ধরে তিনি বলে ফেলেছিলেন, আই লাভ ! ভালবাসার ভনিতা দরকার--ঝাঁ করে কারো হাত ধরে ফেলা যায় নাহঠাৎ কিনা পাখি ধরে ফেলেছিলেন ! তাও রমাকান্তর মত ছেলে। একটা তর-তাজা মেয়ের হাত টেনে হঠাৎ ভালো বাসার কথা বলা যায় না--তবু বলে ফেলেছিলেন তিনি। আর মানসিকতা তাঁর মনে জন্ম নিয়ে ছিল পাখি দির সান্নিধ্যে না হলে মেয়েদের পরিবেশ তিনি বুঝতে পারেন নি কেন ! তার মনে কি তা হলে ভালবাসা ছিল না ! আনমনে হলেও দৈহিক ক্ষুধা তাঁর মনে ভিতরে ভিতরে নিপীড়িত করছিল !

মঝে মাঝে রাতের দুর্বলতায় রমাকান্তর বলতে ইচ্ছা হত, পাখি দি তুমি কোথায় গো ! আমি তোমাকে ভালবাসি--তোমার দুষ্টু-মিষ্টি গালটা আমার টিপে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দিনের আলোকে তিনি বুঝতে পারতেন, সেটা সম্ভব নয়--কোনো ভাবেই মানিয়ে নেবার নয় ! এমনি রমাকান্তর  কত রাতে যে মন ভিজে যেত !

প্রায় বছর ঘুরে গেছে, পাখি দি আসে না--রমাকান্তর কলেজের নেশা, রং পাখির নেশা, অনেক কিছুই ভুলিয়ে দিয়ে ছিল। 
এক বছর পার করে হঠৎ এক দিন পাখি দির আগমন ঘটে ছিল। তখন যথারীতি রমাকান্ত তাঁর পড়ার চেয়ারে বসে আছেন। পাখি দি সটান ভিতরের ঘরে ঢুকে গেল। সেখান থেকে এসে তাঁর ঘরে ঢুকলো। হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলে উঠলো, কি রে পড়াশোনায় ব্যস্ত আছিস ?
রমাকান্ত উদগ্রীব হয়ে বসেছিলেন, বলে ছিলেন, না, না, বল, কি বলবে তুমি ?
--তোর সঙ্গে একটা কথা আছে--
--বলো না কি কথা ?
পাখি রমার কাছে এসে ঘেঁষে দাঁড়ালো--বেশ সাজগোজ করেছে--ঠোঁটে লাল লিপস্টিকের পুরু প্রলেপ--আর সেই পারফিউমের করা গন্ধ ভুর ভুর করে তার গা থেকে বেরিয়ে আসছিল। রমাকান্তর নেশার মত লাগছিল। তিনি পাখির আরও কাছ ঘেঁষে এসে বলে ছিলেন, তোমাকে না খুব খুব--
এই ছেলে ওসব না--দুরে সরে দাঁড়া বলে দিচ্ছি--নিজেই সামান্য দুরে সরে গিয়ে ছিল পাখি। 
--কি হয়েছে তোমার ! রমাকান্ত বিভোর স্বর নিয়ে বলে উঠে ছিল। 
--জানিস আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে--
--এঁয়া ,সত্যি ?
--হ্যাঁ রে ওই গুন্ডা মত ছেলেটা--তুই তো দেখেছিস--ওই যে রে বিশু--পরামানিক। ওই যে সেদিন তুই আমায় ঘরে পৌঁছে দিলি--আর তিনটা ষন্ডাগুন্ডা মার্কা ছেলে আমাদের পিছু নিল--ওরা যা তা কথা বলছিল--
--ওই বাজে ছেলেগুলো  ?
--না রে--বাজের মধ্যে ভালো ছিল ওই--বিশু--ওর সঙ্গে আমার প্রেম হয়ে গেছে রে !
--বলো কি--কি করে ?
--এই একটা বছর ধরে আমার সঙ্গে ঘুরেছে--আমায় বিয়ে করবে কথা দিয়েছে। 
--ওদের কথার ঠিক আছে?
না-- কথা বলিস না--বিশুর মন আছে--না হলে আমার মত মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায় ! একদিন তোকে ওর সাথে মিলিয়ে দেব। 
--না না আমি যাব নাকি ভাবে যেন রমার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলোও প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো, ওই লোকটাই তো আমায় যা নয় তাই বলে ছিল !

এবার পাখি নরম হল--রমাকান্তর মাথায় হাত রাখল--শোন রামু, তোকে আমার কথা শুনতে হবে--
রমাকান্ত না না না, বলে বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। তা দেখে পাখি তাঁকে একেবারে জড়িয়ে ধরে চুক চুক করে কিস খেতে খেতে বলেছিল, লক্ষ্মী সোনা, আমার কথা শুনতে হয়। কয়েক মুহূর্তে রমাকান্ত শান্ত হয়ে যান। তার উতলা ভাবনাগুলি গুটিসুটি মেরে যেন এক জাগায় কেন্দ্রীভূত হয়ে যেতে থাকে। তিনি চুপচাপ থেকে আচমকা পাখি দির ঠোঁটে চুমু দিয়ে বসেন।