গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৪

মুজিবুর রহমান / দোলনচাঁপা ধর



দশেরপুত
    
লাউপেটু ছেলেটার পরনে কিছুই নেই। শুধুমাত্র কোমরের ঘুনচিতে দুটো ঘুঙুর বাঁধা। বয়স পাঁচ হবে হয়তো। গোল নায়ের মতো পেটখানা সামনে পেছনের দিকে হাত দুটো নবাবি কায়দায় যেন ওর গতরের বৈঠা ধরল।অচেনা কাউকে দেখলে চাঁদ চিলতে হেসে চার আঙুলে কপাল মেপে জানাবে আত্তালামু আলাইকুম।

ওকে প্রায়ই স্কুলের পাশে,সেতুর কাছে  , মাঠে দেখা যায়। নানার বাড়ি ওর জন্য স্বীকৃত । দাদা বাড়ির পরিচয় দেওয়ার উপায় কিংবা অধিকার কয়েক কানি জমির দলিলে চাপা পড়ে আছে। ওর বয়েসি ছেলেরা বগলে আরবি বর্ণমালার বইটা চেপে, বাবার ঝুলো টুপিটায় কপাল-চোখ ঢেকে ছোট্ট লুঙ্গি পেচিয়ে, নাকে সর্দি টেনে টেনে মসজিদে যায়। কেউ কেউ বাড়ি থেকে মসজিদে আসার মাঝ পথে পস্রাব করে এবং ঢিলার ধার না ধেরে মসজিদেও এসেও কফোঁটা ঝরিয়ে দেয়। তাতে কিছু আসবে যাবে না। কিন্তু ওর মসজিদে আসা নিষেধ।

কেউ যদি প্রশ্ন করে
     -      এই তর বাপের নাম কি?
     -      বাপ মইরা গেছে .
     -      মইরা গেছে ভালা কথাম কিন্তুক তর বাপের নাম কি আছিল?
     -     বাপ মইরা গেছে।

 বাবার নাম জানা নেই। জানার কথাও নয়। নানী শিখিয়ে দিয়েছে কেউ জিজ্ঞেস করলে কইবি বাপ মইরা গেছে।

ছেলেটার বাবার নাম কি ছিল কিংবা কে হতে পারতো, বেঁচে আছে কি মরে গেছে এসব যারা খুব ভালো করে জানে তারাই  ওকে বেশি বেশি প্রশ্ন করে তর বাপের নাম কি? ওরা মজা পায় খুব মজা।

ওর বাবা মা ওর জন্মের বীজ বপন করে ছিল কাজীর সাথে কলমা পড়ে কবুল না বলেই। রেজিষ্ট্রারে ওর বাবার নাম লিখা নেই কিন্তু ওর শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে, রন্ধ্রে বীজ বর্র্ণে লিখা বাবার নাম আতাউর। বর্ষাধোয়া কদম ফুলের মতো ফুটফুটো কিশোরী ছিল মোহনা। মোহনার পেটে ছেলেটার ভ্রুণ বয়স যখন  তিন মাস পেরোল তখন ব্যাপারটা পুরো গ্রাম জানাজানি হয়। গ্রামে মোহনার ব্যাপারটা ছোট খাটো বিনোদনের পর্যায়ে পৌছায়। এ পাড়া ও পাড়া থেকে মহিলা কিশোরী তরুণী  এমনকি ছেলে বুড়ো সবাই আসে দেখতে।

ঘটনার প্রথম থেকেই জানতো আতাউরের মা। আতউরের বাবা রহমত মোল্লা  হুজুর মানুষ ,তাঁকে জানানো দরকার মনে করেনি মা। ছেলেকেও তেমন ভাবে শাসন করেনি। ঘটনার নায়ক হয়ে যখন আতাউরের নাম বলল মোহনা তখন রহমত মোল্লা গর্জে উঠল। আতাউরের মা বলল-
খবিসের কথা আগেই জানমতাম তুমারে কই নাই। ঘটনা এরম হইবো কেড জানতো।
রহমত মোল্লা  ধমকাল

চুপ, এক্কবারে চুপ! মাইয়া মানুষ শয়তানের দড়ি, গলায়তো আল্লায়  হাড্ডি দেয় নাই। এ কথা স্বীকার  করন যাইবো না। পোলারে না কইরা দিবা, যা দেখবার আমি দেখতাছি।
রহমত মোল্লা  গ্রামের অনেক কিছুই দেখেছে।  এরকম ঘটনা গ্রামে আরো একটা ঘটেছিল। রহমত মোল্লার পরিষ্কার ফায়সালা একশ একটা দোররা ছেলে মেয়ে দুজন কেই।

মোহনা মেয়েটা বোকা, বেভুলো বেহুশ। কৈশরিক প্রেমে আরন্যিক মুগ্ধতায় ডুবে ছিল। হাওয়াখোলা পালের মতো উড়িয়ে দিয়েছে নিজেকে। কিন্তু  আতাউর! দূর গাড়িয়াল ভাইয়ের গানের মতো ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে গেল।

সালিশ। গ্রামের মাতাব্বর জড়ো হল। রহমত মোল্লা  হুজুর মানুষ সম্মানিত লোক। তাঁর ছেলে নিয়ে দরবার। তো কি হল? হুজুর সাহেব ফতোয়া ঝাড়ল একশ একটা দোররা, শুধু মাইয়ারে।

মাতাব্বররা বলল পোলারে কি দোষ মাইয়া মানুষ হইল আগুন, আগুনের কাছে মোম আইলে তো গলবেই। তো যাই হোক মামলা মোকদ্দমা করার দরকার নাই গ্রামের ইজ্জত যাইবে। তার চেয়ে ভালা হুজুর সাব মাইয়ারে দুই কানি ধানি জমি দলিল কইরা দেউক এডাই দরবার বিবেচনা করলা।

মোহনাকে দোররা মারা হচ্ছে। কচকচে কালচে সবুজ ধান গুচ্ছের মতো চুলে সুতাবুড়ির সুতা জড়িয়ে যে মেয়েটা মুকুট বানাতো সে মেয়েটার মাথাটা খুব নিচু। যেন সুতাবুড়ির পুরো আকাশটাই ওর মাথায় ভর করে আছে। পান খাওয়া খয়েরি প্রলেপ পরা দাঁতে খিলাল খুঁচিয়ে খাদ্যকণা বের করছে এইমাত্র রহমত মল্লার  বাড়ি থেকে ভোজ ফেরত মাতাব্বররা।

শ্যাওলাটা পুকুর পাঁপড়ি ফাঁসা পালকের জল ছঁই না ছুঁই নৌকার উড়ে যাওয়ার মতো সময় গুলো চলে গেল।

মোহনা কি সুখে আছে? ঢাকায় কোন গার্মেন্টস কারখানায় কোন ছেলের সাথে ভাব জমিয়ে বিয়ে করেছে। রোজ রোজ মার খায়। নিজের জীবনের একচ্ছত্র অধিপতি কেউ কখনো হতে পেরেছ? কিছু ভুল, স্বার্থরসা মানুষ, প্রথার কাছি, ধর্মের সিসাগলা কঠিন বাঁধন ইত্যাদি জীবনটার অনেক কিছুই কেড়ে নেয়।

ওই ন্যাংটা পুটো ছেলেটা বেড়ে উঠেছে। ডিগডিগে বাঁশের ছিলকের উপর রোদ বৃষ্টি ছলকে পড়ার মতো ওর জীবনে দুঃখ কষ্ট পিছলে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। গ্রামের ছেলেরা ওকে ডাকে দশেরপুত। ছেলেটা চেয়ে দেখে বাবারা হাট থেকে মুরালির পুটলি নিয়ে এসে সন্তানদের  দেয়, মায়েরা ছেলেদের  গতর ধুয়ে দেয়। আদিখ্যেপণা করে ওর বয়েসিরা শুধুই বলে পেট ব্যাথা করতাহে আম্মা।
 তবে পরশকাতর মাকড়শার জালে কফোঁটা শিশির জমে যাওয়ার মতো ওর জীবনেও কিছু আনন্দ  আছে। ওর সময় কাটে অপার আকাশ দেখে। পিঁপড়ের সারি আর পাখির বাসা গুণতে গুণতে। হুটপাট ঝড় আর ছুটছাট মেঘ নিয়ে দুয়ারে বেশেখ এলে ছেলেটা বৈশাখী বৃষ্টিতে শিলদাগা আম কুড়োয়।

     -     এই ছেরা কই যাইতাছস? এত দৌড়াছ ক্যান?
     -     পইড়া ব্যাথা পাবি।
     -     নানী রহমত মোল্লা  ফুলু বাউলার চুল কাটতাছে দেইখ্যা আহি।
     -     হুইন্যা যা, তর লাইগা নতুন হাফপেন্ট আনছি, পইরা যা।

হাফপ্যান্ট পেয়ে দৌড় দিল ফুল বাউলার চুল কাটা দেখতে। দৌড়ে দৌড়ে ওর ঘুঙুর দুটো বাজছে।
আচ্ছা ছেলেটার নাম যেন কি ? নাম জেনে কী হবে? বরং আপনিই একটা নাম রেখে দিন না। আর বাবার নাম? রেজিস্টারে লিখা নেই, দুই কানি জমির দলিলে সে ঝামেলা চুকে গেছে। তাছাড়া গ্রামের ছেলেরা তো বলেই দশেরপুত। 



দোলনচাঁপা ধর

মৎস্যমুখী


তুষ্টু দিনের বেলা ভ্যান চালায় তবে সে টাকায় ওর সংসার চলে না, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ভ্যান টেনে যা পায় তা দিয়ে সন্ধ্যেটা একটু নিজের মত করে বাঁচে লখিম শুঁড়ির ঠেকে। তরলের গুণে তখন মনটাও নরম হয় তুষ্টুর, মনে আসে বাড়িতে মাগ ছেলেতে মিলে পাক্কা চারজনের একখানা আস্ত সংসার আছে তার আর তাদের খাইয়ে পরিয়ে রাখার ভারও তারই। ধুস্‌ সকালবেলা বেরনোর সময় কিছুতেই এসব কথা মনে আসে না তারআসবেই বা কি করে? তখন কি এই তরল অমৃত পেটে পড়ে যে সুবুদ্ধি খুলবে? তাই ঠেক থেকে উঠেই বাড়ি ছোটে আর হাত ছিপখানা নিয়ে সোজা বড় দীঘিতে।

এ দিঘী চাটুজ্জেদের আর বহুপ্রাচীন,তাদেরই টাকায় নায়েব বছর বছর পোনা ছাড়ে ঠিকই কিন্তু দেখভালের তেমন ব্যবস্থা নেই পাশের পুকুরটি স্বয়ং নায়েবের অর্থাৎ কিনা বাবুদের খিদমৎ করে পাওয়া। চাটুজ্জেরা আর এদিকে বড় আসে না, ওই বছরে দুবছরে কখনো, তাই নায়েবকে খুশী রাখতেই পুকুরটি দেওয়া নায়েব ও দিব্যি মোহন কেটে রেখেছে দীঘির সাথে, বরষায় দীঘির মাছ এসে পড়বে পুকুরে, পোনা ছাড়ার আলাদা খরচ নেই উল্টে মালিকের টাকায় সারাবছর মাছ-ভাতের সুরাহা।

মেছো নামে খুব খ্যাতি তুষ্টুর, সে বসলে আধ ঘণ্টায় পাঁচ সাতশ মাছ কোন ব্যাপার না, তাই মানুষ আগাম দিয়ে রাখে একখানা দেশী মদের দাম। তার বেশী তুষ্টু চায়ও না তাতে বরাতে থাকলে মক্কেল ভাল দাঁও মারে আবার কোনোদিন কিচ্ছু না, লটারির মত। তবু মানুষ দেয় কারণ তুষ্টুর উপর মানুষের ভরসা খুব।এক এক দিন গন থাকলে মাছ ওঠে ভাল, অবশ্য তাতে তুষ্টুর কিছু না যা লাভ মক্কেলের, মালতী মাঝে মাঝেই বলে মাছ অনুযায়ী দাম চাইতে, কিন্তু তাকে বোঝানো যায় না ওই লটারির আশাতেই মানুষ টাকা দেয়, মাছের দামে মাছ তো বাজার থেকেই নিতে পারে, তুষ্টুকে পুছবে কেন?


তুষ্টুর এই ছিপ ফেলার কথা তলে তলে জানে সবাই কিন্তু স্বীকার করে না কেউইস্বীকার করলে খামোখা কথার ভাগী হওয়াদিনের বেলা বুকে পাথর চাপা দিয়ে কেউ কেউ বলে ঠিকই নেশা ছাড়ার কথা কিন্তু অন্তরে ভাবে নেশার টানেই এই মাছ শিকারনেশা ছেড়ে গেলে ভ্যান চালিয়েই সংসার চলবে দিব্যি এমন লাভজনক লটারি বন্ধ হয়ে যাবে। নায়েব রোজই শাসায়- তুষ্টু খবর্দারব্রাহ্মণের সম্পত্তি মেরে খাস নেশাপ লাগবেনরকে পচবি।তুষ্টু মুচকি হেসে উত্তর দেয়-- নায়েব পারলে হাতেনাতে ধরুক।মুচকি হাসির কারণ নায়েবের আফিম সেবনের অভ্যাস সন্ধ্যেবেলাসে সময় ডাকাত পড়লেও তার বেরনোর সাধ্যি নেই তো মাছ চুরি ঠেকাবে কি করে।অতএব তুষ্টু নির্বিবাদে সান্ধ্য-অভিযান চালিয়ে যায়মক্কেলদের হাতে তুলে দেয় তাজা মাছ। 
              
মাছের টাকাটা অপরাধীর মত এসে দেয় মালতীর হাতেখুশী হওয়া দূরে থাক মুখ ঝামটাই মেলে রোজ। রোজগারের টাকায় মদ গিলে আর মদের টাকায় ছেলেমেয়ের মুখে ভাত দিতে আর সত্যিই লজ্জা করে না তারআগে আগে অনেক বলেছে যে এও তো রোজগারেরই টাকাতা মালতী মানে না। রোজ রোজ মাছ ধরে পরকে দেয়কোনোদিনও নিজের সন্তানের মুখে মাছ তুলে দিতে ইচ্ছা করে না এমন মাতালপাষাণ বাপ সেতাই কাল রাতে মোহনের মুখে আন্নে পেতে রেখে এসেছিল। ছিপে যা উঠবে তা কথামত দিতে হবে মক্কেলকে কিন্তু আন্নের মাছ তারআজ ঠিক সে বাড়িতে মাছ নিয়ে যাবে। পাড় থেকে মক্কেলকে বিদায় করে একটু সময় নেয় সে তারপর আন্নে তুলে দেখে এইসা এক কুঁচে মাছ পড়েছে ফাঁদেকুঁচে মাছে রক্ত হয় খুব। মাছটার মাপ দেখতে নেশার ঘোরে আন্নের ভেতর হাত দিতেই মাছ সাপ হয়ে দিল ছোবলআর মিলিয়ে যাওয়া আকাশের তারা দেখতে দেখতে তুষ্টুর মনে হল – ওদের কপালে আর মাছ নেই।