ফোবিয়া
তোদের অবস্থা কি রে! এতদিন হলো বিয়ে করেছিস, বাচ্চাকাচ্চা নিচ্ছিস না কেন? কণার বক্তব্য শুনে ফোন কাঁপিয়ে ঠা ঠা করে হেসে ওঠে বাবুল । এমনিতেও অবিরাম হাসে ও, মানে হাসিখুশি মানুষ আর কি । কিন্তু আজকের এই হাসিটা কণার বুক হিম করে দিলো, বাবুল অপ্রকিতিস্থের মত হাসছে । এই বাবুল, কি হয়েছে তোর? ভর দুপুরে নেশা করেছিস নাকি? উত্তরে আরো বিকট শব্দে সে হাসতে থাকে । তারপরই কুটুস করে লাইনটা কেটে গেলো । হতভম্ব কণা আধাখাওয়া ভাত রেখে উঠে পড়ে । হাতটা ধুয়ে কল করে বাবুলের নাম্বারে, হতভাগা মোবাইল বন্ধ করে দিয়েছে ।এটা কেমন হলো? মাত্র দুপুরের খাবারটা নিয়ে বসেছিলো সে, বাচ্চাকে খাইয়ে । বশির অফিসে, ছুটির দিন ছাড়া একসাথে খাওয়া হয়না ওদের, একা একা খেতে ভালো লাগে না । মা কে সব গুটিয়ে রান্নাঘরে যেতে দেখে রিশাদ অবাক হলো না মোটেই । মা প্রায়ই এই কাজটা করে, চুড়ান্ত অনীহা নিয়ে কিছু মুখে দেবে তারপর সব গুছিয়ে রান্নাঘরে । কিন্তু কণা তখন অন্য ভাবনায়, বাবুলের সাথে যোগাযোগ নেই তিন চার মাস, হঠাৎ ফোন দিয়ে অদ্ভুত সব কথা, ---জানি জানি সব জানি!
-কি জানিস!
-আমার খবর রাখো? একটা ফোনও তো দাও না ।
-আচ্ছা, আমি সময়টা কখন পাই?
-আমি যেন কত পাই! অফিস থেকে ট্রেনিংয়ে এসেছি ।
-বৌ কে সাথে এনেছিস?
-নাহ ।
-কেন রে? তুই তো লিপিকে ছেড়ে এক মূহুর্ত থাকতে পারিস না । তারপর বাচ্চার প্রসংগ তুলতেই ওই অদ্ভুতুড়ে হাসি ।
বাবুল ছেলেবেলা থেকেই অদ্ভুত । ও সমবয়সী কোন ছেলের সাথে খেলতো না, আসলে কোন ছেলের সাথেই দোস্তি ছিলো না ওর । বাবুল খেলতো মেয়েদের সাথে, সেইসব মেয়েরা আবার ওর চাইতে ঢের বড় । সবাই আহ্লাদ করে তার গাল টিপে দিয়ে দিয়ে বুঝি ওর মাথাটা খেয়েছিলো । যুবা বয়সে আসতে আসতে দেখা গেলো ছেলেটা বড় আপুদের পাশে ছায়ার মত ঘুরছে, কখনও তাদের শপিং ব্যাগ হাতে, কখনো বয়ফ্রেণ্ডদের কাছে চিঠি আদান প্রদানের পিয়ন । কেউ মুচকি হাসতো, কেউ বলতো আদিখ্যেতা, কেউ কেউ সতর্কবানী শোনাতো, অনেকেই বলতো ‘এই লেজ ঝোলা ন্যাওটাটাকে এত লাই দিস না ছেমড়িরা ।‘ ওকে বকা দিয়েও কাজ হতো না, অভিমান করে খাওয়া ছাড়তো । কি অশান্তি! অত বড় ছেলে রাতে ঘুমাতো মায়ের সাথে । আলাদা রুমে শুতে দিলে মাঝরাত্তির পার হওয়ার আগেই কেলেংকারী, বাবুল সারা ঘর জাগিয়ে দিতো ভয়ার্ত চিৎকারে, হতভাগা বিছানা ভিজিয়ে বসে আছে, চোখ লাল, কাঁপছে থরথর করে, যেন কোন দেও দানোর খপ্পরে পড়ে নাজেহাল । কেউ বললো জ্বিনের আছর, কেউ বললো ডাক্তার দেখাও । বাবুলের মা দুটোই করলেন, প্রথমে ডাক্তার দেখালেন, তারপর হুজুরের কাছে নিয়ে গেলেন । ডাক্তার দেখেশুনে পাঠিয়ে দিলেন একজন বড় মনোরোগ বিশারদের কাছে, আর হুজুর দিলেন ঝাঁড়ফুক, পানি পড়া । স্কুল ফাইনাল শেষ করেছে সে অথচ তার বন্ধুতালিকায় কোন ছেলে নেই । সমবয়সি মেয়েরাও নেই । বাবুল মায়ের কাছে ঘুমাবে, বাবা মায়ের সাথে না, বাবার সাথে কোনভাবেই নয় । বিচিত্র কারণে সে তার বাবাকে ভয় পায় এবং এড়িয়ে চলে । কিন্তু ওর বাবা মোটেই ভয়ংকর নন, নেহায়েত এক সাদাসিধে মানুষ । ডাঃ তণ্ময় বর্মা বেশ বড় সাইকিয়াট্রিস্ট, রোগীর কেস হিস্ট্রি শুনে গম্ভীর হলেন তিনি । ‘অ্যান্ড্রোফোবিয়া' এরকম কি একটা মনোরোগ, বাবুলের দীর্ঘ চিকিৎসা শুরু হলো । অষুধ, কাউন্সেলিং, পারিবারিক সহমর্মিতা । অনেকটা সময় লেগেছিলো ওর সেরে উঠতে । পাড়ার সব বড় আপুরা অবিরাম সহযোগিতা করেছে । একসময় ভিন্ন চিত্রগুলি দেখা যায়, বাবুল পাড়ার ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলছে নয়তো ফুটবল । অনেক বন্ধু হয়েছে তার কলেজে, কখনো তাকে মহিলা কলেজ গেটেও দেখা যেতে থাকে ।
সময়ের সাথে বয়স বাড়ে, জীবনের মানচিত্র বদলায় । এই যেমন কণা আজ ঘোর সংসারী, তার বন্ধুরা পুর্ব পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়েছে । সবার সাথে যোগাযোগও নেই, কারো কারো সাথে কালেভদ্রে ফোনে কথা হয়, কেউ ফেসবুক কিংবা স্কাই পে খুলে গল্পসল্প করে । সেই সময়টায় ভারী ভালো লাগে কণার । আহ বেঁচে আছি, যে যেখানেই থাকি আছি তো, দিনগুলো নেই, স্মৃতি হারায়নি! ব্যতিক্রম হচ্ছে বাবুল, ওর কাজ নিয়মিত সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা । এই যখন বছর দুই আগে ও বিয়ে করলো, কাছাকাছি যত বড় আপুরা আছে সবাইকে সেই বিয়েতে হাজির হতে হয়েছে । এত ব্যাস্ততার পরেও কণার উপায় ছিলো না, বাবুলের অভিমান দেখে তিনদিনের জন্য খুলনা যেতেই হলো । লিপি কে দেখে খুশি সে, বাবুল চমৎকার বৌ পেয়েছে । দুজনে একই এন জি ও তে চাকরি করে । কিন্তু বাবুলের আজকের এই হাসিটা! ভয় ধরানো এক অতীত মনে করিয়ে দেয় । খানিক ভেবে লিপির নাম্বারে ডায়াল করলো কণা ।
আশ্বিন কার্তিকের ঘ্রাণটা শহরে বসে বোঝা যায় না, কিছু প্রাকৃতিক পরিবর্তন চোখে পড়ে বটে । রশিদ পাটোয়ারীর এঁদো পুকুর দুইটায় আফ্রিকান মাগুরের চাষ হয়, কি সব বর্জ্য ঢালে ওরা পুকুরে! সাথে শ্যাওলা পচা গণ্ধ, বাতাস দুষিত হয়ে ওঠে । কণা ভাবছিলো লিপির কথাগুলো, সে জানতই না বাবুল আর লিপির ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে দুইমাস আগেই । একটু চমকেছিলো বটে ।
-কেন এমন হলো লিপি? বাবুল তো খুব ভদ্র ছেলে!
-হ্যাঁ আপা বিয়ের ছমাসের মধ্যে শ্বাশুড়ি আলাদা করে দিলেন আমাদের, আমি চাকরি কেন ছাড়ছি না, সংসারী নই, তাদের সেবা করি না ।
-সেটা তো এক অর্থে ভালোই হয়েছিলো! নিজের ঘর নিজে গোছাতে পেরেছো ।
-ভালো হয়নি আপু, বাবুল ওর মা কে ছেড়ে আসতে চায় নি । অনেক অনুনয় আর কান্নাকাটিও করেছে । কাজ হয়নি ।
-এসব নিয়ে কি বাবুল তোমার সাথে ঝগড়া লাগাতো?
-না সে আমার মধ্যে মা কে খুঁজতো । কণা একটু থতমত খায়, ‘তা সব পুরুষরাই স্ত্রীর মধ্যে কম বেশী মাতৃসত্বা খোঁজে ।‘ ‘সেরকম নয় আপু,’ লিপি ইতস্তত করতে থাকে । বলো, কণা তাগাদা দেয় । ‘ও আমাকে মাতৃমুর্তি বানিয়ে ফেলেছিলো, শারীরিক ভাবেও কাছে আসতো না,’ যেনো লজ্জার মাথা খেয়েই কথাগুলি বলে সে ।
হতবুদ্ধি হয়ে বসে থাকে কণা । লিপির আর্তনাদের মত কথাগুলি প্রতিধ্বনির মত ভাসতে থাকে । এখন কি হবে? কণা ভাবে, বাবুলের পাশে আজ কেউ নেই ওর চিকিৎসা করাবার, ও দিব্যি আয় রোজগার করবে, খুব ফুর্তি করে সিনেমার টিকেট কিনে আনবে, নানা পার্বণে সবার জন্য কেনাকাটা করবে, নিজের কষ্টটা বুঝবে কিন্তু অসুখটা বুঝতে পারবে না । বাবুল নিজের অন্তর্জগতকে কখনই বুঝতে পারতো না, সেখানে সে চিরকালের শিশু ।