গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৪

অনিন্দিতা সাধুখান


বিসর্জন


এবারে পূজোতে এখনো পর্যন্ত একটা জামা কেনা হয়নি পূর্ণিমার।আর কদিনের মধ্যে পূজোর ছুটি পড়ে যাবে।ইতিমধ্যে ক্লাসে সব বন্ধুদের গল্পের একমাত্র বিষয় পূজো এবং পূজো কাটানোর বিভিন্ন পরিকল্পনা,জামার রঙ এবং আধুনিক ফ্যাশন-পূর্ণিমা এই সব আলোচনা যোগ দিতে পারেনা।তার বুকের মধ্যে এক অব্যক্ত যন্ত্রণাকে চেপে সে বন্ধুদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে অসম্ভব মেধাবী হওয়াতে সে প্রতিবছর পরীক্ষায়ে প্রথম হয় তাই তাকে বন্ধুরা অবজ্ঞা করতে পারেনা ঠিক,তবু এই হাল ফ্যাশানের ডিজাইন সম্পর্কে আলোচনায়ে কিংবা ছুটিতে কে কোথায়ে বেড়াতে যাবে তার পরিকল্পনায়ে পূর্ণিমা নির্লিপ্ততায়ে বন্ধুরা তাকে অনুকম্পার নজরে দেখে।মধুরার এবারে এখুনও পর্যন্ত ১৩ টা জামা হয়েছে এবং মামার বাড়ি থেকে আরও ৩-৪ তো আসবই। সে বেশ উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করছিল সে কথা সুজাতারা এবারে দক্ষিণভারত বেড়াতে যাবে সে নিয়ে ও আলোচনা।অন্যান্য বন্ধুরা পূজোতে কে কি করবে তার পরিকল্পনা করছিল,ঠিক তখনই দিদিমণি ক্লাসে ঢুকলেন।পূর্ণিমা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।এসব আলোচনা তার ভালো লাগেনা ভীষণ ভীষণ কষ্ট হয়।তার বাবা যে জুটমিলে কাজ করতো শ্রমিকেরা বোনাসের দাবিতে আন্দোলন করায়ে মালিক পক্ষ কারখানার গেটে তালা বন্ধ করে দিয়েছে সুতরাং এখন পেটের ভাত কিভাবে জোগাড় হবে তারই কোন ঠিকঠিকানা নেই।স্কুলের ছুটির পরে বাড়ি আসে পূর্ণিমা।সন্ধ্যার সময়ে পূর্ণিমা বলে,বাবা তোমাদের মিল কবে খুলবে? বাবা বলে, জানিনা মা,এ কথা বলেই বিমলবাবুর বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে।তারপর স্বস্নেহে বলেন,আজ সন্ধ্যায়ে সিধু কাকার দোকান থেকে নতুন জামা কিনে আনবো  

সিধু কাকার দোকান থেকে নিজের জন্য চুড়িদার,মা শাড়ি কিনে বাবার সাইকেলের পিছনে চেপে ফিরছিল পূর্ণিমা।পরদিন স্কুলে বন্ধুদের কি বলবে তা নিয়ে নিজের মনে রঙিন স্বপ্নের জাল বুনছিল।উল্টো দিক থেকে আসা একটা লড়ির ধাক্কায়ে এক মুহূর্ত সব স্বপ্নের আবসান। জ্ঞান ফিরে প্রথম পাওয়া ধাক্কাটাই সামলে উঠতে পূর্ণিমার বেশ কিছুদিন লেগে গেল।কিছুতেই সে মানতে পারে না যে বাবা আর নেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই তার বাবার জীবনের যবনিকা পতন ঘটে যায়। উক্ত ঘটনার পর আরও ৮টি বছর কেটে গেল স্বামীর মৃত্যুর পর সুনন্দা মেয়ে পূর্ণিমাকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসেন।সেখানে অত্যন্ত কষ্ট করে তিনি মেয়েকে বি এ পযন্ত পড়ান পূর্ণিমার মামারা ভালো ছেলে দেখে তার বিয়ে দিল।মেয়ের বিয়ের পর সুনন্দা দেবী দায়মুক্ত হলেন ঠিকই তবু একমাত্র কন্যাকে তার স্বামীর ঘরে পাঠিয়ে বাঙালি জননীর চিরন্তন হৃদয়ে বেদনা তাকে বেদনাহত করতো তবু এই বেদনার মধ্যে ছিল এক অনির্বচনীয় তৃপ্তি।ছেলেটি এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে।কিছু জমিজমা আছে।স্বচ্ছল পরিবার, পূর্ণিমাও খুব খুশি । কন্যার সুখ জননীর মনেও প্রশান্তি এনেছে । 

এই বছর পূজোর কদিন খুব আনন্দে কেটেছে পূর্ণিমার । মণ্ডপে মণ্ডপে ঠাকুর দেখেছে সে অজয়ের সাথে,ফুচকা,আইসক্রিম খেয়েছে।বিয়ের পর অজয়ের সাথে পুরি বেড়াতে গিয়েছিল,সমুদ্রে স্নান করতে কি ভয় ছিল পূর্ণিমার।ঢেউয়ের ধাক্কায়ে আছড়ে পড়েছে বেলাভূমিতে।হো হো করে হাসতে হাসতে অজয় তাকে তুলেছে।এর আগে কোনদিন পূর্ণিমা গ্রামের বাড়ি বাইরে যায়নি। নিজেদের বাড়ি আর মামাবাড়ি এই ছিল তার জগত পূজোর ৪দিন আনন্দের পর আজ পূর্ণিমার মনটা একটু খারাপ।কারন আজ বিজয়া দশমী।শাশুড়ীর সাথে কুচো নিমকি নাড়ু ও বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন বানিয়েছে সারা সন্ধ্যে।এবার শাশুড়ীর সাথে সিঁদুর খেলাতে মেতেছে সে।বাড়ী এসে আয়েনাতে নিজের মুখ দেখে অনাবিল আনন্দে তার বুক ভরে উঠল।তার মনে আছে ছেলেবেলাতে মাও এমন করে সিঁদুর খেলত কাকিমা জেঠিমাদের সাথে।পাড়ার ছেলেরা সকলে মিলে প্রতিমা নিরঞ্জনের উদ্দেশ্যে দুর্গা মাই কি জয়ধ্বনি দিতে দিতে আসছে গঙ্গার উদ্দেশ্যে।তারপর প্রতিমা নৌকায়ে চাপিয়ে মাঝগঙ্গার দিকে চলল পাড়ার ছেলেরা।সেই সময় ঘটল চরম বিপত্তি।প্রতিমা নৌকা থেকে নদীতে ফেলার সময় টাল সামলাতে না পেরে অজয় পড়ে গেল জলে।সে যে সাঁতার জানত না টা পাড়ার কেউ জানতো না । অনেক খানাতাল্লাশির পরে অজয়ের নিষ্প্রাণ দেহ যখন উদ্ধার হল তখন সবে সূর্য উঠেছে।