এক
দুপুরের দুর্ঘটনা
সমস্যার শুরু সেখানেই। খাঁ খাঁ দুপুর । একটি ছেলে ও একটি মেয়ে । সম্ভবতঃ কলেজের ক্লাস কেটে দুঃসাহসী। বারোঘর এক উঠানের মত পাড়ার মাঝে আধমজা এক পুকুর। তার পাড়ে গিয়ে বসল । পাশাপাশি। বেশি কিছু চাওয়া নেই। একটু ছোঁয়াছুঁয়ি, একটু জড়াজড়ি। আর সুযোগ পেলে ঠোঁটে ঠোঁট । নিতান্তই নিরামিষ । পুকুরও তথৈবচ । টলটলে জল নেই।মাছ জলে খেলা করে না । অন্তত চোখে দেখা যায় না। মরাল নেই। এমনকি পাতিহাঁসও নয়। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো । পুকুরের এককোণে ছাইয়ের গাদার দখলদারি । সেখানে রয়েছে চা-পান-বিড়ি ছোট্ট দোকান। পুকুরের তিন পাশ ঘিরে রয়েছে মূলতঃ বসতবাড়ি । সে বসতবাড়িই বল আর চায়ের দোকান – সবই পুকুরের দিকে মুখ ফিরিয়ে । পুকুরের যে পাড়ে ছেলেটি ও মেয়েটি বসেছিল, সেদিকটাই যা একটু ফাঁকা। তার অপর পাড়ে নির্মীয়মাণ আবাসনে রং-এর ছোঁয়া । সেই পাড়ে নতুন ফেলা ধুস ও রাবিশ অনেকটাই আগ্রাসী। হেজেমজে যাওয়া সেই পুকুর পৃথুলা মাঝবয়েসী গৃহবধূর মতই বেশবাসের পারিপাট্যে না হোক, স্বভাবগত পেলবতায় ও পরম মমতায় আপন করে নিয়েছে জলপিঁপিঁদের যারা রমণরত পরিচিত পুরুষের আঙুলের মত খেলা করে তার শরীরে।আধবোজা পুকুরের খানিকটা খটখটে মাটি । ওটা পেরোলেই কচুরিপানার দামালপনা । তাদের এতই বাড়বাড়ন্ত যে এক ঝলক দেখলে মনে হয় এক পলকে পেরোনো যাবে সবুজে ঢাকা এক মাঠ । সেই সবুজের সমারোহে বৈচিত্র এনেছে কচুরিপানার ফুল। এতো কলুষতা ও আবিলতাকে টেক্কা দিয়ে ফুটে রয়েছে কৃষ্ণের ময়ূরকন্ঠী গাত্রবর্ণ নিয়ে। রঙের চ্ছটায় ও পাপড়ির বিন্যাসে তা নজরকাড়ার মতই। উপরিপাওনা পাপড়ির গায়ে প্রকৃতির এঁকে দেওয়া চোখগুলি। ফলতঃ, ফুলের দিকে তাকালেই তার সাথে চোখাচোখি হতে বাধ্য। আর একবার তার চোখে চোখ পড়লেই, সে চোখের যা টান যে চোখ ফেরানোই দায়।
আর ঠিক এটাই হয়েছিল মেয়েটির সাথে যখন বাদামওয়ালার আধপচা আর আধপোড়া বাদাম চিবোতে চিবোতে শেষ হয়ে এলো । সে পচাই বল আর পোড়াই বল, না নিয়ে উপায় নেই । কুতকুতে চোখওয়ালা পেটমোটা কুচকুচে কালো লোকটা তার প্রকাণ্ড পেটের ওপর একটা ছোট্ট ঝুড়ি ঝুলিয়ে বাদাম বিক্রি করতে আসে ঠিক তাক করে । ওরা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে । লাভ হয়নি কিছুই, উল্টে কয়েকহাত দূরে বাদামের ঝুড়ি নিয়ে বসে গেছে পুকুরের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে যেন শালার ব্যাটা শালা কাশ্মীরের ডাল লেকের শিকারাতে সুন্দরী ফুলওয়ালী দেখছে । ছেলেটা একবার বলেই ফেলেছিল – এটা তো একরকম তোলাবাজী। তা কিনা লোকটা হেসে বলে – কি
করব দাদা পেটটা এত বড়, আর পকেটটা ছোট । লোকটার অকপটতায় না হেসে পারে নি মেয়েটি।
পাশাপাশি বসে ছুঁয়ে থেকে সুখদুঃখের গল্প করতে করতে বাদামের খোলা ভাঙতে ভাঙতে ভালোই কাটছিল মেয়েটির হরিষে বিষাদে । বাদাম শেষ । ঘাস উপড়ানো শুরু । ঘাসও বেয়াড়া । আমূল ধরা দেয় না । তবে গোড়ার দিকের সাদা অংশটা মিষ্টিমিষ্টি । সেটি চিবোতে চিবোতে আনমনে চোখাচোখি হয়ে গিয়েছিল তার। কচুরিপানার ফুলের সাথে। সেই চোখের গভীরতায় তলিয়ে গিয়েছিল মেয়ে। একবার আব্দারও করছিল – আমাকে ঐ ফুল এনে দাও না গো।রোমান্টিসিজমের মোড়ক খোলার মত তার রিমলেস চশমা খুলে ছেলেটি বলেছিল – পাঁক আছে। সাপখোপও থাকতে পারে ।
এরপরেও আলাপ চলছিল। কিন্তু সুর, তাল, লয় ঠিক যেন মিলছিল না । ছেলের অনেক কথাতেই মেয়ে আনমনা । সাড়া মিললেও তা স্বগতোক্তির মত ‘উ’, ‘অ্যা’ –এর বেশী কিছু নয় । কোথাও যেন খেই হারিয়ে গেছে । শরীর পুকুরপাড়ে ছেলের গায়ে লেপটে। মন পানাপুকুরে ফোটা ফুলে। স্কিপিং করবার সময় একবার তাল কেটে গেলে একটু বিরতির প্রয়োজন হয় । আর ভাবভালোবাসাতেও । হয়ত সেকারণেই ছেলে গা-হাত-পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল। মুখে বলল – পাঁচ মিনিট বোসো; সিগারেটটা ধরিয়েই আসছি । এছাড়া ঈষৎ জলবিয়োগের প্রয়োজনও অনুভব করছিল সে । প্রকৃতির ডাক তো আর ভালোবাসা মানে না।
আর যত বিল্লা এই পাঁচ মিনিটেই । মেয়ে ফুলের চোখ থেকে চোখ ফিরিয়ে অপাঙ্গে ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল – ‘হুঁ’। আর চোখ ফিরিয়ে নিল।ফুলের চোখের টান বড় অমোঘ । সে যে মানে না বাঁধা। মেয়ে মোহাবিষ্টের মত উঠে দাঁড়ালো। পুকুরের ঢাল বরাবর নেমে এলো। শুকনো মাটি পেরোল। পায়ের পাতা ডোবা কাদা পেরোল । কচুরিবনের দিকে এগোল । এবং ফুলের কাছে এসে থমকে গেল। ফুলের ডাঁটি পেঁচিয়ে এক সোনালী-কালো জলঢোঁড়া । যেই না মেয়ের চোখ গিয়ে পড়ল জলঢোঁড়ার চোখের ‘পর, মেয়ের চটকা ভাঙল। আর ঢোঁড়াটি লজ্জায় মাথা নিচু করে জলের ওপর বিলি কেটে সরে গেল । নাছোড় মেয়েটি ফুল ছিঁড়ল। আর লম্বা লম্বা পা ফেলে স্বস্থানে। হাতে আলতো করে ধরা বহুকাংক্ষিত ফুল।
মেয়ের চিৎকার শুনে ছেলে এসে দেখে মেয়ের বাহারি জুতোজোড়া তাদের বসার জায়গা আলো করে আছে । আর মেয়ে বিহ্বল হয়ে এদিক ওদিক চাইছে । কি হল ? – ছেলে শুধোয় । মেয়ে বলে – আমার ব্যাগ ? এদিকে আশপাশের দু’তিন বাড়ির জানলা খুলে গেছে । দুপুরের ভাতঘুম জড়ানো গলায় এক মহিলা জিজ্ঞেসও করে ফেললেন – ব্যাগে কি ছিল ? কলেজ পড়ুয়া মেয়ের ব্যাগে আর কি-ইবা থাকতে পারে। খুচরো কিছু পয়সা । দশ, বিশ কি পঞ্চাশ টাকার দু’একটি নোট। মেয়েলি টুকিটাকি। আর হয়তো ভালোবাসার দু’-একটি মেমেন্টো । যেসময়েরকথা, তখন এত হইহই করে মুঠোফোনের চলনহয়নি। স্মার্টফোনতোদূরঅস্ত । থিতিয়ে পড়া ঝিমনো দুপুরে তাই অকারণ ব্যস্ততা । একে, ওকে, তাকে খোঁজ, জিজ্ঞাসা । এখানে কাউকে আসতে বা ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে কিনা ইত্যাদি, ইত্যাদি । কিন্তু নীট ফল শূন্য ।
অবশ্য ব্যাগটি পরে পাওয়া গিয়েছিল । পেয়েছিল প্রমদাসুন্দরীর ক্লাসএইটের তিতলি যাকে স্কুলে সবাই মধুপর্ণী বলে ডাকে । ব্যাগের ভিতর ছিল একটি হলুদ ক্লিপ । একপাতা কাঁচের টিপ । আর সম্বোধনহীন একটি প্রেমপত্র । পরম মমতায় ব্যাগটি সে লুকিয়ে রেখেছে, যদি মালকিনের খোঁজ পায় । অবশ্য ব্যাগের চিঠিটি তার নিজের ভেবে যে সে দু-একবার শিহরিত হয়নি তা নয় । ব্যাগের মধ্যে আর ছিল মোষের শিং- এর একটি বাহারি হাতল ওয়ালা চিরুনী । গায়ে তার ঈজিপ্শিয়ান কারুকাজ । ছেলেটির দেওয়া । বাড়ির চৌহুদ্দির মধ্যে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন পঞ্চাশোর্ধা দত্তগিন্নি । রেখে দিয়েছেন । মাঝে মাঝে নিভৃত দুপুরে চুলে বোলান । অবশ্য তাতে কিশোরি বেলায় হারানো প্রেমিকের স্পর্শসুখ আসে কিনা জানি না।