গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৪

দোলনচাঁপা ধর


তরল জ্যোৎস্না

নব্বই ছুঁই ছুঁই শ্যামাচরণ বাবুর সবেতে বড় কৌতূহল, জানবার ইচ্ছা প্রায়শই আজকাল ভদ্রতাকেও অতিক্রম করছে আর এটা আরও বেড়েছে তাঁর সদ্য স্ত্রী-বিয়োগের পরেই।আজকাল পরীক্ষার ফলের খবর,নতুন চাকরি পেলে তার মাইনের খবর এসব আগ বাড়িয়ে জানতে চাওয়া ভদ্রতার বাইরে তা কিছুতে ওনাকে বুঝিয়ে পারে না ওঁর ছেলে তরুণ।বাড়িতে কারো ফোন আসলে তিনি ছুটে গিয়ে ধরবেন সবার আগে, কে কি বৃত্তান্ত সব তাঁর জানা চাই, ওপ্রান্তের মানুষও বিরক্ত হয়, এই তো সেদিন উৎসাকে তার বসের কাছে জবাবদিহি করতে হল যে ফোন তার শ্বশুর ধরেছিলেন।তরুণের থানা থেকে খোদ ওসি সাহেব কল করেছেন,শ্যামাচরণ বাবু জিজ্ঞেস করলেন কে, কি চাই’? তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন আপনি কে? ফোনটা তরুণের তো নাকি?’

বাড়িতে কেউ এলে তিনি সারাক্ষন তার সামনে বসে দেশের কথা পুরনো দিনের কথা বলে যাবেন,’বুঝলে আমার দেশ ছিল সাতক্ষীরা,পালিতে ধান আর পনে বিচালি মাপতাম’, সে লোক উঠি উঠি করে ততক্ষনে, এই আলাপের অত্যাচার থেকে গোয়ালা, ফেরিওয়ালা থেকে বাড়ির কাজের লোক কারো নিস্তার নেই।উৎসা ভীষণ বিরক্ত শ্বশুরের এমন ব্যবহারে, এযাবৎ এ জ্বালাতনে পড়তে হয় নি তাকে কারণ প্রথম থেকেই সে আলাদা সংসারে, এখন শাশুড়ি মারা গিয়েও এই বিপদে ফেলে গেলেন।তরুণ কে কিছু বলতে গেলে বলে কি করব, বাবা তো, ফেলে তো দিতে পারি না, মানিয়ে নাও প্লিজ
উৎসা মেনে নিতে পারে না সন্ধ্যে না গড়াতে বাড়িতে বাংলা সিরিয়ালের হল্লা ( শ্বশুরমশাই কানে কম শোনেন), দুইবেলা মাছ ভাতের পাট( তাদের রাতে ছয়খানা রুটি হলে চলে),টয়লেটে জলের কম ব্যবহার, নিত্য বেরনোর সময় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা( যাত্রামঙ্গল পাঠ), অফিস পৌঁছে নির্বিঘ্নে পৌঁছনোর খবর দেওয়া, সর্বোপরি তাঁর অদম্য কৌতূহল। এখনো যেমন তেমন চলছে কিন্তু বুবলাই হস্টেল থেকে ফিরলে গোল একটা বাধবে নিশ্চয়ই, প্রথমেই দাদুর সাথে ঘর ভাগাভাগি নিয়ে তারপর বাড়ির এমন হাল দেখে। এখন একটাই আশা উৎসার বুকে, বুবলাই কবে ফেরে পুজোর ছুটিতে তখন তরুণকে একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করতে হবে।ছেলের কথা ফেলতে পারবে না।

মহালয়ার পরেই বুবলাই এসে পড়ল হই হই করে, বাড়ির দমবন্ধ পরিবেশটাই যেন বদলে গেল এক ঝলক রোদ্দুরে, এসেই আগে দাদুর খোঁজ দাদাই কেমন আছ তুমি? এরা কষ্ট দেয় নি তো বল আমায়শ্যামাচরণ বাবুও যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। নাতি আর দাদু এতই গল্পে মজেছে যে উৎসা ছেলের সময়ের ভাগই পাচ্ছে না, শ্বশুরের উপর যারপরনায় বিরক্ত হলেও ছেলের বুদ্ধিতে খুশীও হচ্ছে, বাড়িতে ঢুকেই তো আর বুড়োকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর কথা বলা যায় না।  দুদিন যাক পুজো মিটুক তারপর ওর হস্টেলে যাওয়ার আগেই একটা ব্যবস্থা ঠিক হবে নিশ্চয়ই।

পুজোর দিনগুলো রান্নাঘরেই কিভাবে কেটে গেল উৎসার, এমন কোনোদিনও হয় না, বরাবরই তারা উৎসবের দিনগুলোতে বাইরে থেকে আনা খাবারই খায়, এবারের ব্যতিক্রমের কারন বুবলাই, ওই বলল মা দাদাইয়ের জন্য তো তোমায় বাড়িতে রাঁধতেই হবে ওই সাথে বরং আমাদেরও বানিয়ে দাও ঠাম্মুর হাতের স্পেশাল পদগুলো।উৎসা রাজী হয় নি প্রথমে দাদাই আমাদের সাথে বাইরের খাবারই খেয়ে নেবেন বুবলাই,ভেব নাছেলে অনড় না মা শেষে কিছু হলে তোমারই বিপদ হবে বেশী, দিনগুলো বেকার যাবে, তার চেয়ে......

অগত্যা উৎসা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যায়, আজ লক্ষ্মীপুজো, পরশু বুবলাই চলে যাবে রাতে কথাটা পাড়ে ছেলের কাছে, ‘ আর তো পারা যাচ্ছে না বুবলাই, কিছু একটা কর তুই, বাবাকে বল যেন দাদাইকে হোমে পাঠাবার ব্যবস্থা করে। বুবলাই দেখে পূর্ণিমার আলোতে মায়ের মুখটা কি বীভৎস দেখাচ্ছে যেন লালকমল নীলকমলের রাক্ষুসী মা, শিউরে ওঠে সে, কেঁপে যায় তার গলার স্বর মা ক্লাস ফোরে যখন আমাকে হস্টেলে পাঠিয়েছিলে ভাল লেখাপড়া শেখার জন্য তখন আমি নিজের কাজ নিজে সব করতে পারতাম না তবু আমি তোমার কথাই বিশ্বাস করেছিলাম,আমি মন দিয়ে লেখাপড়া শিখেছি মা, কিন্তু আজ যদি দাদাইকেও সেভাবে পাঠিয়ে দাও তবে যে আমাকেও তোমাদের জন্য হোমের কথা ভেবে রাখতে হবে, আমার মা শুধু নিজের কথা ভাবে এ আমি মানতে পারি না, কেউ বললেও না, শুধু তুমি আমায় সেটা বিশ্বাস করতে বাধ্য করো না   
                             
নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় উৎসার,চাঁদনী জ্বালা ধরায় তার গায়ে, তার এতদিনের বিরক্তি তরল জ্যোৎস্না হয়ে ভাসিয়ে দেয় দুইচোখ, গাল বুক...।