গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৪

শিবলী শাহেদ


শুন্য সমুদ্রের দ্বীপ

আমি মানুষটা বোধহয় অতটা রোম্যান্টিক না। কারণ, রাতের বেলা পলি যখন আমাকে ফোন দিয়ে দুনিয়ার আহ্লাদী করতআমার তখন খুবই বিরক্ত লাগত। ঘুম পেতো। একটু পর পর দেখা যেত কুমিরের মতো হাই তুলতে শুরু করেছি। হাই এর শব্দ ভুলক্রমে উনার কানে চলে গেলে উনি মন খারাপ করেন। আমি অনেক কষ্টে হাই চেপে রাখতাম কিন্তু সবসময়তো আর শরীরের সাথে পেরে ওঠা হতো না। তখন সে হয়তো একটু মন খারাপ করেই বলতআমার সাথে কথা বললেই কেবল তোমার ঘুম পায়, তাই না? তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার ন্যাকামো শুরু করত। কতদিন যে আমি ফোনধরা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছি, আর ওদিকে সে কথা বলেই যাচ্ছে। তার উপর উনার আবার সময়ে অসময়ে কবিতা প'ড়ে শোনানোর বাতিক। আরেক বিরক্তিকর জিনিস। আমি ওর কবিতা শুনে মাথা নেড়ে খুব মুগ্ধ হয়ে যাওয়ার ভাণ করতাম। কখনো কখনো চমৎকার, অওসাম ইত্যাদি বিশেষণ ছুঁড়ে দিতাম। পুরো ব্যাপারটাই অভিনয়। তবে এই অভিনয়ের ব্যাপারটুকু সে ধরতে পারত। তেমন কিছুই বলত না। ওর সবচেয়ে ভাল গুণও আমাকে কখনো বদলানোর চেষ্টা করেনি। মাঝে মাঝে ম্লান হেসে কেবল বলতআমি যেদিন থাকব না, সেদিন আমার এই ন্যাকামোগুলা খুব মিস করবা। শুনে আমি হাসতাম। এই হাসির উৎস বুকের খুব গভীরে কোথাওউপলব্ধি করতে পেরে ওর চোখ ছলছল করে উঠত।

তো এত নন-রোম্যান্টিক হয়েও কীভাবে কীভাবে যেন পলির সাথে প্রায় চার বছর কাটিয়ে দিলাম। আমরা ছিলাম একই ব্যাচের। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সমবয়সীদের প্রেম সাধারণত বিয়ের দিকে গড়ায় নাগড়ায় ট্রাজেডির দিকে। তাছাড়া ঠিকঠাক বয়সের হিসেব করলে দেখা যাবে ও আমার থেকে আরো আট নয় মাসের বড়। আর তখন আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না তার বাবা মা'র সামনে দাঁড়ানোকীভাবে দাঁড়াবনিজের পায়েই তো দাঁড়াতে শিখিনি তখনো। সবমিলিয়ে আমাদের বিয়েটা হয়নি।

প্রথমদিকে ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা খারাপ লাগা কাজ করেনি। হয়ত পুরো বিষয়টা নিয়ে অবচেতনে একটা প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু সেই প্রস্তুতি তেমন জোরালো ছিল না। আর তাই কিছুদিনের মধ্যেই আমি পলিকে তীব্রভাবে মিস করতে শুরু করি। সেই তীব্রতা যে কত ভয়ানককোন শব্দ কিংবা হাজারো বাক্যের গড়নপেটনে সেটাকে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অপ্রকাশ্য সব কিছুই যন্ত্রণাময়। আমি যেন অন্ধকার আর অসহায়তার এক যুথবদ্ধ জীবনে প্রবেশ করলাম।
বিয়ের পর থেকে পলি আমাকে একবারো ফোন করে নি। হয়ত করবেও না আর। তবুও ফোনের রিং বেজে উঠলেই আমি চমকে উঠি। প্রতিবারই দেখা যায় ফোনদাতা পলি ছাড়া অন্য কেউ। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিকতা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। প্রতিরাতে যে মানুষটি আমাকে ফোন দিয়ে আহ্লাদী করত, একটার পর একটা মেসেজ পাঠাতোসে আজ ফোন, মেসেজ কিছুই দিচ্ছে না! আমার জন্য কেবল একবুক শুন্যতা অবশিষ্ট রেখে সে হারিয়ে গেছে! সত্যিই এতটা অসহায় কখনো লাগেনি নিজেকে।

ইনবক্সে যেয়ে পুরানো মেসেজগুলোতে চোখ বুলাই। কত মেসেজই না সে পাঠাতো। বেশিরভাগই আমি পড়তাম না। আজ কি একটু পড়ে দেখব? এই যে এই মেসেজটা, সে লিখেছেঅনেক খুঁজে শেষ পর্যন্ত নেরুদার বইটা পেলাম। এই কবিতাটা আমার ভাল লেগেছে। আমাদের কথাই যেন লেখা আছে এতে। " একটি বিষণ্ণ বালক হাঁটু-মুড়ে বসে আছে তোমার অন্তরে দৃষ্টি তার আমাদেরই 'পরে— ...যে জীবন তার ধমনিতে জ্বলন্ত প্রবাহমানতাকে যদি নিতে চাও তবে হত্যা করো আমার এই বাহু দু'টি।"

এই খটমটে কবিতাগুলোযেগুলো সবসময় আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকেছেআজ কেমন যেন ঘোরের ভেতর নিয়ে যাচ্ছে আমায়। প্রতিটি বাক্য যেন পলি'র প্রতিনিধিত্ব করছে। আমাকে জোর করে চিনিয়ে দিচ্ছে ডিসট্যান্সের স্বরূপ। এই অপ্রতিরোধ্য দুরত্বের ভার আমি যেন আর সইতে পারছিলাম না। কম্পিত পায়ে রীতিমতো টলতে টলতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। দেখা যাচ্ছে রাস্তায় এক যুগল হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। তারা কি স্বামী-স্ত্রী নাকি প্রেমিক প্রেমিকা? আচ্ছা, তারা কি তাদের সম্পর্ক নিয়ে পরিতৃপ্ত? সম্পর্কের টানাপোড়েন কি মাঝে মাঝে তাদের জীবনকে খুব রংচটা আর ক্লিশে করে দিচ্ছে না! তবুও তো তারা ভালবাসছে, পাশাপাশি হাঁটছে; অন্তত এই মুহুর্তে তারাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। হঠাৎ একটা জান্তব ঈর্ষা আমার ভেতরটাকে একেবারে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিল। মনে হলোআমি কী এমন দোষ করেছিলাম, এমন একটা নির্ভেজাল সুখী জীবন আমিও তো ডিসার্ভ করি। ঈর্ষা থেকে ক্রোধ, ক্রোধ থেকে জিঘাংসা। এই মুহুর্তে আমার শিকার আমি নিজেই। বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়লে কেমন হয়? একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক না। প্রাপ্তিহীন জীবনকে পেছনে ফেলে একবার, কেবল একবার মৃত্যুকে জড়িয়ে ধরতে পারলেই অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা ঘুচবে এই আশায় আমার চোখ চকচক করে উঠল।

আকাশে ছোটোবেলায় শোনা সেই রূপোর থালার মত চাঁদ উঠেছে। থেকে থেকে খানিকটা মেঘ সেই চাঁদ কে ঢেকে দিচ্ছে। মেঘের গায়ে কালশিটে দাগ। মেঘের চোখে ধুলো দিয়ে কিছু চতুর আলো এসে পড়েছে রাস্তায়। সেই আলোতে শিশুরা হুটোপুটি করছেহ্যাঁ, এ দৃশ্য দেখতে দেখতেই মরে যাওয়া যায়। আমি ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলাম। হঠাৎ যেন মনে হলো একটা ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। সে কি দেবদূতএই মুহুর্তের সবচেয়ে প্রত্যাশিত অতিথি, নাকি পলিআমার প্রতিটি বিপন্ন সকালের শিরোনাম? বিড়বিড় করে কী বলছে সে! আরো এগিয়ে এলো ছায়ামূর্তিটা। দাঁড়ালো আমার গা ঘেঁষে। তারপর হাত দুটো শুন্যে তুলে যেন পৃথিবীকে খানিকটা কটাক্ষ করে শুনিয়ে দিল— "আমরা মিশি নি ভালবেসে সব মানুষ যেভাবে মেশে, আমরা গিয়েছি প্রাজ্ঞ আধার না জানার টানে ভেসে।..... আমরা দুজনে মিশি নি বিহ্বলতায় শুক্রে-শোণিতে-সংবেদে আমাদের প্রেম পূর্ণ হয়েছে বেদনায়, বিচ্ছেদে।"

দূর থেকে একটা প্রায়-পরিচিত সুর ভেসে আসছে। একটা বাদ্যযন্ত্র গিটার নাকি ম্যান্ডোলিনবোঝা যাচ্ছে না। যে বাজাচ্ছে সে নিশ্চয়ই অর্ফিয়ুসের উত্তর-পুরুষ! বাচ্চাদের হৈচৈ, চাঁদের আলো আর সতত আড়ালকারী সেই মেঘসব কিছুই যেন এই সুরের সাথে সহমত পোষণ করছে। সময়ে সময়ে সৃষ্টি করছে কিছু অপার্থিব অনুনাদ। আমি ছায়ামূর্তির হাত ধরে আলোর শব্দের ভেতর লাফিয়ে পড়লাম। তারপর হারিয়ে গেলাম। চলে গেলাম শুন্য সমুদ্রের এক সুখের দ্বীপে....