গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৪

আফরোজা অদিতি


ক্ষুধা

হারামজাদী মাগী বাইর ঘর থাইক্কা- কথাটা বলেই ঘাড় ধরে স্বামীর বিয়ে করা নতুন বউকে ধাক্কা দিয়ে উঠানে ফেলে দেয় বড় বউ

বড় বউএর বুকের ভেতর যন্ত্রণা এতো বছর পর অন্য মেযেমানুষ এনেছে স্বামী সেই মেয়েমানুষটা চোখের সামনে এঘর ওঘর ঘুওে বেড়ায় উঠানময় পায়চারী করে তারই সামনে তারই স্বামীর সঙ্গে ঘওে কপাট দেয় বড় বউএর যন্ত্রণা মেয়েটা সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত উঠতি বয়স ভরা ঙের মতো যৌবন টইটুম্বুর থৈ থৈ

ইস পিরিতি করার শখ গজর গজর করে বড়ো বউ আমার সোয়ামী ছাড়া আর কারেও চক্ষে দেহস নাই লো আবাগীর বেটী , লোকটার বউ পোলা মাইয়া আছে তাও কি জানস নাই ছেনালী করার আর জায়গা পাস নি মা মাগী কেমুন মাইয়া প্যাটে ধরছিল গো ওরে আমার কি সব্বনাস করলো গো...  বড়ো বউ কপাল চাপড়াতে থাকে
মায়ের কান্না দেখে বড়ো মেয়ে আসগরী বেগম অসোয়াস্তিতে ভুগতে থাকে ঘরে স্বামী একমাস পর এসেছে নিয়ে যাবে ওকে আসগরী বেগমের শ্বশুরবাড়ি  সদানন্দীপুর বেলাবেলি পথ কিন্তু যাওয়া হয় নাই ওর বাবা, মোহর মুনশি বাড়ি নেই স্বামীর সঙ্গে ঘরেই ছিলো স্বামী ছাড়ছিলো না ওকে মায়ের কান্না শুনে বাধ্য হয়ে বাইরে আসে আসগরী
চুপ করো তো মা কি শুরু করলা ফিসফিসিয়ে ধমক দেয় মাকে
শুরু করেছি কি সাধে কান্না থামিয়ে বলে মা বুড়াকালে ভিমরতি ওই হারামিরে নিকা করছে
আস্তে কথা কওন যায় না মা ঘরে জামাই আছে সে খেয়াল রাখবা তো তা বাবা কি শখ কইরে বিয়া করছে, পঞ্চায়েত জোর করছে বইলাই না বিয়া করছে মেয়ে বাবার হয়ে সাফাই দেয়
থাউক আর সাফাই গাইতে হইবো না তর বাপের লটর-পটর আমি বুঝি না মায়ের কন্ঠে ঝাঁঝ
থামোতো মা তুমি কি চাও আমি বাপজান আসার আগেই চইলা যাই তোমার জামাই কি মনে করবো কও তো মেয়ে দুপদাপ করে চলে যায় ঘরে
ঘরের ভেতর থেকে ধাক্কা খেয়ে উঠানে পড়ে থাকে নতুন বউ বেহুস, ওঠে না কেউ তাকে ওঠায় না দিন বিয়ের বয়স দিন স্বামী বাড়ি নেই এই দিন কেউ খেতে দেয়নি তাকে না খাওয়া শরীরে এই মারের ধাক্কা সহ্য হয় না জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে

ছোট বউএর নাম শরীফা বাবা আমেদ আলী বর্গা চাষী নিজের বলতে কোন জমিজমা নেই আছে শুধু একটা শনের ঘরের ভিটে আমেদ আলী, মোহর মুনশীর বাড়িতে কামলা দেয়
আমেদ আলীর জন ছেলে মেয়ে শরীফা বড়ো দেখতে শুনতে মন্দ না ফর্সা গায়ের রং যে বয়সে প্রত্যেক মানুষকে সুন্দও লাগে সেই বয়স শরীফার উঠকি বয়সি শরীরটা ছেঁড়া শাড়িতে যত্ন করে
ঢেকে রাখে তবুও ওর দিকে চোখ পড়ে মোহর মুনশীর বর্গাচাষীর সুবাদে মাঝেমধ্যেই শরীফাদের বাড়ি আসতো এখন সেই আসা যাওয়া বেড়ে যায় পাওডার,ক্রিম,শাড়ি ব্লাউজ দিতে থাকে শরীফাকে
শরীফার বাবা এসব দেখেও না দেখার ভান করে কিছু বলতে পারে না যদি জমিটা হাতছাড়া হয়ে যায় ছেলেমেয়ে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে সারা বছর প্রভাবশালী লোক তার কথায় কেউ ওকে কাজ দিবে না
আর উঠতি বয়সি না পাওয়া, না খাওয়া ঘরের মেয়ে এটা ওটা পেয়ে খুশি হয় সহজ হয় এভাবে দিন গেলে ভালোই থাকতো শরীফা কিন্তু নিয়তি বিরূপ একদিন আমেদ আলী কাজে যেতে পারেনি  প্রচন্ড জ্বর ঘরে খাবার নেই বাবার কথায় শরীফা মোহর মুনশীর কাছে যায় টাকা আনতে
মুখ নিচু করে পথ চলছিলো শরীফা   পেছন থেকে নাম শুনে চমকে উঠে থমকে দাঁড়ায় মোহর মুনশী
এই কই যাস
আপনে ডর পাইছিলাম বুকে থু থু দেয় তারপর কুন্ঠিত স্বরে বলে,আপনের কাছেই যাইতে আছিলাম বাপজানের জ্বর আইজ কামে আইতে পারবো না কিছু টাকা দিতে কইছে
টাকা চল টাকা দিমু মোহর মুনশীর চোখে লালসার আগুন দেখতে পায় না শরীফা
একপাশে ধানজমি অন্যপাশে পাট ক্ষেত মাঝখানে সরু পায়ে চলার পথ ওরা হাঁটছে মাথার উপর দিয়ে একটা কাক কর্কস স্বরে কা-কা শব্দে উড়ে গেলো শরীফার হঠাৎই ভয় লাগে ভয়টা কেনো বুঝতে পারে না শরীফা মুখ নিচু করে মোহর মুনশীর পেছনে হাঁটছিলো  
হাতে টান পড়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে পাট ক্ষেতের ভেতর আবিষ্কার করে
শরীফা চিৎকার করে, গালি দেয়, খামচি দেয় চুপ, মুখ চেপে ওকে ধমক দেয় মোহর মুনশী
গায়ের জোরে মোহর মুনশীর সঙ্গে পেরে ওঠে না শরীফা হাতের মুঠোয় টাকা নিয়ে অর্ধ উলঙ্গ অবশ পড়ে থাকে শরীফা
এই ব্যাপারটা যে ঠিক নয় তা বুঝতে পারে, চেপে রাখতে চায় শরীফা কিন্তু দুঃসংবাদ বাতাসের আগে ধায় সেরকমই হলো পাট ক্ষেত থেকে বের হতেই  কুটনী বুড়ির সঙ্গে দেখা কোন কথা না বলে পাশ কাটিয়ে হাঁটা দেয় জানে না মোহর মুনশীকে পাট ক্ষেত থেকে বের হতে দেখেই ওই বুড়ি দাঁড়িয়েছিলো ওখানে

এরপর পঞ্চায়েতের বিচার ওকে ১০১টা দোররা মারা হবে বিচারে শাস্তি হওয়ার পর মন থেকে ভয় চলে গেলো ওর মোটা রশি দিয়ে যখন আম গাছের সঙ্গে বাঁধা হয় তখন চিৎকার করে বলে, আমার শাস্তি হবে ক্যান আমি তো এই কাম করি নাই আমার উপর অত্যাচার করছে
কিছুক্ষণ চুপকরে থাকে তারপর আঙুল তোলে মোহর মুনশীর দিকে ওকেও এই শাস্তি দ্যান
এরপর কি হতো জানে না শরীফা পলিশ আসাতে বেঁচে যায় শরীফা ওই পঞ্চায়েতেই মোহর মুনশীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় ওর বিয়ে করতে চায়নি শরীফা বিয়ের থেকে মৃত্যুই কাম্য ছিলো ওর কিন্তু আত্মহত্যা করে পাপ করতে চায় নি
মোহর মুনশীকে যখন পঞ্চায়েত বিয়ে করতে বললো তখন খুশিই হলো সে নিজে থেকে বিয়ে করতে পারছিলো না রাতদিন বড়ো বউএর খ্যাচখ্যাচ মুখ ঝামটা ভালো লাগছিলো না তাছাড়া বয়স হয়েছে বড়ো বউএর আর কতো ভালো লাগে
গঞ্জ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে মুনশী দিনের জায়গায় দিন বাড়ি ফিরে ছোট বউকে ওভাবে উঠানে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে আসে শরীফার কাছে বাড়ির চাকর কদম আলী ডাকে ওকে
কদম আলী, এই কদম আলী, হারামীর বাচ্চা কই তুই আর এই বাড়ির লোকজন কই সব সব কি মরছে।। একটা মানুষ এভাবে পইড়া আছে দ্যাখবার কেউ নাই
মোহর মুনশী কারও অপেক্ষা করে না ওকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে আসে মুনশী বিছানায় শুইয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেয় মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বুকের ভেতর বুনো ঘোড়ার দাপাদাপি টের পায় সুন্দর মুখের ঢলঢল সৌন্দর্য বিবশ করে, বিবশ করে তাকে শরীফার বুকের ওঠানামা মোহর মুনশীর অজান্তেই শরীফার বুকের চড়াই উৎড়াই খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে ওর হাত চোখ মেলে শরীফা মোহর মুনশীকে দেখে ভীত হয়
এই যে আমার ময়না পাখি , চোখ ম্যালছে কি হইছে সোনা
কিছু না, পানি খাবো ভীত গলায় বলে শরীফা এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখে আর কেউ আসে কিনা ?
কি খুঁজতে আছ ? কারে খুঁজতাছ সোনা বউ ?
না না কারেও না পানি খাব
মোহর মুনশী নিজ হাতে পানি খাওয়ায় ওকে পানি খাওয়াতে খাওয়াতে মুনশীর ভেতরে শরীরি ক্ষুধা বাড়াবাড়ি রকম জেগে ওঠে মাতাল হয় মুনশী আর পানি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীফার পেটের ভেতর দিনের না খাওয়া যন্ত্রণা কিলবিল করে বেড়ে উঠতে উঠতে আচ্ছন্ন করে  দেয় ওকে

ওদের দুজনকে ঘিরে দুই রকমের ক্ষুধা বেড়ে ওঠে এবং অষ্টেপৃষ্ঠে তাতে বাঁধা পড়ে ওরা
গ্রেনেড আগুন মিছিল টিপু
আফরোজা অদিতি

ট্রাফিক আটকে দিয়েছে বাস পুলিশে ছেয়ে আছে রাস্তার -মাথা থেকে -মাথা  একটা মিছিল বেশ বড় রাস্তার ডানদিক দিয়ে আসছে মিছিল মাথা দেখা যাচ্ছে ওটার বড়সড় নেতানেত্রীরা মিছিলের সম্মুখভাগে কালো ব্যানার নিয়ে হাঁটছে ব্যানারে লেখাগ্রেনেড হামলার বিচার চাইসরকার তুমি গদী ছাড়মৃত্যু চাই না শান্তি চাই মিছিলকারীদের মুখে কাফনের কাপড় বাঁধা
বাসের ভেতর সকলের সঙ্গে টিপু
উস্ক-খুস্ক চুল ম্লান মুখ দেখলেই বুঝা যায় খাওয়া হয়নি সারাদিন জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে দেখছে না কিছুইএমনকি মিছিলেও আগ্রহ নেই আনমনা তাকিয়ে আছে মন ভালো নেই ওর এবারে খুবই কষ্ট পেয়েছে বাবা বকেছে রাগ করেছে মা
কেন এমন করে মা-বাবা ?
প্রশ্নটা ঘুরে বেড়াচ্ছে মন মগজে
বকাবকির কী আছে রাগ করারই বা কী আছে !
বড় হয়েছে বোধ-বুদ্ধি হয়েছে শক্তি হয়েছে সবকিছু বুঝবার বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও হয়েছে সব কিছু বুঝবার ক্ষমতা আছে ক্ষমতা আছে বিচার করার এখন যা কিছু করে বা করবে বুঝেশুনেই করে বা করবে এবং তা করেও এমন কিছু করবে না যাতে ওর বাবা-মায়ের মাথা নিচু হয়ে যায় না, কখনও তা করবে না এমন কিছুই করে না যাতে বোনদের অসুবিধা হয়, বাবা-মা কষ্ট পায় এখন যথেষ্ট বড়, ভালো মন্দ বুঝার মতো রড় হয়েছে
এখন নিজের খরচ নিজে চালাতে চেষ্টা করে হাত খরচের জন্য টিউশনি করে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বাবা-মা, কিংবা বোনদের কাছে হাত পাতে না টিউশনি করুক আর অন্য যে কোন কাজ করুক বাড়ি থেকে বাইরে থাকতেই হবে এই বাইরে থাকাটা পছন্দ করছে না কেউ মানতেই চাইছে না যে কাজের জন্য বাইরে থাকতে হচ্ছে ওর

দিনকাল ভালো না চারদিক অশান্ত, বোমাবাজি, ধরপাকড় চলছে বেপরোয়া সন্ত্রাসীদের হাতে মারাও যাচ্ছে অনেকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে তারপর লাশ মিলছে অনেকের কেউ বা কাজের জন্য বের হয়ে আর ফিরে আসছে না খবরই পাওয়া যাচ্ছে না প্রথমে অপহরন তারপরে গুম তারওপরে খুন
এই মুহূর্তে বাবার কথা হলো লোকজন নেই, কিছু একটা হয়ে গেলে মাথায় হাত দেওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারবেন না তিনি থানা পুলিশ করতে পারবেন না, পারবেন না খুঁজে বের করতে সেজন্য কাজ ছাড়া বাইরে বের না হওয়া কেউ ডাকলে তার সঙ্গে না যাওয়া
বাবা যে বেঠিক কিছু বলেছে তা নয় ধরপাকড়, বোমাবাজি, খুনোখুনি সবই চলছে এই তো সেদিন, মাত্র কয়েকদিন আগে  বিশাল জনসভায় গ্রেনেড হামলা হয়েছে নিহত হয়েছে, আহতও অনেক শুধু কী জনসভায় তা নয় যেখানে সেখানে বোমা হামলা বোমা হামলা হয়েছে সিলেটে, তারও আগে রমনার বটমূলে, যশোরে ঊদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার কথাতো সকলেই জানে মিটিং-মিছিল-সমাবেশে আকছারই ঘটছে  বোমা হামলা বোমা হামলা হয়েছে সিপিবির জনসভায়, হয়েছে সিনেমাহলে হযরত শাহজালালের মাজারে ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়েছে বোমা বোমা হামলায় মারা গেছে খুলনার সাংবাদিক মানিক সাহা, হুমায়ূন কবির শুধু এরাই নয়, মারা গেছে আহত হয়েছে আরও অনেকে বোমা হামলায় নিহত হয়েছে যারা তারা তো গেছেইআহতদেরও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কোন লক্ষণ নেই

সব ঠিক আছে  তাই বলে কী ঘরে বসে থাকা যায় কাজকর্মের তাগিদে বাইরে যেতেই হবে, হয়ও সময়-অসময়, রাত-বিরেতে পথ-ঘাটে চলতেই হয় এর জন্য কী রাগ করা উচিত ? উচিত নয় কিন' বাবা রাগ করেছে আর মা-তো সব সময়ই রাগ করে এবারে রাগ করল বাবা বাবার কথা কোথাও যাওয়া যাবে না রাত নয়টার পরে বাড়ির বাইরে থাকা চলবে না কিন' কী করবে টিপু, কাজ করতে গেলে তো বাইরে যেতে হবে রাতও হবে

প্রয়োজনে যদি কেউ ডাকে তাহলে কি না গিয়ে পারবে ! পারবে না কিন' এই কথা বলাও যাবে না বলতেই বাবা রেগে চড় বসিয়ে দিলো ওরও রাগ হয়ে গেল বাসা থেকে বেরিয়ে এল সেই যে গতকাল বেরিয়েছে আর ফেরেনি কী হবে ফিরে

অন্যায় না করেও যদি বকাবকি শুনতে হয়, মার খেতে হয়, তাহলে কী হবে বাসায় ফিরে না, আর ফিরবে না টিপু জেদি হয় পরক্ষণেই নরম হয়ে ভাবে, কিন' কতদিন ! কতদিন না ফিরে থাকবে আর না ফিরে কী করবে  ? জীবনে বেঁচে থাকতে হলে তো খেতে হয়, পরতে হয় আর খেতে-পরতে হলে টাকার প্রয়োজন হয় কিন' টাকা কোথায় পাবে ? টাকা পেতে হলে চাকরি করতে হবে কে দিবে চাকরি ওর তো লেখাপড়া শেষ হয়নি
এই মুহূর্তে তো টাকাও নেই ওর কাছে

টাকা নেই পকেটে একটা-দুইটা টিউশানি করে তো ভাত জুটবে না টিউশানিতে হাত খরচ চালানো যায়, কোন রকম খেয়ে পরে বেঁচে থাকা যায়্ ভালোভাবে জীবন কাটানো যায় না ভালোভাবে জীবনযাপনের জন্য চাকরির প্রয়োজন আর চাকরির জন্য প্রয়োজন লেখাপড়ার

টিপু অন্যমনস্ক জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে মায়ের জন্য বোনের জন্য মন কেমন করে বাবার মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে একদিনের অদেখাতেই মন কেমন করছে সবকিছু ছায় ছায়া ধোঁয়াসা লাগছে ভালো লাগে না টিপুর মনে পড়ে বোনের খুনসুটি, মায়ের আদর চোখ দিয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ে   

বাবা যে আদর করে না তা নয় বাবাও খুব আদর করে বাবা প্রতিদিন সকালে ওর ঘুম ভাঙাতো দুজনে হাঁটতে যেত রমনা পার্কে তারপর ফিরে এসে একসং্ে সকালের খাবার খেত বাবা চলে যেত অফিসে আর ওরা ভাইবোন পড়তে বসতো রাতের খাবার খেত একসঙ্গে খাবার টেবিলে কত রকমের গল্প করতো ওর বাবা হাসি গল্পে রাতের ডাইনিং টেবিল ভরে উঠতো টিপুর মনের পর্দায় সব ছবির মতো ভেসে যাচ্ছে টিপুর বুকে কান্নার সমুদ্র
ওর মন বলে, টিপু বাড়ি যাও, বাড়ি যাও টিপু
বাড়ি যাবো, কেন যাবো, কার কাছে যাবো একরোখা জেদি বালক টিপু
জিদ করো না টিপু বাড়ি যাও এতো জিদ ভালো নয় ওর মন কথা বলে আবার টিপুও কথা বলে
এতো আমার জিদ নয় ! আমার আত্নসম্মান
আত্নসম্মান ! বাবা-মায়ের কাছে সন্তানের আবার আত্ন সম্মান ! বাবা মা তো সন্তানের ভালোর জন্যই বকে তোমাকেও তোমার ভালোর জন্য বকেছে বাবা-মাকে দিয়েই তো তোমার পরিচয়. তোমার সম্মান
সব মেনে নিলাম তাই বলে কী যখন-তখন বকবে মারবে আমাকে আমি এখন বড় হয়েছি
বাবা-মায়ের কাছে বড়-ছোট কী! বাবা-মায়ের কাছে তাদের সন্তানেরা ছোটই থাকে সবসময়
টিপুর মন কেমন করে সিট থেকে উঠে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে বাস থেকে নামার জন্য এক পা বাড়ায় কিন' পরক্ষণেই বসে পড়ে
না যাবো না কেন মারবে আমাকে এমন করে এক-আধটু বকা দিতে পারে কিন' গায়ে হাত দেওয়া নাহ, কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না আমি এখন বড় হয়েছি বাবার মতো বড় না হতে পারি কিন' বড় তো হয়েছি
না, তোর ইচ্ছা মতো চলার পক্ষে তুমি ঢের ছোট
ওর ভেতরের মনটা আবার কথা বলে
না, আমি বড় হয়েছি আমি বাড়ি যাবো না যাবো না, যাবো না
কোথায় যাবে না খোকা
ওর পাশে বসে থাকা ভদ্রলোকের দরদী কন্ঠ
টিপু লজ্জা পায় একটু জোরেই কথা বলে ফেলেছে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলে, না না কিছু না
কিছু তো নিশ্চয় খোকা কী হয়েছে বলতো ভদ্রলোকের দরদ মেশানো কথায় ওর মনের ভেতর কান্না গুমরে ওঠ্ চোখে জল টলটল করে
পাশে বসা ভদলোকের মায়া হয় মাথায় হাত রাখে আদর করে বলে, দেখ বাবা আমি তোমার চেয়ে অনেক বড় তোমার বাবার মতো কী হয়েছে আমাকে বলতো টিপুর মনের ভেতর তোলপাড় হয়ে যায় ম্লান কন্ঠে বলে, বাবা বকেছে, মেরেছে
কেন ?
রাত করে বাড়ি ফিরেছি তাই
তোমার বাবা তো ঠিকই বলেছে দেশের অবস' ভালো নয় দেশের এই অসি'তিশীল অবস'ার জন্য বাবার তো চিন্তা হতেই পারে সেই চিন্তা থেকে উদ্বেগ আর উদ্বেগ থেকে রাগ সেই রাগের থেকেই তোমাকে বকেছে, মেরেছে হতেই পারে মনে রাখবে বাবা-মা সব সময় সন্তানের ভালো চায়
টিপু কথা বলে না
ভদ্রলোক আবারো বলে, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে সারাদিন খাওনি বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়েছ, তা যাবে কোথায়
কোথায় যাবো ঠিক করিনি তো বাসায় আর ফিরবো না
বাবা মা রাগ করলে বাড়ি থেকে চলে আসতে নেই খোকা বাড়ি যাও

একটু চুপ করে থেকে ভদ্রলোক উদাস কন্ঠে বলে, জানো তোমার মতো আমারও একটা ছেলে ছিল একদিন বকেছিলাম  বকার পরে রাগ করে ভাত খেল না তারপর কোথায় যে গেল আর ফিরে এলো না এখনও আসেনি আমার বুকের ভেতর খুব কষ্ট খোকা বরফ চাপা কষ্ট তোমার বাবারও মনে হয় আমার মতো এমনি কষ্ট হচ্ছে ভদ্রলোকের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে
ভদ্রলোকের চোখের জল দেখে টিপুর মন খারাপ হয়ে যায় ভাবে, এমন করে বাড়ি থেকে চলে আসা ঠিক হয়নি ওর বাবাও মনে হয় ওর জন্য কাঁদছে আর মা মা তো খুব নরম মনের মানুষ মা ওকে ছাড়া কখনও খায় না নিশ্চয় মা না খেয়ে আছে
না-না বাবা-মাকে কষ্ট দেওয়া যাবে না আমি বাসায় যাবো বাসায় যাবো রাস্তার সাইনবোর্ড পড়তে চেষ্টা করে
 বোমের আওয়াজ চারদিক ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় টিপু উঠে দাঁড়ায় নামতে চেষ্টা করে কিন' পারে না আর একটা বোম বাসের ভেতর চিৎকার হুড়োহুড়ি এবারে পেট্রোল বোমা বাসে আগুন টিপু হতভম্ব ভদ্রলোক তাড়া লাগায় ওঠ ওঠ চল চল
গেটে জটলা দোতলা বাস ওপরে নিচে যাত্রীরা সব একাকার ধাক্কাধাক্কি কে কার আগে নামবে
শিশুদের কান্না টিপুরও কান্না পায় কান্না চেপে সিটা থেকে উঠে দাঁড়ায় কিনতু বের হতে পারে না
টিপু কী করবে ভাবছে জানালা দিয়ে লাফ দাও খোকা পাশের ভদ্রলোক বলে ভদ্রলোকও বের হতে পারেনি টিপুর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল টিপু লাফ দিতে চেষ্ট করে কিন' পারে না প্রচন্ড শব্দে বাসের ডিজেল ঠ্যাঙ্ক বাস্ট করে আগুর লেগে যায় পেট্রোল বোমার আগুনে লকলকে আগুনের শিখা জানালা দিয়ে বাসের ভেতরে ঢুকে যায়ভদ্রলোক ওকে জানালা থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করে পারে না নিজে িপড়ে যায় পেছনের যাত্রীদের পায়ে হাত পা থেতলে যায় থেতলে যায় পিঠ পুরো বাসে তখন আগুন লেগে গেছে  টিপুর গায়ে আগুন

টিপু উঠতে চেষ্ট করে কিন' পারে না দুই হাত ওপরে তুলে ডাকে বাবাকে, মাকে বাবা, বাবা, মা বলে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে চায় পারে না লুটিয়ে পড়ে বাসের আগুন ধরা সিটের ওপর