মাছ
তিন ভাইবোনের মধ্যে আমি সবচেয়ে ছোট। দিদি সবার বড়, তারপর দাদা । বাবা প্রাইমারী স্কুল টিচার। বাবার
অল্পআয়েই গুছিয়ে সংসার করত মা। টানাটানির সংসারে ভাত কাপড়ের অভাব হয়ত ছিল না তবে
বিলাসিতা শব্দটার বাড়ীতে প্রবেশ নিষেধই ছিল। এখনও মনে পড়ে, কালেভদ্রে বাড়ীতে আমিষ হত আমাদের। তিন ভাইবোনের
জন্মদিনে মুরগী,
শুধু অষ্টমী পূজোর দিন মাংস। বাকি
মাসের প্রথম দিনগুলোয় আমিষ বলতে ডিম বা মাছ। বাড়ীতে মাছ হলে দিদির পাতে মাছের মাথা
কিংবা লেজা পড়ত,
ছোটমাছ মা খেতে পারত না তাই সেটাও
দিদির ভাগেই যেত। দিদি কিন্তু মাছ পেলেই নিজের ভাগের একটুকরো মাছ কাঁটা বেছে তুলে
দিত আমার পাতে। মা, আমাদের সবার খাওয়াদাওয়া শেষ
হলে, ভাত নিয়ে বসত।তলানী ডাল কি তরকারী, সাথে পেঁয়াজ কি বাগানের লঙ্কা, লেবু, ঘরে
বানানো আচার। মা বলত, মা নাকি আমিষে গন্ধ পায়, তাই খায়না। জানতাম কথাটা নির্জলা মিথ্যে। যেদিন বাবার
ছুটি থাকত আর ঘরে মাছ বা ডিম হত সেদিন কিন্তু বাবা এঁটোহাতে বসে থাকত মায়ের খাওয়া
শেষ হওয়া অবধি। মা কিন্তু তৃপ্তি করেই খেত সেদিন। দিদিটা বড্ড মাছ ভালবাসতো।
মাঝেমধ্যে মাছ কেনার পয়সায় টান পড়লে বাবা মাছের মাথাটাই শুধু আনত। ছ্যাঁচড়া বা
চিড়েভাজা দিয়ে মুড়িঘন্ট বানাতো মা। কিংবা ভেটকি মাছের মাছ ছাড়ানো কাঁটা দিয়ে
কাঁটার চচ্চড়ি। কাঁটা আমি খেতে পারতাম না। দাদাও না। দিদি কিন্তু সোনামুখ করে খেত।
লক্ষ্য করে দেখেছিলাম একটু বেশী ভাতই যেন সে সব দিনে দিদির পাতে দিত মা।
দিদির যখন বিয়ে হয় তখন আমি সবে ক্লাশ এইট। দাদা পলিটেকনিকে পড়ছে।
বর্ধিষ্ণু যৌথ পরিবার,মা বলত দিদির খাওয়ার অভাব
হবে না। লক্ষ্মীমন্ত, কম কথা বলা দিদিটার একটু
ভালমন্দ খাওয়া নিয়ে মায়ের খুব চিন্তা ছিল। মাধ্যমিক পাশ করার পর স্টার পাবার খবর
নিয়ে দিদির শ্বশুর বাড়ী গেছি, দিদি
তখন রান্নাঘরে,
কি খুশী আমার রেজাল্ট শুনে। দুপুরে
পৌঁছেছি। বাড়ীর ছেলেদের সাথে খেতে ডাকলেও জেদ করে বসে আছি দিদির সাথে খাবো। বাড়ীর
ছেলেদের, বাচ্চাদের, শ্বাশুড়ী
ও তুতো শ্বাশুড়ীদের খেতে দেবার পর দিদি আর ওর জা যখন খেতে বসলো আমার তখন খিদেতে
পেট চুইচুই করছে। ঠিক আমার মায়ের মেনু, বাড়তি
দুটো মাছের ডিমের বড়া ভাজা। শক্ত, ঠান্ডা।
আমার পাতের পাশে বাটিভর্তি মাছের ঝোল। দিদি সে বড়াদুটোও আদর করে আমার পাতে দিয়ে
হুবহু মায়ের মতই বললো, - বুঝলি
ছোটকু আজকাল আমিষে বড্ড গন্ধ পাই। একদম খেতে পারিনা। এ দুটো খেয়ে নে তো ভাই।
অভিনয় না বোঝার বয়স তখন আমার নয়। বাড়ী ফিরে মাকে কিছু বলিনি। পূজোয়
দিদি এসে মায়ের রান্না আমিষ কিন্তু চেটেপুটে খেয়েছিল। পরের বার দিদির শ্বশুরবাড়ী
গেছিলাম আরো দশ বছর পর। মাঝে বাবা চলে গেছেন,দাদাও
আর নেই। জামাইবাবু তো তার আগেই গেছেন। আমি চাকরীসূত্রে বাঙ্গালোরে থাকি,মা আমার কাছেই থাকেন। নিজের রোজগারে নতুন কাপড়, জোড়া ইলিশ, মিষ্টি
নিয়ে গেছিলাম। দিদির শ্বাশুড়ী বলেছিলেন, বিধবা
মেয়েছেলে মাছ খায় না। বরঞ্চ রাতে তো ভাত খায় না, সাবুজলের সাথে দুটো মিষ্টি খেয়ে নেবে’খন। দিদির তখনকাল ম্লান হাসিটা এখনও আমার চোখে জল আনে।
চশমা খুলে চোখের কোনে জমা জলের ফোঁটা রুমালে মুছছি,হন্তদন্ত হয়ে সন্তু মানে আমার একমাত্র ভাগ্নে ঢুকলো, - মামা, সবাই
বলছে শ্রাদ্ধের দিন নাকি মৃতজনের প্রিয় খাবার নিমন্ত্রিতদের খাওয়াতে হয়। মা কি
খেতে ভালবাসতো বলো দেখি। দেওয়ালে
টাঙানো মালা চন্দনে সাজানো ছবিতে দিদির হাসিমুখটা দেখতে দেখতে বল্লাম “মাছ”।