গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৮

কৃষ্ণা দাস

চম্পা

            সারাদিন ট্রেনে মোবাইল কভার চার্জার বিক্রী করে রাতে স্টেশনে নেমেই প্রথমে বিশে চাকলাদারকে পাওনা বুঝিয়েই বিপুল তড়িঘড়ি স্টেশন ছেড়ে বেরল । স্টেশনের ঘড়িতে তখন নটা পঁয়ত্রিশ।
            স্টেশনের পাশেই বুড়ো মন্টার সাইকেল সারানোর দোকান । তারই পাশে কচু গাছের জঙ্গলের ধার ঘেঁসে রাঙচিত্তের বেড়া দেওয়া এক ফালি জমিতে আজ বছর পাঁচেক সাইকেল জমা রাখার উপরি ব্যবসা ফেঁদেছে মন্টা । সাইকেল জমা রাখার দরুন মাস গেলে বিপুলকে পঁচিশ টাকা ভাড়া দিতে হয় । দোকানের পাশে এখন শুধু বিপুলের সাইকেলটাই দাঁড়িয়ে । মন্টার দোকান এখন টিমটিমে হলুদ আলোয় যেন ঝিমুচ্ছে । সামনে নীল প্লাসটিকের পর্দার ফাঁক দিয়ে ভেতরের কুপির আলো দপদপ করছে ।
            কাকা ঘুমুলে নাকি গো?” বিপুল পকেট থেকে তড়িঘড়ি চাবি বের করল ।
             বিপুলের ডাকে বুড়ো গলা খ্যাঁকারি দিল ঘুপচি টালির চালের দোকান থেকে, এটি তার আস্তানাও বটে ।
           হারামজাদা রোজ ইত্ত রাইত কইরে সাইকিল নিতে আইসিস তুর জ্বালায় ঘুমোনোর জো আছে বটে?”
            বিপুল চাবি দিয়ে তালা খুলে চেন খুলে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিলো ।
           কী করবো সবই পেটের দায়গো গো কাকা। নইলে কে বলো রাত বিরেতে সাইকেল নিতে আসে?”
            প্রত্যুত্তরে বুড়ো কাশতে কাশতে কী যেন বলল, কিন্তু বুড়োর কথা দাঁড়িয়ে শোনার মতো তখন বিপুলের সময় আর আগ্রহ কোনটাই নেই । সে খুব জোরে সাইকেল চালিয়ে দিল ।
            আকাশের দিকে তাকাল বিপুল । আকাশ যেন মিশমিশে কালো । তারা দেখা যাচ্ছে না । শ্রাবণ মাস কখন বলতে কখন হুড়মুড় করে নামে তার কী কোন ঠিক আছে? তাড়াতাড়ি ঘর পৌঁচ্ছালে হয় । বউটা না খেয়ে জেগে আছে ।
            রাস্তায় জনপ্রাণী নেই । এ রাস্তায় ভ্যান রিকসা সন্ধে সাতটার পর বন্ধ হয়ে যায় । শুধু গোটা দুই ঘিয়ে ভাজা কুকুর ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে রাস্তার এ পার থেকে ওপার হল । পিচঢালা বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে ঘুরে খোয়া ঢালা রাস্তা ধরে সন-সনিয়ে চলেছে বিপুল । রাস্তার দুদিকে নিচু জমি এখন জলে টইটুম্বুর । এই রাস্তায় পিচ হবে তাই জায়গায় জায়গায় স্টোনচিপ খোয়া ডাঁই করা তা প্রায় দুমাস ধরে । পথচারী বা পিডব্লুডি কারুরি যেন কোন গা নেই । হচ্ছে হবে মনভাব । অথচ রোজ এই পথে সাইকেল চালাতে যে কী অসুবিধা হয় সে শুধু ভুক্তভুগিই জানে । তার ওপর রাতের দিকে আলো নেই, যদিও লাইটপোষ্ট আছে । সাইকেলের ডায়নামো লাইটই ভরসা । বিপুল মিনিট কুড়ি জোরে সাইকেল চালালেই ঘরে পৌঁছাবে । তাই সে যতটা সম্ভব জোরে সাইকেল চালাতে থাকল ।
             ঘামে পরণের সার্টটা ভেজা । লম্বা, সুস্বাস্থ্য, টিকালো নাক, এক মাথা বড় বড় চুল, ও কায়দা গোঁফে তাকে বেশ ভারিক্কিই লাগে । বয়সটা যে সাতাস আঠাশের আসে পাশে দেখে মনে হবার জো নেই । কেতাদুরস্ত চুলে সময় সময় হাত দিয়ে আঁচড়ে নেয় হিন্দি সিনেমার নায়কের কায়দায় । নীল জিনসের পিছন পকেটে চিরুণি থাকলেও তার বড় একটা ব্যবহার হয় না । পায়ে সস্তার স্নিকার, আর গায়ে বডি স্প্রে দিয়ে সে যখন ট্রেনে মোবাইল চার্জার, কভার বিক্রি করে তখন লোকে দুএকটা না নিয়ে পারে না ।
            একটু দূর থেকেই একটা দুটো পাকা নতুন বাড়ি উঠেছে । কিন্তু এখন গৃহস্থের বাড়ির দরজা জানলা বন্ধ । তাদের বাড়িগুলো যেন অন্ধকারে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ । এর পর বটতলা পর্যন্ত দুপাশে শুধু ধান খেত । আর কোন বাড়ি নেই ।
            বাড়ি ফেরার এই সময়টা বিপুল যেন নিজেকে খুঁজে পায় । দূরে কোথায় কদম গাছে ফুল ফুটেছে তারই গন্ধে চারিদিক ভেসে যাচ্ছে । সেই সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে এই ঘরে ফেরা । ছমাসের পুরোনো তার কিশোরী বউটা ভাতের থালা নিয়ে বসে আছে । গনগনে খিদের আঁচটা রোজ স্টেশন ছাড়ালেই পেটের মধ্যে দাউদাউ করে । তাকে ধামাচাপা দিতেই সে পুরো পথটা নিজের সাথে নিজে কথা বলতে বলতে আসে । কখনো বা জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার গান গুনগুন করে দুকলি গায়ও।
             কিন্তু আজ তার মনটা ভালো নেই । সব মিটিয়ে আজ হাতে মাত্তর দুশো কুড়ি টাকা থাকল । অন্য দিন নিদেন পক্ষে তিনশো থাকে, কখনো কখনো চারশো সাড়ে চারশোও হয় । সারাদিনের এত পরিশ্রমের মূল্য মাত্তর দুশো কুড়ি, এর চেয়ে কুলিগিরীও যে ভালো । ভাবল আর এ লাইনে থাকবে না । যদি কিছু টাকা থাকত তবে স্টেশনের ধারে এই রাস্তার পাশে একটা গুমটিঘর বানিয়ে চায়ের দোকান দিত । এ তল্লাটে চায়ের দোকান যতই হোক তবু কারো কখনও লস হয় না ।  কথাটা অবশ্য মনু বাড়ুজ্জে মাথায় ঢুকিয়েছে । তবে মিথ্যে বলেনি সে, বিপুল নিজের চোখেই দেখেছে চা পান দোক্তা বিড়ি সিগারেট গুটখার দোকানগুলোর সামনে সবসময়ই খদ্দের থাকে । ওই একটাই ব্যাবসা যা কোনদিন পুরনো হয় না ।
           মনু বাড়ুজ্যে তো বলেইছে বেশি নয় তুই হাজার তিরিশেক দিস তাতেই হবে, আমার বাড়ির সামনেটাতেই দোকান করিস, আমি লিখে দেবকিন্তু হাজার তিরিশ কি আর চাট্টিখানি কথা? রোজ নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তার ওপর বউটার দিনদিন খাঁই যেন বাড়ছে। বাড়ি ঢুকলেই এটা নেই সেটা নেই, চাল নেই, ডাল নেই, তেল নেই, আলু নেই, সেসব জোগাড় হলেই কাপড় চাই, ব্লাউস চাই, মাথার ফিতে, কাজল পেনসিল, লিপিসস্টিক, শ্যাম্পু, সাবান, চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। পয়সাটা আর জমবে কেমনে? বিক্রির টাকার ষাট ভাগই মালিক নেয়, দশ ভাগ এলাকার দালাল, আর পাঁচ ভাগ রেল পুলিশ । তবে আর বাকি রইল কী? ওই সামান্য পঁচিশভাগ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা ছাড়া উপায় কিছু নেই । এই জন্যই বিপুল বিয়ে করতে চাইছিল না, জ্যাঠা ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে নিজেই পালিয়ে গেল। এখন তুমি মরো।
            মা বাপের কথা মনে পড়ে না আর। স্টেশনে ঘুরে ঘুরে মনিহারি জিনিষ বিক্রি করতো হরেন জ্যাঠা  বন্যায় হরেন জ্যাঠার বউ ছেলে যে বছর ভেসে যায় সে বছরেই তাকে নাকি স্টেশন চত্তরেই ঘুরঘুর করতে দেখে সবাই মিলে গছিয়ে দিয়েছে হরেন জ্যাঠার গলায় । বিপুল নামটাও হরেন জ্যাঠারই দেওয়া যখন সে বছর চারেক । তাতে যেন দুজন দুজকে পেয়ে বেঁচে যায় । ওই হরেন জ্যাঠা নেহাত বললে, “আমি আর কতদিন, ওরে বাউন্ডুলে, মেয়ের বাপ নেই মা নেই, মামার ঘরে দুরছাইএ মানুষ, ওকে বে কর। তোরও ঘর আগলাবার লোক হবে আর মেয়েটাও জেবন পাবেতাই করা নইলে সুখে থাকতে কি কেউ খরচা বাড়ায়? তা এমনই কপাল বিয়ে দিয়েই হরেন জ্যাঠা পুট করে মরে গেল । কী? না এসস্ট্রোক, দিব্যি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কখন মরে গেল, না কাউকে জ্বালাল না নিজে জ্বলল । আর অমনি পুরো সংসার মাথায় এসে পড়ল, একেই বলে ভাগ্য ।
           অন্যমনস্ক হয়ে সাইকেল চালাচ্ছিল বিপুল, হঠাৎ কানে এল আর্তনাদ, “বাবা গো!”
           কয়েক সেকেন্ডে বিপুল বুঝল রাস্তার ধার থেকে শব্দটা এসেছে । সাইকেলের ডায়নামো লাইটে দেখল শালোয়ার কামিজ পরা একটা মেয়ে রাস্তার ধারে বসে পড়ে গোঁঙাচ্ছে । সাইকেল থেকে নেমে কাছে গিয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
           মেয়েটি আধো অন্ধকারে মুখ তুলে তাকাল । তার ডাগর চোখে চিকচিক করছে জল। সাইকেলের আলো ফেলতেই বিপুলের ঠোঁট দিয়ে অস্ফূট শব্দ বের হল ।
           চম্পা!”  
            চম্পাও ব্যাথা ভুলে অপলকে তাকায় বিপুলের দিকে । বিপুল দেখল তার শৈশবের খেলার সাথী,  মাধ্যমিকে স্টার পাওয়া, তার না বলা প্রথম প্রেম, অপরূপা চম্পা । যদিও একই গ্রামে বসবাস তবুও তার সাথে শেষ কথা বহুদিন আগে, যখন সে বিদ্যা সুন্দর উচ্চ বিদ্যালয়এ একই ক্লাসে পড়ত । এমনিতেই সে একটু বড় বয়েসেই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল তার ওপর কোনও কোনও ক্লাসে দুবারও পড়েছে । তার পর মাধ্যমিকে অঙ্ক, ইংরাজি, আর বিজ্ঞানে ব্যাক পেয়ে যেমন পড়াশোনাও ছেড়ে দিল, তেমন লজ্জাতে চম্পার সামনেও আর যায়নি কখনো।
          আজ এত বছর পর চম্পাকে দেখে বিপুল বিষ্ময়ের সাথে বলল তুমি”?
          চম্পা সে সবে উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার যন্ত্রণায় কঁকিয়ে বসে পড়ল । বিপুল সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে পাশে বসে দেখল চম্পা বাঁ পাটা ধরে যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাচ্ছে ।
         কী হয়েছে বলবে তো”?
        পা মুচকে গেছেচম্পার মুখ যন্ত্রণা কাতর
         বিপুল দেখল পাশে চম্পার হিল জুতোটা পড়ে আছে ।
         এই অসমান এবড়োখেবড়ো খোয়া ওঠা রাস্তায় এই ভাবে রাতে হিল জুতো পরে কেউ হাঁটে? পা তো মচকাবেই । আমাকে ধরে দাঁড়াও তো দেখিবিপুল যেন আদেশ করল
         পারবো না, আমি পারবো নাচম্পা ডুকরে উঠল ।
          আরে তা হলে কি সারা রাত এখানেই পড়ে থাকবে?
           বিপুল জুতো দুটো মুহুর্তে সাইকেলের রডে ঝুলিয়ে দিল।
           আমাকে ধরে আস্তে আস্তে সাইকেলের সামনেটায় বসো আমি বাড়ি পৌঁচ্ছে দিচ্ছি
            চম্পা চেষ্টা করল বিপুলের শরীরের সাহায্যে উঠে দাঁড়াতে কিন্তু কোন রকমে দাঁড়িয়েই বলল, “নাঃ আমি সাইকেলে বসতে পারবো না
            বিপুল এক ঝটকায় চম্পাকে পাঁজাকোলা করে তুলে সাইকেলের রডে বসিয়ে দিল । ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে চম্পা বিপুলের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল । রডে বসেও সে গলা না ছেড়ে শক্ত হয়ে থাকল ।
            বিপুলও শক্ত হয়ে গেল কয়েক সেকেন্ডেই । বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা লাফাতে লাগল এমন জোরে যে বাইরে থেকেও বুঝি তার আওয়াজ পাওয়া যাবে । তীব্র শ্বাসের আওয়াজে যখন সে নেশাগ্রস্থ তখনই দুএক ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । দুজনেই শশব্যস্ত হয়ে উঠল । বিপুল দেখল এত কিছুর মাঝেও চম্পা কাঁধের মাঝারি মাপের ফুলকারি কাজ করা ব্যাগটি ছেড়েনি । সে সিটে বসে সাইকেল ছেড়ে দিল ।
            চম্পা কিছুই বলছেনা । তার খোঁপা ছাড়া চুল গুলো বিপুলের চোখে নাকে লাগছে । অদ্ভূত এক সুগন্ধ চম্পার গা থেকে বেরিয়ে বিপুলকে ঘিরে রেখেছে । বিপুল ঘাড় থেকে মাথাটা যথাসম্ভব সামনে এগিয়ে এনেছে যেন সাইকেল চালানোর ভারসাম্য বজায় রাখতেই । কেবলই মনে হচ্ছে এ বুঝি স্বপ্ন, বাস্তব নয় ।
            এত রাতে এলে কেন”? বিপুল জানে চম্পা কোলকাতায় হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে ।
            এম এস সি ফাইনাল এগ্জাম ছিল আজ, আজই শেষ । পরীক্ষা দিয়ে আসছি । তাই লেট । মা অসুস্থ
            কী হয়েছে”?
            বমি পায়খানা কাল থেকে, ডাক্তার দেখেছে, কিন্ত ওষুধ ধরছে না, কাল সকালে হসপিটালে ভর্তি হবে । বাবা ফোনে করল
            চম্পা বড় ঘরের মেয়ে । তাদের জ্যাঠা কাকা মিলে বনেদি পরিবার কেউ কলকাতায় ডাক্তার, কেউ বিডিও, কেউ বড় ব্যাবসায়ী । এমন এক পরিবারের মেয়েকে না বুঝে ভালোবাসা যায় কিন্তু ভালোবাসার কথা বিপুলের মত ছেলের মুখে শোভা পায় না । তাই সে কখনো চেস্টাও করেনি সে কথা জানানোর ।
          দুজনে আবার চুপ, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বড় হচ্ছে । বিপুল ভাবল এ ভাবে গেলে পুরো ভিজে চান হতে সময় লাগবে না । রাস্তার ধারে কোথাও কোনও বাড়িও নেই । কোথাও যদি একটু দাঁড়ানো যেত !
          বাড়ি যেতে যেতে পুরো ভিজে যাব যে”? চম্পা বলল ।
           কোথায় দাঁড়াবে বল? কিছুতো নেই?”
           তুমি দুর্গাবাড়ি চল
            দুর্গাবাড়ি রাস্তা থেকে ডান দিকের বটতলার মুখেই । বিপুল চম্পার কথামত দুর্গাবাড়ির চাতালে পৌঁছে যেতেই চম্পা বলল আমি নামবো না, পায়ে জোর নেই । তুমি সেডের তলায় সাইকেল নাও
            বিপুল তাই করল । ঝমঝম করে বৃ্ষ্টি নামল ঠিক তখনই । চম্পা বলল কটা বাজে?”
            বিপুল রুমাল পেঁচানো হাতের কবজি কায়দা করে উল্টে বলল, “দশটা পাঁচ
            তাতে চম্পার কোন তাপ উত্তাপ নেই । সে তার ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সুইচ অফ করে দিল ।
            বিপুল ভেবেছিল চম্পা বুঝি বাড়িতে ফোন করছে । একটু পরে মোবাইলটা ফের ব্যাগে ঢোকাতে দেখে বলল, “কি হল লাইন পেলে না”?
           চম্পা কিছু না বলে হাসল । হাসলে ওর থুতনিতে একটা আদুরে টোল পড়ে । আগে আগে বিপুল  হাঁ করে তাকিয়ে থাকত ওর মুখের ওই টোলের দিকে, খুব অসহায় হয়ে যেত এমন হাসি মুখ দেখলে । আজ সে একপলক দেখেই বাইরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক হতে চাইল । কিন্তু ঘুরে ফিরে তার পুরনো কথাই মনে পড়ছে । ছোট বেলা পাড়ায় চরকের মেলায় হরেন জ্যাঠাকে বলে বলে একটা কাঠের খেলনা ট্রেন কিনিয়েছিল । মেলায় চম্পা যখন ওর ট্রেনটা দেখল ওমনি সে তার মার কাছে বায়না ধরল অমন একটি ট্রেন কিনে দেবার জন্য, দোকানদার জানায় অমনটি ওইটিই শেষ, সব বিক্রি হয়ে গেছে । ব্যাস মাটিতে পড়ে চম্পার সেকি কান্না । সবাইকে অবাক করে বিপুল তখন নিজেরটি ওর হাতে তুলে দেয় । সবাই হাঁ, শুধু বাড়ি ফিরে হরেন জ্যাঠা খুব পিটিয়েছিল । তিন চার দিন সে ব্যাথা টনটনিয়েছিল ।
           বিপুলের মনে পড়ল সে যখন স্কুলে এইট তখন দোলের সময় চম্পা লুকিয়ে তাকে আবির ছুড়েছিল ছাদ থেকে, সেই থেকে দঙ্গলের মধ্যে থেকেও বিপুল একা । বন্ধুরা তাকে ঠেলে ঠুলে বাড়ি এনে বলেছিল জ্যাঠা বিপুলের কী হয়েছে গো? কথা বলে না, দোল খেলে না, দেখো
          তখন বিপুল রোজ বিকেলে বাড়ির কাছের মাঠ ছেড়ে কাছারি মাঠে ফুটবল খেলতে যেত আর মাঝে মাঝে মাঠের পাশে হলদে পাকা দোতলা বাড়ির দিকে তাকাত । এমনিতে সে মোটেই ভালো ফুটবল খেলতো না কিন্তু যেই চম্পা এসে ছাদে দাঁড়াতো তখন বিপুলকে পায় কে? মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে বিপক্ষ দলকে কাটিয়ে কুটিয়ে বল একে বারে গোলে । হঠাৎ হঠাৎ তার এই অদ্ভূত উন্নতির কোনও কারণ বন্ধুরা খুঁজে না পেয়ে সবাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত তার দিকে। আর সে তখন মাথা নীচু করে লজ্জা পেত ।
           কী এত ভাবছো?” চম্পার ডাকে বিপুল যেন একটু কেঁপে উঠল ।
          কই না, কিছু না
          শুনলাম বিয়ে করেছ
           বিপুল লজ্জা পেল, বলল, “জ্যাঠা জোর করে………
          বউ এর নাম কী?”
          বিপুলের মুখ ফসকে বেড়িয়ে যাচ্ছিল ভোঁদরসামলে নিয়ে বলল, “লক্ষ্মীমনি সোরেনবউটা তার পুকুরে নামলে সহজে ডাঙায় ওঠে না । কখনো পা দিয়ে জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটে তো কখনও ছাঁকনা জালে মাছ ধরে । মাছ খেতে এত ভালবাসে দেখে বিপুল তাকে ভোঁদর বলেই ডাকে । তাতে রাগ তো মোটেই করে না উল্টে হিহি করে হাসে ।
           অ তুমি সাঁওতাল বিয়ে করেছ বুঝি” ?
          কেন আমিও তো সাঁওতাল, বিপুল মুন্ডাবিপুল বুক চিতিয়ে বলল ।
          মুন্ডা তো তোমার হরেন জ্যাঠার পদবি, তুমি তো…………………..”
          বিপুল চম্পার অসমাপ্ত কথার অর্থ বুঝল । দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “আমিও মুন্ডা, এই পদবি আমার কাছে আশির্বাদ ।
          বিপুলের মনে পড়ল ছোটো বেলায় তার টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁট, আর গৌর বর্ণ দেখে পাড়ার লোকে বলতো, “এ নিশ্চই কোন উচ্চ বংশের ছেলে ছিল গা । ভাগ্যের পরিহাস দেখো!”
          এসব নিয়ে কখনো ভাবেনি বিপুল । সে হরেন মুন্ডার স্নেহের ছায়াতেই তরতর করে বেড়ে উঠছিল ।
         বৃষ্টিটা ধরে এল । এতক্ষণ সাইকেলটা দুহাতে ধরেছিল বিপুল কারণ চম্পা এক দিকে পা ঝুলিয়ে বসে আছে । বিপুল বলল, “এবার চলি, বৃষ্টি ধরে গেছে
         চম্পা হ্যাঁ না কিছু বলল না ।
          বিপুল সাইকেলটা সেডের বাইরে এনে দেখল রাস্তায় জল জমে গেছে । উপায় না দেখে সে সিটে না বসে দুহাতে সাইকেল ধরে পাশে পাশে হেঁটে চলল ।
           চম্পা হঠাৎ বলল, “তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে”?
           কই নাতো?”
           তবে এত চুপ কেন”?
           আমি?”
           হ্যাঁ”,
           কই?”
          তবে কিছু বলছো না যে”?
          কী বলবো”?
           যা খুশি
            কী বলবে বুঝতে না পেরে বিপুল ফস্ করে জিজ্ঞাসা করে বসল-
              তুমি বিয়ে করবে না?”
               চম্পা অদ্ভূত হেসে উঠল।
              কী হল? ভুল কিছু বললামবিপুল অস্বস্থিতে পড়েছে ।
             নাঃ
             তবে?”
               ছেলে কই”?
               এবার বিপুল হাসল, তবে মনে মনে। মুখে বলল ছেলের অভাব”?
              অভাব ঠিক নয়, তবে তোমার মত কই”?
               কেঁপে উঠল বিপুল । নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না । সে দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ ।
                চম্পা বিপুলের দিকে তাকাল, বিপুল চোখ নামিয়ে নিল । চারিদিকে ব্যাঙ ঝিঁঝিঁ ডাকছে, গাছের পাতা থেকে টুপটুপ করে জল ঝরে পড়ছে, সব মিলিয়ে এ এক অন্যরকম জগৎ মনে হচ্ছে বিপুলের ।
               মনে পড়ল কিশোর বয়েসে শালডিহির মাঠে পৌষ মেলায় লুকিয়ে উল্কি করিয়েছিল ঘাড়ে, ‘চম্পা চুল বড় থাকায় কেউ তেমন দেখতে পায়নি, কিন্তু জ্যাঠা মরলে ন্যাড়া হতেই তা বেরিয়ে পড়ল । তার পর সেকি লজ্জা । কানাই নাপিত হেসে বলেছিল, “দাদা গো, তোমার চম্পা যে বেরিয়ে পড়ল গো, এখন কি হবে”? মুহুর্তে বিপুল মাথায় কাছার প্রান্ত জড়িয়ে নেয় চম্পা যে কখন তার শরীরের সাথে মিশে গিয়েছিল তা সে নিজেই বোঝেনি ।
              আকাশে মেঘ কেটে কখন যেন চাঁদ উঁকি দিয়েছে । তার আলোয়  বিপুল আবিষ্কার করল চম্পা দুহাতে তার মাথা কাছে টেনে ঘাড়ের চুল সরিয়ে উল্কির ওপর তার তপ্ত ঠোঁট চেপে ধরেছে । বিপুল গলে যেতে যেতে শুনতে পেল চম্পা ফিসফিস করে বলছে, “সারা জীবন এভাবেই চম্পাকে মনে রেখ
            কয়েক মুহুর্ত, তার পরই বিপুল সোজা হয়ে দাঁড়াল । গম্ভীর হবার ব্যর্থ চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল উল্কির কথা চম্পা কী করে জানল?
            চম্পার দিকে অসহায় চোখে তাকাতেই চম্পা বিপুলের চোখ দেখে প্রশ্নটা বুঝে গেল।মৃদু স্বরে বলল, “আমি সওব জানি। কানাইদা সব আমাকে বলেছে। পাগল ছেলে এ ভাবে কেউ ভালোবাসে?”
           হঠাৎ বড় অভিমানে বিপুলের দুচোখ ভিজে গেল। সে মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে ধরা গলায় জোর এনে বলল, “রাত হয়েছে, এবার ঘর যেতে হবে,বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে
              চম্পা কি আহত হল? ঠিক বুঝলো না বিপুল, সে জল ভেঙে এগুতে থাকল কাঁছারি বাড়ির পথে । দুজনেই চুপ । একটু পরেই চম্পাদের বাড়ি দেখা গেল । বিপুল তাদের গাড়ি বারান্দায় চম্পাকে নামিয়ে সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে নিল । চম্পা বলল, “সাবধানে যেও
              বিপুল অস্ফূটে বলল, “ভালো থেকো”, কিন্তু তা এতই আস্তে যে চম্পার কান পর্যন্ত পৌঁছল না ।

              বাড়ির কাছে এসে আজ আর কানে এলনা টিভির উচ্চ আওয়াজ । বছর খানেক হল স্টেশনের পাশে টিভি সারাই এর দোকান থেকে সেকেন্ডহ্যান্ড টিভিটা দুহাজারে কিনেছিল । ওটা নিয়ে বউটা সারাদিন একাই কাটিয়ে দেয় । বিপুল বাগানের চাঁচারির গেট খুলে দাওয়ায় সাইকেল তুলে হাঁক দিলো, “ভোঁদর?” মাটির ঘরের ভেতর থেকে কোন আলো বা আওয়াজ এলো না । বিপুল গলা আরো চড়িয়ে বলল, “ভোঁদর দরজা খোলতাও কোনও শব্দ নেই বিপুল ভেজানো দরজায় হাত দিতেই খুলে গেল হাট করে ভেতরে ঢুকে দেখে টিভি চলছে শব্দহীন ভাবে আর ভোঁদর টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে কাদা তক্তপোষের ওপর । তার মুখ ঢেকেছে নরম চুলের ঢল, তার আলুথালু বেশ, আলতা পরা কালো নিটোল দুটি পা লাল শাড়ির নীচ থেকে উঁকি দিচ্ছে । বিপুল বুঝল অপেক্ষা করতে করতে বউ তার ঘুমিয়ে পড়েছে । মনটা বড় নরম হয়ে গেল । সাইকেলটাকে ঘরে ঢোকাতে গিয়ে দরজায় মাডগার্ড লেগে আওয়াজ হতেই ভোঁদর ধরমড় করে উঠে বসল । হাই দিখো এই ইত্ত রাইতে তুমার আসার সময় হইল গো” ?
                কী করবো পেটের দায় যে!”
                তাই বুলে ইত্ত রাত? বলি ইমন তো হয় নাই আইগ্যে
                কী করবো ? ট্রেন লেট করল যে
                কিনও বটে”?
                আর কেন? ট্রেনে কাটা পড়ল কিনা
                কী বটে”?
                এক জোড়া ছেলে মেয়ে
                 হাই দিখঅ! কিনঅ বটে”?
                 কেন তা কী করে জানবো? তবে প্রেম পিরিতি হবে বোধ হয়
                 অমনি বউ তার গালে হাত দিয়ে ডাগর ডাগর চোখে ছলছলা । বিপুল জানে তার এই মিথ্যেগুলো সত্যি ভেবে বউ তার কাল্পনিক চরিত্রগুলোর ব্যথায় জজ্জরিত । বউটা যে তার বড্ড সরল ।
                 বিপুল তাকে বেশি কষ্ট দিতে চায় না, তাই তড়িঘড়ি বলল, “ভাত দে রে ভোঁদর, খিদেয় নাড়ী জ্বলছে
              বউ বলে, “হাত ধুকে আইসঅ কেনে?”
              বিপুল প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরে । হাত ধুয়ে উদলা গায়ে পিঁড়ির ওপর উবু হয়ে বসল। সামনে এক কাঁসি ঠান্ডা ভাত, পাশে নুন, দুটো কাঁচালঙ্কা, কাঁচা পিঁয়াজ আর আলু ভাজা ধরে দেয় লক্ষ্মীমনি । এই মুহূর্তে এর চেয়ে লোভনীয় খাবার বিপুলের কাছে আর কিছু নেই ।
              তুই খেয়েছিস”?
                , বড় খিদা লাগসিল, তুমার তরে বইসে বইসে কুখন চোখ লেইগ্যে গেল…………
                বিপুল ভাত খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে তক্তপোষে গিয়ে বসল । লক্ষ্মীমনি এঁটো পেড়ে দরজা লাগিয়ে কাছে আসতেই বিপুল তাকে দুহাতে কাছে টেনে বলল, “আমি তোকে আজ থেকে যদি চম্পা বলি তুই কি রাগ করবি”?
                হাই দিখঅ ! আবার কী হইল? লক্ষ্মীমনি হইল ভোঁদর । ইখন ভোঁদর হইবেক চম্পা”?
                বিপুল তাকে বিছানায় পেড়ে ফেলে সোহাগ সোহাগে পাগল করতে করতে ফিস ফিসিয়ে বলে উঠল, “ চম্পা, চম্পা, চম্পা
               অমনি বউ তার খিল খিলিয়ে হেসে উঠল ।
               বাইরে তখন খটখটে জ্যোৎস্নায় গাছপালা, পুকুর, উঠোন পথ, ঘাট সব সাদা, যেন ভরা জ্যোৎস্নার বান ডেকেছে, সবকিছু ভাসিয়ে ধুইয়ে নিয়ে যাচ্ছে ।