গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৮

রত্না ঘোষ


দিশেহারা

ঘুম ভাঙতেই দেখি কাচের জানালা ভেদ করে সূর্যের আলো এসে পড়ছে বিছানায় । তাড়াতাড়ি বালিশের কাছে রাখা মোবাইলে সময় দেখে আঁতকে উঠি। ----"আটটা দশ ওরে বাবারে ! খুব দেরি হয়ে গেছে। সমস্ত কাজ শেষ করতে হবে । তিন দিন ধরে কাজের বউটা দেশে গেছে। আসবে আরো তিন দিন পর। তারমানে সবই করতে হবে বাসন মাজা ,ঘর পরিষ্কার করা সবই।উঃ আর ভাবতে পারছিনা।" তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে দাঁত ব্রাশ করে প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করে সবার আগে রান্না ঘরে ঢুকলাম। রান্নাঘরের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
কাল রাতে গ্যাসও মুছিনি ।চারদিকে তেল ঝোলের ছড়াছড়ি । অপরিষ্কার ভীষণ অপরিষ্কার ।অন্যের বাড়িতে এগুলো দেখে নিজেই নাক সিঁটকাই। আজ নিজের বাড়িতেই এই অবস্থা। মা যখন ছিল তখন সারা বাড়ি ছিল টিপটাপ। নিজে ওগুলো দেখে অভ্যস্থ বলেই কারো বাড়ি অপরিষ্কার দেখলেই মুখের উপর বলতে একটুও আটকাতো না। সিঙ্কের ভিতর ও বাইরে এঁটো বাসন স্তুপাকারে রয়েছে। ভাত আর মাছের কাঁটায় পিঁপড়েরা বনভোজন করছে । হয়তো আরশোলা টিকটিকি রাও ছিল তাদের সাথী কিন্তু আমার আগমনে তারা লজ্জায় লুকিয়ে আছে। আজ তিন মাস হল মায়ের অনুপস্থিতিতে আমি একা ঘর করছি ।বাবা মারা যাওয়ার পর মা আর আমি দুজন থাকতাম এই বাড়িতে। বাবার চাকরিটা পাই আমি। আমার কাজ ছিল সকাল ন'টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে স্নান খাওয়া সেরে অফিসে যাওয়া । মা ভাত মেখে খাইয়ে দিত। চুলে বিনুনি করে দিত। অফিস থেকে এসেই মুখের সামনে পেতাম চা আর টিফিন । " হঠাৎই ঘুমের মধ্যে তুমি চলে গেলে । আমাকে একা করে দিয়ে।" মায়ের ঘাট কাজের দিনই পিসতুতো দিদির পরামর্শে সবার আগে চুল ছোট করে ফেলি । ফলে অফিসে যাওয়ার আগে বিনুনী বাঁধার হ্যাপা সইতে হয়না। মা আমার ঘরের সব কাজ একা হাতে করতেন। অনেক বলেও কাজের লোক রাখতে পারিনি। মা চলে যেতেই কাজের লোকের উপর নির্ভর শীল হয়ে পরলাম। আর ও ছুটি নিতেই বুঝলাম মা কি জিনিস। কাল অফিস থেকে ফিরে নিজে নিজে চা করে খেয়েছিলাম ।সত্যি বলছি কোনো উপায় না থাকায় ওই চা পান করেছি । রাস্তার কুকুরও ওই চা মুখে তুলবে না । অফিস থেকে ফেরার সময় এক প্যাকেট বিরিয়ানি এনেছিলাম তা খেয়েই রাত কাটিয়েছি। মাঝে মাঝে রাগ হয়। অভিমান হয় মায়ের উপর।অনেক দিন মায়ের ফটোর সামনে গিয়ে বলেছি---- "তোমার এত তাড়া ছিল যাওয়ার ? আমাকে একেবারে অনাথা করে দিয়ে চলে গেলে? আর যাবেই যখন তখন কেন এভাবে আগলে রাখতে ? কেনো সবকিছু আমায় করতে দাওনি ?" না আজ আর ভাবার সময় নেই । তিনদিনের বাসন জমে রয়েছে ঘর ও ঝাঁট দিতে হবে। যে ভাবেই হোক সব কাজ শেষ করতে হবে। বাসন মাজতে মাজতে চোখের জল বাঁধ মানছে না। বুঝতে পারছি না এ কষ্ট মায়ের জন্য না নিজের জন্য।