কৌয়াপুত্তর
গ্রামছাড়িয়ে ধানখেত, তার ওপারে
হুই দূরে পাহাড়, সেইখানের কোথাও একটা জায়গা থেকে আসত ভীমলি -- আমাদের গ্রামের স্কুলে...
আসত মানে রোজ, -- ঝড়জলেও
কামাই নেই, -- এবং সবার আগে সকাল আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ -- একটা ছোটব্যাগে বইখাতা আর শালপাতায় মোড়া বজরার রুটি কয়টা নিয়ে।
নটা থেকে স্কুল শুরু।
মাস্টারমশাইরা খুব সিনসিয়ার, কেউ কেউ খুব কড়াও -- এতোগুলো ক্লাস একসাথে পড়লাম -- কেউই না -- কোন মাস্টারমশাইই ভীমলিকে কিছুই তেমন শেখাতে পারেন নি।
ফলে সে কোনই পড়া পারে না, হোমওয়ার্ক
করে আনে না, পরীক্ষায় সিংগল ডিজিট নম্বর পায় -- আর কড়া শিক্ষকদের ক্লাসে -- পড়া বলতে
না পারার শাস্তিহিসাবে দাঁড়িয়ে থাকে বাকী ক্লাস -- হাসিমুখেই
।
ভীমলি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড -- সূর্যঢলার
আগে বাড়ীর দিকে রওনা দেবার আগে বিকেলটা আমরা একসাথে কাটাই -- ও আমাকে নানান গাছ পাখী চেনায় আর বনের গল্প বলে।
টিফিনটাইমেও আমি খেলি না ওও না।
আমরা টিফিন ভাগ করে খাই আর এক দঙ্গল হইহইকরা ছেলেদের কল্লোলের মাঝে গলা উঁচিয়ে
আমরা গল্প করি। আমি জিগ্যেস করি ওকে ''তুই অতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সারা
ক্লাস কী করিস?'ঐ পড়া না পাড়লে অসীমবাবু তোকে যে কান ধরে বেঞ্চএর ওপর দাঁড় করিয়ে রাখে?''
ভীমলি হাসে আর নরম গলায় বলে ''আমি সিলিং
দেখি...ডেস্ক দেখি...সামনের সব
ছেলেদের মাথার পেছনটা দেখি -- জানলা
দিয়ে বাইরেটা দেখি -- কতরকম
প্যাটার্ন জানিস তুই? ছবির ভিতর
ছবি''। ভীমলি বলে
তারপর ''অমি -- তুই কালকে বরুণের সাথে শুধু শুধু ফাইট কেন করলি? আমায় বুদ্ধু গবেট এসব বললো বলে? আর করিস না ফাইট কারোর সাথে আমার
জন্য। দেখ আমিতো সবসময় খুশ থাকি, হ্যয় না বাত সহি?'' ভীমলি মাঝে মাঝে হিন্দিও বলে -- আমি দেখি সবসময়কার ওর মুখের শান্ত ভাবটি আর একটা শান্ত ''আল-ইস-ওয়েল'' ধরনের
হাসিটা...যেটা আমাকে আশ্চর্য করে। আমি বলি ''বেশ করবো -- মারবো যে কাউকে -- তোকে
বুদধু বললে'' -- ও হাসে। একটা মাটিমাখা বাতাস
দোলখায় দুটি ছোট্ট হৃদয়ে।
স্কুলের শেষ দুই বছরে ভীমলির ''দন্ডায়মান'' পর্ব শেষ
হলো -- আমরা ইয়ংগ অ্যডাল্ট ষোল-সতেরোর
বলে -- এছাড়া পার্থস্যার জয়েন করলেন সেবছর আমাদের আর্টটীচার হয়ে।
পার্থস্যার অসাধারণ একজন মানুষ -- চট করে আমাদের প্রত্যেককে বুঝে বনধু হয়ে গেলেন প্রত্যেকের -- শুধু আঁকা নয়...ওয়াল
ম্যাগাজিন...ডিবেটক্লাব...নাটক...গান...আবৃত্তি --- বছরশেষের
ট্যালেন্টশো --
পুরো স্কুলে একটা নতুন প্রাণ
আনলেন উনি। এবং ঘরে নয় শুধু বাইরেও -- প্রতি শনিবার আমরা
বেরিয়ে পড়লাম প্রকৃতির মাঝে -- দেখতে, শিখতে, অবাক হতে।
সবথেকে উপকৃত হলো ভীমলি! যেন একটা
প্রজাপতি-উত্তরণ -- একটা
মেটামরফোসিস হলো ওর!
প্রথম চমক -- পার্থস্যারের প্রথম আঁকার ক্লাসে -- আমরা শিখছি আঁকা -- মিডিয়াম
হলো চারকোল অন আর্ট পেপার। ভীমলির সাদাকালো আঁকা দেখে আমরা মুগ্ধ চমৎকৃত। ঐ যে বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে দেখতো! সেসব খুঁটিনাটি আর আমাদের প্রকৃতিভ্রমণের সব কী দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতো সে। আর্ট
তার ধ্যানজ্ঞান হয়ে গেল। আজকাল আমি মাধ্যমিকের পড়া নিয়ে ব্যস্ত -- ভীমলি অনেকটা সময়ই পার্থস্যারের সাথে কাটায়।
দ্বিতীয় চমক সেবছর শেষে স্কুলের
ট্যালেন্টশোতে । গান আবৃত্তি নাটক খুব দারুণ হলো -- গ্রাম ঝেঁটিয়ে লোক এসেছে আশপাশের গ্রাম থেকেও। সব শেষে ওমা -- পার্থস্যার দেখি স্টেজে মাইকের সামনে ভীমলিকে নিয়ে এসেছেন। ''দাঁড়ান, দাঁড়ান যাবেন না কেউ -- আপনাদের দারুণ একটি জিনিস দেখাবে এই ছেলেটি'' ।সবাই চুপ হলে ভীমলি ওর নরম গলায় বললো ''আমি আপনাদের কৌয়া...সরি...কাকের ডাক শোনাবো''। সবাই অবাক, মৃদু হাসাহাসিও -- কাকের ডাক? তার আবার কী নূতনত্ব? কী এমন আহামরি জিনিস?
ওমা...ভীমলি শুধু কাকের ডাক নয় পুরো একটা বন, গাছ, বয়েযাওয়াবাতাসে পাতার ঝিরঝিরি -- নানারকম ব্যকগ্রাউন্ড আওয়াজে সবটা যেন এনে হাজির করলো
অডিটোরিয়ামে। সবাই নিশ্চুপ ফুল কনসেনট্রেশন। ভীমলি দেখাল কাকের ছানারা কেমন ডাকে -- মা কেমন সাড়া দেয় -- ক্ষিধে
পেলে কেমন ডাকে কাক...রেগে গেলে
কেমন করে ডাকে -- মনখারাপ
হলে কেমন ডাকটি কাকের -- আর সুখীকাক? কেমন তার
ডাকটি?
একদম আলাদা আলাদা করে নিখুত
দক্ষতায় এমন ফুটিয়ে তুললো ভীমলি যেন আমরাও পারবো এবার থেকে বুঝতে -- যে কাকটি
বা কাকেরা বাইরে ডাকছে তারা ক্ষুধার্ত না রাগী -- আনহ্যাপী
না হ্যাপী?
একটি বাচ্চা ছেলে ভোর হলেই উঠে বাড়ীর খেতের কাজ সেরে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে আসে -- আবার সূর্য যখন ডোবে তখন কয়েক মাইল হাঁটতে হাঁটতে বাড়ী ফেরে। এই সারাটা সময় সে কাকের ডাক মন দিয়ে শুনেছে ও গেঁথে রেখেছে মনে। সেটাই উপহার দিল এই সরল সুখী খালিপায়ের ভীমলি সেদিন ।
একটি বাচ্চা ছেলে ভোর হলেই উঠে বাড়ীর খেতের কাজ সেরে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে আসে -- আবার সূর্য যখন ডোবে তখন কয়েক মাইল হাঁটতে হাঁটতে বাড়ী ফেরে। এই সারাটা সময় সে কাকের ডাক মন দিয়ে শুনেছে ও গেঁথে রেখেছে মনে। সেটাই উপহার দিল এই সরল সুখী খালিপায়ের ভীমলি সেদিন ।
তৃতীয় চমক মাধ্যমিকএর ফলাফলের
দিন। ওমা আর সিংগল ডিজিট নয় কো, বেশ ষাট পঁয়ষট্টি নম্বর পেয়ে সসন্মানে পাশ ভীমলি। আমি অবাক দারুণ খুশী বললাম 'ক্যায়সে?'' ও বললো ''তুই আমায়
অংক শেখাতি মনে আছে? আর বিজ্ঞান? ঐগুলোও তো প্যাটার্ন -- মনে গেঁথে গেছে আর বাকীগুলো বুঝা করি নিলাম পার্থস্যারের কাছে। বাস হোগিলবা!''
পার্থস্যার এসে হোগিলবাকে নিয়ে
খুব একচোট নাচানাচি।
ভীমলির সাথে শেষ দেখা আমার তখন
ইঞ্জীনিয়ারিং থার্ড ইয়র। শহরে হোস্টেলে থাকি টিউশনি করে খরচা মেটাতে হয় তাই খুব কম
বাড়ী যাওয়া হয়। ভীমলির আর পড়াশুনা হয় নি --- খেতিবাড়ী করছে শুনলাম। বেরিয়েছি একটু গ্রাম ঘুরতে দেখি
ভীমলি -- কী দশাসই চেহারা হয়েছে ওর -- চওড়া কাঁধ, ভরাট পেশী, পুরো গ্রীক গডএর ফিগার -- একটা ভ্যানে করে ওর ক্ষেতের সবজী এনে গ্রামে বিক্রি করছে -- আর একপাল ছেলেমেয়ে ঘুরছে পেছন পেছন ''কৌয়া-পুত্তর! কৌয়া-পুত্তর!'' বলে বলে। আর ভীমলি ওদের নানারকম কাকের ডাক শোনাচ্ছে।
আমায় দেখে চমকে সব ফেলে ''অমি তুউউ'' বলে দৌড়ে
এসে চেপে জড়িয়ে আর ছাড়ে না। চোখ ভর্তি জল। আমারও।
দুইবনধুর পাশাপাশি বসে অনেক গল্প
হলো অনেক হাসাহাসি খবর বিনিময়, আরিববাস বলা। বিকেলের শেষে আমি গেলাম ওকে এগিয়ে দিতে -- ও যাবে অনেকদূর।
গ্রামছাড়িয়ে ধানখেত, তার ওপারে
হুই দূরে পাহাড়, রাস্তা উঠে গেছে টিলায় -- তার ওপারটা আর দেখা যায় না। ধীরে ধীরে উঠে চলেছে ভীমলি...ঐ দূরে...আমি দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছি...ওও ফিরে
ফিরে। টিলার ওপর উঠে শেষবারের মতো হাত নেড়ে ও নেমে গেল ওপারে। ওপারটা আর দেখা যায়
না।
একটু পরে দূর থেকে ভেসে এলো -- একটি সুখী
কাকের ডাক।