গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৮

ডঃ মৌ সেন

চোয়াল 

কথায় বলে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না। কদিন ধরেই বাঁদিকের নিচের পাটির শেষ দাঁতটা খুব ব্যথা করছিল ।ভাগ্যিস এক সপ্তাহের ছুটি পড়ল কালীপুজোর আগে পরে শনি , রবি মিলে। আমি দৌড়লাম দাঁতের ডাক্তারের কাছে। ঠুক করে কি একটা ঠুকতেই বাঁ দিকটা ঝনঝন করে উঠলো। ডাক্তার বরুণ চৌধুরী, আমার বহুদিনের পরিচিত । সম্পর্কটা এখন খানিকটা দিদি আর ভাইয়ের মত। ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝলাম যা হবার হয়েছে, এ দাঁত না তুলে উপায় নেই । যথারীতি নিদান দিল, পরশুদিন দাঁতটা তুলে দেব। অতএব, একেবারে ওষুধ কিনে খেতে শুরু করলাম ।
দুদিন পর, আজ বিকেলে ওর চেম্বারে আবার পৌঁছলাম । একটু ভয় ভয় করছিল ।কষের দাঁত, শক্ত গোড়া। তুলতে গিয়ে যদি লাগে। কতটা লাগে ? খুব লাগবে কি ? ঠিক মত অবশ যদি না হয়, তাহলে কি হবে ? এইসব ভাবতে ভাবতে বরুণ কে বলেও ফেললাম , আচ্ছা এখন কি না তুললেও চলত ? ও এবার হেসে ফেলল । বলল , দিদি আপনার কোনো ভয় নেই। বেশি করে অবশ করার ইনজেকশন দিয়ে তুলে দেব, আপনি বুঝতেও পারবেন না, তো আর দাঁত উপড়ে ফেলা নয়। সুন্দর করে সাজানো চেম্বারে পাশাপাশি তিনটে চেয়ার । আমায় অবশ করার ইনজেকশন দিয়ে বরুণ পরের পেশেন্ট কে ডাকলো । একটি অল্প বয়স্ক বিবাহিত মেয়ে এলো। শ্যামবর্ণ মেয়েটি, এক মাথা কালো চুল, বিনুনিটা পিঠ ছাপিয়ে কোমরের নিচ অবধি চলে গেছে । আমার চোখ আটকে গেল ওর কাজল কালো চোখে । সাথের পুরুষটি তুলনায় বেশ শক্ত পোক্ত। বুঝলাম, মেয়েটার স্বামী। মেয়েটা কোনো কথা বলছে না আর ডাক্তারের চোখের দিকে তাকাচ্ছেও না। ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। বরুণ ওকে ডেন্টাল চেয়ারে বসতে বলল। মেয়েটি বসল নি:শব্দে।  বলো ?ডাক্তার  জানতে চাওয়ায় মেয়েটি  ডান হাতটা তুলে গালের কাছে এনে খুব আস্তে আস্তে বলল, ব্যথা । ডাক্তার হাঁ করতে বলল, মেয়েটি হাঁ করার চেষ্টা করলো, পারলো না, ব্যথায় ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। বরুণ ওর স্বামীর দিকে তাকাতেই স্বামী বলল , দিন সাত আগে একটু ব্যথা  পেয়েছিল , আমার ভাগ্নে ডাক্তার, ওকে জিজ্ঞেস করে ওষুধ দিয়েছি। কি একটা খটমট অ্যন্টিবায়োটিকের নাম ও বলল স্বামীটা। বরুণ বলল ,ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, একটা এক্সরে করতে হবে বলে স্বামীটির দিকে না তাকিয়েই নার্স কে বলল মেয়েটির গালের এক্সরে করতে। মেয়েটি কে নার্স রা পাশের রুমে নিয়ে গেল। স্বামীটাও গেল পাশের রুমে। সব শেষে বরুণ । ওর মুখটা একটু যেন একটু গম্ভীর । আমার গালটা অবশ হয়ে এসেছে ইনজেকশন এর জন্য। মিনিট পনেরো পরে মেয়েটি আর ওর স্বামী বেরিয়ে গেল আমার সামনে দিয়ে । মেয়েটির চোখ তখনও মাটির দিকে। স্বামীর হাতে এক্সরে প্লেট আর প্রেসক্রিপশন।
ওরা চলে যাওয়ার পর বরুণ আবার আমার কাছে ফিরে এলো । আমি ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হল , ওরা চলে গেল কেন ? ও একটু হেসে বলল,ছাড়ুন দিদি,ওদের চিকিত্সা এখানে হবে না,কারণ মেয়েটির ও.টি করতে হবে,ডান দিকের চোয়ালটা ভেঙে গেছে । 

আমি আঁতকে উঠলাম । মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল , 'মানে ? কি করে ?' বরুণ বলল, ওই স্বামীর কীর্তি। ওকে ঘুষি মেরে চোয়াল ভেঙে দিয়েছে । দোষ ঢাকতে নিজেই দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করে ওষুধ এনে খাইয়েছে সাত দিন। কমেনি দেখে আজ এখানে নিয়ে এসেছে । এ সব দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে গেলাম দিদি।
আমি বললাম, এসব লোক কে তো পুলিশে দেওয়া উচিৎ। এ তো ক্রিমিনাল অফেন্স।
বরুন এবার আমায় অবাক করে দিয়ে বলল, আমি ওর চোয়ালে হাত দিয়েই বুঝেছিলাম চোয়ালটা ভেঙে গেছে। ভাঙার ধরন দেখে বুঝতে বুঝেছি এটা ঘুষি মেরে ভেঙে দেওয়া হয়েছে । আর মেয়েটির চোখ তুলে না তাকাতে পারার ভেতরে লুকিয়ে আছে ওর ভয় , কারণ, অপরাধী নিজে যে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের অত্যাচারী স্বামীকে ও ভয় পায় আর তার সামনে ও কিছুই বলবে না।
আমি অবাক হয়ে গেলাম, বললাম, তুমি ওকে কিছু বললে না ? কিছু জিজ্ঞেস ও করলে না ?
- জিজ্ঞেস করলে ও উত্তর দিত না। আর যদি দিয়ে ফেলতো উত্তর, তাহলে বাড়ি গিয়ে ওর অন্য চোয়ালটা ও ভেঙে দিত ওই স্বামীই। তাই আমি মেয়েটির হাতে ওর বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দিয়ে দিলাম । এক্সরে করে দেখিয়ে দিলাম হাড় ভেঙে গেছে । স্বামীটা নাকি যাবার সময় বলে গেছে ইএসআই তে আমার কার্ড আছে, ওখানেই অপারেশন করাবো। আশাকরি ওর বাবা মা বা আরও কেউ আছে যাকে ও বলতে পারবে এক্সরে হয়েছে, ডাক্তার বলেছে চোয়ালের হাড় ভেঙে গেছে। যাক গে, ছাড়ুন । আপনি হাঁ করুন বড়ো করে।

এরপর আমার আর দাঁত তোলার সময় একটুও ব্যথা লাগেনি, শুধু ভাবছিলাম আমার মেয়ের বয়সী একটা মেয়ে চোয়ালের হাড় ভাঙা নিয়ে মুখ বুজে আছে আর আমার অবশ করা দাঁত তুলতে আমার কখনো লাগতে পারে ?