গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৮

অমিতাভ দাশ (ব্যাঙ্গালোর)


খুদিরাম

তিনমাস ধরে রোজ খুদিরামএর মা দুখিয়া মুখে করে একটা সাদাপাথরের নুড়ি নিয়ে পীরবাবার থানে ফেলে আসত ভোররাতে...আর চোখবুজে প্রার্থনা করতো ''পীরবাবা মোরে একখান ছাওয়াল দিও''
দুখিয়া স্বপ্ন দেখল একদিন বেশ ভগবানের মততো একজন, -- একটা নাদুস ছানা তাকে দিয়ে বলছে ''এই নে সামলা তোর ছেলেকে দুখিয়া -- কী টেঁটিয়ারে বাবা! স্বর্গের ওয়েটিং রুমের সবাইকে নাজেহাল কইরে দিলে বটেক ট্যাঁকস ট্যাঁকস বাক্যে!''
বুড়ো বয়েসে ছেলে এলো বুধি আর দুখিয়ার -- বেশ নজ্জা নজ্জা ঝিমঝিম আনন্দ দুজনের। আর খুদিরাম?
ওমা আর সব কুমীরছানা ডিম ফুটে হামাগুড়ি দেয়, মাবাবাভাইবোনএর নিকটেই থাকে -- আর খুদিরাম?
সে জন্মেই গটগট করে হাঁটে...এদিক ওদিক অনেক দূরেই চলে যায় ''সরো সরো হেইই -- দেখি দেখি দেখি'' বলে -- আর খুব ভালটিবাসে মা দুখিয়াকে -- রোজ মাকে গল্প বলে খুদিরাম আজ কী কী দেখল গ্যাঁট হয়ে।
বয়স হলে ঢিলে হয়ে যায়ই তো নিয়ত জীবনসংগ্রামের সুতলিটি ...
একদিন খুদিরাম তার রোজকার সফর শেষ করে বাসায় ফেরত এসে দেখে কেউ নেই। আচমকা পাহাড়ী নদীর বান ধূয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে কমজোরী কিছু কুমীরদের -- দুখি-বুধিয়াকেও।
খুদিরামের মন খারাপ হলো খুব -- তবু সে ওসব কাটিয়ে নদীর চরে গেল যেখানে বাকী কুমীররা রোদ পোহাচ্ছে -- আধচোখ খোলা রেখে।
খুদিরাম সোজা করে শরীরটা মিলিটারীর মতো হেঁটে গেল এদিক থেকে ওদিক কুমীরদের সামনে দিয়ে -- আবার এলো ফিরে ওদিক থেকে এদিক জেনেরাল এর মতো -- তারপর কুমীরদের ঠিক সামনে গিয়ে গম্ভীরভাবে বললো ''আমার নাম খুদিরাম -- আমি সোজা হয়ে হাঁটি, হামাগুড়ি দিই না''
একটা কুমীর বলল ''তাতে কী?'' বলে ফ্যাচফ্যাচ করে হাসতে থাকলো।
অমনি আরেকটি কুমীর বলল ''তাতে কী?'' বলে ফ্যাচফ্যাচ করে হাসতে থাকলো। ব্যস পরপর সব কুমীরই ''তাতে কী? ''তাতে কী?'' বলে ফ্যাচফ্যাচ করে হাসতে থাকলো।''
নদীচর জুড়ে তাচ্ছিল্য আর ব্যঙ্গর ধ্বনিপ্রতিধ্বনি কেমন বেমানান কাশভরা সৌন্দর্যে -- বেমানান, তবু ব্যথিতকরা খুব। খুদিরাম ঠিকই করে ফেললো সে থাকবে না এদের সাথে, আত্মীয় হলেও।
বেশ অনেকদিনই খুদিরাম দেশছাড়া -- প্রায় নমাস হতে চললো।
অনেক জায়গা ঘুরে সে এক প্রান্তরে এসেছে -- দেখা এক ক্যাঙারুর সাথে। খুদিরাম তাকে অভিবাদন করে বললো ''হাই আমার নাম খুদিরাম -- আমি সোজা হয়ে হাঁটতে পারি -- এই দেখো'' । হেঁটে দেখালোও। ক্যাঙারুটি বললো ''বাঃ দারুণ! দারুণ! আমি পারি না অমন সোজা হয়ে হাঁটতে। আমি এমন জোড়াপায়ে লাফাই। এই দেখো'' । লাফিয়ে দেখালোও।
খুদিরাম খুবই উত্তেজিত হয়ে বললো ''অসাআআআধারণ! আমি পারবো? তুমি শেখাবে আমায়?'' ক্যাঙারু বললো কেন পারবে না -- অবশ্যই পারবে। তবে অধ্যাবসায় লাগবে -- প্র্যাকটিস করতে হবে রোজ। করবে?'' খুদিরাম বললো 'হ্যাঁ চলো শিখি'' এবং একমাসে আয়ত্ব করে ফেললো জোড়াপায়ে ক্যাঙারুলাফ।
এরপর চলতে চলতে দেখা এক ফ্লেমিংগোর সাথে -- কী সুন্দর যে একপায়ে দাঁড়িয়ে। তাকেও বলেকয়ে তারকাছে কোচিং নিয়ে দুইমাসে আয়ত্ব করে ফেললো খুদিরাম একপায়ে দাঁড়ানো -- সে কিঞ্চিৎ নাদু হলেও।
এইভাবেই এক অপোসামএর সাথে দেখা ও এই লেজদিয়েঝোলাপ্রাণীটির কাছে সে শিখে নিল তিনমাসের কঠোর প্র্যাকটিসে -- লেজদিয়ে গাছের ডাল জড়িয়ে দোলখাওয়া । ভীষণ ভীষণ অকুমিরীয় কঠিন এই কাজ, তাও, শিখলো তো!
শেষ দেখা এক শিম্পাঞ্জীর সাথে, সাক্ষাৎ বাবা রামদেবের শিষ্য। তারকাছে ছমাস প্র্যাকটিস করে খুদিরাম শিখে নিল শীর্ষাসন ।। ইমপসিবল টাসক -- একটি কুমীরের পক্ষে। ধন্যি ছেলের অধ্যাবসায়!
মন ফুরফুর এতো কিছু শিখে! খুদিরামের মনে হলো -- অনেএএকদিন দেশে যাই না, -- যাই দেখে আসি কুমীর আত্মীয়রা কেমন আছে সব।
ফিরে দেখে কিছুই পাল্টায় নাই গা -- কুমীরেরা সেই নদীচরে রোদপুইয়ে আর আধচোখ খুলে ঘুমিয়েই দিন কাটাচ্ছে।
যাই হোক, ওদের সামনে এসে খুদিরাম বললো ''মনে আছে আমাকে তোমাদের?আমি খুদিরাম। আমি সোজা হয়ে হাঁটতে পারি!''
কুমীরেরা বললো ''তাতে কী? তাতে কী?'' খুদিরাম বললো ''আমি আরো অনেক কিছু পারি এখন। শিখেছি সব। এই দ্যাখো!'' বলে করে দেখালো শীর্ষাসন...তারপর একপায়ে দাঁড়ানো...জোড়াপায়ে লাফিয়ে চলা, আর লেজজড়িয়ে গাছের ডালে -- ঝোলা, দোল খাওয়া।
কুমীরেরা সেই একইরকম উচ্ছাসবিহীনভাবে বলে উঠলো -- এতোকিছু অকল্পনীয় অসম্ভব পাররফরমেন্স দেখবার পরেও -- একইরকম উচ্ছাসবিহীনভাবে বলে উঠলো ''তাতে কী? তাতে কী? তাতে কী?''
ব্যথিত হয়ে রেগেমেগে খুদিরাম ঠিক করলো আর কোনদিইইন ফিরবে না সে, কিছুতেই থাকবে না এদের সাথে আর, চলে যাবে বহুদূর।
হনহন করে হেঁটে চলে যেতে -- একটু দূর গিয়ে কী যে অদভুত কান্ড হলো এক, হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে হলো খুদিরামের : 'পিছন ফিরে দেখি তো একবার!'
থেমে, ঘুরে পিছন ফিরে দেখলোও সে, -- আররে!
ওওমাআ! দেখে কী -- সব কুমীরেরা -- একপায়ে দাঁড়াতে আর শীর্ষাসন করার চেষ্টা করছে আর ধাঁইধপাধপ আছাড় খাচ্ছে! সবাই নয়, কেউ কেউ অবিশ্যি জোড়াপায়ে লাফাবার চে্ষ্টা করছে বা লেজজড়িয়ে গাছে ঝোলার চে্ষ্টা করছে -- তারাও ধপাস ধপাস আছাড় খাচ্ছে!
ওমনি ''আহা! ওভাবে নয়! ওভাবে নয়! দাঁড়াও! দাঁড়াও! আমি শিখিয়ে দিচ্ছি এক্ষুনি!'' বলতে বলতে জোড়াপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড় দিল খুদিরাম -- দেশে-ফেরায়।

(একটি আমেরিকান গল্পর ছায়ায় নির্মিত)