গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৮

তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক হ্যান্টেড কাহিনী-৩২
 
সাউথ পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থান


মাঝ রাতের গোরস্থান শশীভূষণ, জনান্তিক ও অর্ণব ধীর গতিতে সাউথ পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছেন শশীভূষণ অকৃতদার অর্ণব বিপত্নীক আর জনান্তিকের স্ত্রী আছেন কিন্তু ছেলেপুলে না হওয়ায় সংসার নিয়ে তিনি তত জড়িয়ে পড়েননি কাজেই একমাত্র তাঁদের দ্বারাই সম্ভব এ ধরনের মিস্টিরিয়াস ঘটনার পেছনে ছুটে ফেরা  ওঁদের নিজস্ব পেশা থাকা সত্যেও নেশা হিসাবে এই কাজটা তাঁরা মাঝে মাঝেই চালিয়ে যান
চারদিকে কবর গাহ এক একটা কবরস্থান এক এক রকমের, কোনটা গম্বুজ আকৃতির, কোনটা মন্দির, মসজিদ, গির্জা আকারের ছোট-বড় নানান আকৃতির প্রকৃতির সব স্মৃতিসৌধ মাঝে মাঝে আবার অতি সাধারণ ভাবে শায়িত কবরবেদিও চোখে পড়ছে মনে হবে একটা সিঙ্গেল বা ডবল বেডের আকৃতিতে কবরগুলি বিছানো রয়েছে
গা ছমছম রাত প্রতিবারের মতো স্বভাবতই ভীতু প্রকৃতির অর্ণব দুই বন্ধুর মাঝখানের জায়গাটা দখল করে রয়েছেন ফুরফুরে হাওয়া এসে গায়ে লাগছে গরমের দিন তবু যেন শরীরে এসে বিঁধছে ! এক রোমহর্ষক ভাব-ভাবনা চারদিক ঘিরে আছে অমাবস্যার রাত হলেও কোথাও যেন আকাশের এক কোণে এক টুকরো চাঁদ রয়েছে তাই চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার হতে পারেনি কিন্তু সে যৎসামান্য আলোটুকু গাছপালা গলিয়ে কবরবেদী ও ওঁদের চলার পথে এসে পতিত হয়েছে সে আলো অতি সামান্যই, আর এই আবছা ঘোলাটে আলোর রশ্মি কবরস্থানকে যেন আরও রহস্যঘন করে তুলেছে
এদিক ওদিক কালো ছায়ারা নড়েচড়ে উঠছে তবে বোঝা যাচ্ছে এখানে আশপাশের বড় বড় গাছপালা ও তার ডাল পাতার হিল্লোল ধরা পড়ছে এই জাগা বড় বড় ঘন গাছপালায় আবৃত তার মধ্যে অর্ণব হঠাৎ ভীত চাপা স্বরে বলে উঠল, ছায়া, ওই যে একটা মানুষের ছায়া !
শশীভূষণ ছায়ার দিকে তাকালেন না, ভয়ের কিছু না, একটা সরু গাছের ডাল বাতাসের সামান্য তাড়নাতেই  হেলে-দুলে উঠছে এ তারই ছায়া
জনান্তিক অর্ণবকে বললেন, তুই এটুকুতেই ভয় পেয়ে যাস কেন ?
সরু ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে ওরা এগিয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ কবরস্থানই  ভাঙাচোরা পড়ে আছে আর হবে নাই বা কেন, একে তো তদারকির ত্রুটি রয়েছে, মেইনটেন্যান্স প্রায় হয় না বললেই চলে সেই ১৭৬৭ সালে  এই সাউথ পার্ক স্ট্রিট এলাকায় নির্মিত হয়েছিল এই গোরস্থান দীর্ঘ ২৫০ বছরের বেশী সময় ধরে সে অস্তিত্ব আজও বহন করে আছে এটা সাহেবদের গোরস্থান বেশির ভাগ ব্রিটিশ সৈনিকদের এই গোরস্থানে কবরস্থ করা হয়েছিল সামনে বড় গম্বুজ আকৃতির একটা কবরস্থান দেখা গেল--অনেকটা আমাদের জমিদারি গোল ঘরের মতই মনে হলতার সামনে এসে তিন বন্ধু দাঁড়ালেন প্রবেশ দ্বারের পাশের স্তম্ভে লাগা শ্বেত পাথরের ফলক তাতে মৃতের নাম-ধাম লেখা আছে বলে মনে হল আবছা আলো-অন্ধকারে তা পড়ার জো নেই জনান্তিক তবু খুঁটে খুঁটে পড়ার চেষ্টা করলেন--উইলিয়াম টার--আর পড়া যাচ্ছে না লেখার উপর সময়ের ধুলো-ময়লার কালো পরত পড়ে আছে ঝপ, একটা কিছু পতনের মত আওয়াজ কানে এলো আওয়াজটা কবর ঘরের ভেতর থেকে এসেছে অর্ণব ভয় পেয়ে জনান্তিককে জড়িয়ে ধরলেন শশীভূষণ, কে ? বলে চাপা স্বরে আওয়াজ করলেন ভেতরে আর কোন আওয়াজ নেই, শশীভূষণ বললেন, ভেতরে একবার গেলে হত না ?
অর্ণব, না, না, বলে শশীভূষণের একটা হাত চেপে ধরলেন
--ও সব পাখির, বা বাদুড়ের আওয়াজ হবে, জনান্তিক সাহস করে বলে উঠলেন
ওরা আবার পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন শশীভূষণ কোথাও তো পড়েছেন, এখানে নাকি রাত হলেই জেগে ওঠে শত শত বছরের পুরনো আত্মারা এখানের আশপাশের লোকেরা সন্ধ্যে হতে না হতেই ভয়ে নিজেদের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়
সে দিনও একদল মানুষ দেখতে এসেছিল এই গোরস্থান তখনও সন্ধ্যে হয়নি, তবু সেখানে গাছপালা জঙ্গলের মাঝে মাঝে অন্ধকার নেমে এসেছিল হঠাৎ ওরা দেখল, দূরে কবরস্থান থেকে একটা সাদা ছায়া উঠে দাঁড়িয়েছে ! ওরা হতবাক হয়ে দেখছিল, ভয়ে বিস্ময়ে ওরা থ মেরে দাঁড়িয়ে ছিল ওদের মধ্যে থেকে একজন সেই সাদা ছায়াকে ক্যামেরায় কয়েদ করতে চেয়েছিল সেই ছায়া দেখতে গিয়ে ক্যামেরার লেন্সে সে কি দেখতে পেয়েছিল কে জানে ! সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল তারপর ওরা এক সময় ভীষণ ভয় পেয়ে ঘরে ফিরে এসেছিল ঘরে এসে ওরা সবাই নাকি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল এ ঘটনাও শশিভূষণ কোথাও পড়েছিলেন
কবরস্থানের শুরুতে কিছুটা রাস্তার সংস্কার হয়েছে, তারপর ভাঙাচোরা সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তা তিন বন্ধুকে সাবধানে চলতে হচ্ছে, বড় বড় ফাটল পায়ের নিচে পড়ছে ওঁরা সামনে, অদূরে বসার জন্য একটা লম্বা লোহার বেঞ্চ দেখতে পেলেন
--ওই বেঞ্চে একটু বসা যাক, শশীভূষণ বললেন
--ওই বেঞ্চে ? অর্ণব ভাঙা গলায় ভয়ে ভয়ে বলে উঠলেন
জনান্তিক ইতিমধ্যেই বসে পড়েছেন অগত্যা তিন বন্ধু পাশাপাশি বসলেন শশীভূষণ বললেন, জানিস তো এখানে একবার ভুতুড়ে সিনেমার শুটিং করতে এসে সবাই ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল
জনান্তিক বললেন, না, জানি না তো !
--সেটা ছিল সন্দীপ রায়ের ফেলুদা সিরিজের একটা কাহিনী ছবির নাম ছিল, গোরস্থানে সাবধান সে সময় শুটিঙের জন্যে এই কবর স্থানের কোন এক দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল তারপর শুটিং চলতে চলতে ঘটে গিয়েছিল অদ্ভুত সব ঘটনা হঠাৎ দমকা হওয়ায় শুরু হয়েছিল, গাছপালা দুলতে লেগেছিল চারদিক থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব আওয়াজ ভেসে আসছিল পরিস্থিতি ভয়াবহ বুঝতে পেরে ছবির পরিচালক তার দলবল নিয়ে শেষে এখান থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলেন শশীভূষণের গল্প শেষ হতে না হতে অর্ণব চীৎকার দিয়ে উঠলেন, কে? কে? কে?
--কি হল তোর ? জনান্তিক প্রশ্ন করে ওঠেন
--ওরে বাবা, আমার দু কাঁধে কেউ যেন হাত রেখেছিল!
--তুই ত আমাদের মাঝখানে বসে আসিসতর কাঁধে কে হাত রাখবে ?
অর্ণব ভয়ে চুপ করে আছে   
তিন বন্ধু ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ালেন বাস্তবিক ওদের সবার শরীর কেমন যেন ভারী ভারী মনে হতে লাগলো ! ওদের মনে হল ওদের আশপাশে কেউ বা কারা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে ! অনুভব হচ্ছিলো কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছিল না শশীভূষণ বুঝতে পার ছিলেন যে এখানে আর বেশি সময় থাকা যাবে না তিনি বলে উঠলেন, চল এবার আমরা ফিরি--
কারও মুখে কোন কথা নেই এমনিতেই এত রাতে এই গোরস্থানে প্রবেশ অধিকার থাকে না ওঁরা এখানকার গার্ডকে কিছু পয়সা দিয়ে সন্তুষ্ট করিয়ে আর ওদের এত রাতে এখানে আসার উদ্দেশ্য জানিয়ে প্রবেশ অধিকার পেয়েছিল
ওঁরা এবার ফির ছিল, মনে ভয় ছিল, ওদের মনে হচ্ছিল অদৃশ্য কারা যেন তাদের এ জাগা ছেড়ে চলে যাবার জন্যে পেছন থেকে তাড়া দিচ্ছে ! হঠাৎ একটা উতল হাওয়া এসে গাছপালা দুলিয়ে গেল শশীভূষণ দেখলেন, সাদা একটা ছায়া দূরের এক মন্দির আকৃতির কবরস্থানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বেশ লম্বা-চওড়া মনুষ্য আকৃতির সে ছায়া সাদা পোশাকে আবৃত তার দেহ শশীভূষণ কে? কে? বলে পকেট থেকে পেন্সিল টর্চ বের করে সাদা ছায়ার গায়ে ফেললেন না, তাতে কোন কাজ হল না সে ছায়া যেন গেঁট হয়ে আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে তার কোন নড়ন-চড়ন নেই শশীভূষণ ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়ালেন সে সঙ্গে তাঁর বন্ধুরাও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে সে ছায়ার দিকে তাকিয়ে আছেন ওঁদের কারও মুখে টু শব্দটুকু নেই ওঁরা যেন নিথর তিন মনুষ্য স্ট্যাচু হয়ে কয়েক শবছর ধরে এমনি ভাবেই দাঁড়িয়ে আছেন !
মুহূর্ত খানেক পরেই হঠাৎ অর্ণব জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন এবার জনান্তিক ও শশীভূষনের যেন চেতনা ফিরল ওরা অর্ণবকে ওঠাবার চেষ্টা করলেন এক সময় গোঁ গোঁ আওয়াজ করতে করতে অর্ণবের জ্ঞান ফিরল ওদিকে সাদা ছায়া তখন আর নেই !
তিন বন্ধু ফিরছেন তাঁরা ভয়জড়ো, অবসন্ন দেহের মাঝে একটা নেশা ঘোর ঘোর অবস্থায় বারবার শিহরিত হয়ে উঠছিলেন তবু এই নেশাই তো ওঁদের এখানে ওখানে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মারছে !