গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৮

সুদীপ ঘোষাল


জলপাই রঙের  জীবন

সুমন তার স্ত্রীকে সন্দেহ করে। সবসময় মনে মনে তার প্রতি সন্দেহ। ফলস্বরূপ মাসের মধ্যে কুড়িদিন তাকে নিয়ে আজেবাজে স্বপ্ন দেখে। আজ সকালবেলা চা জলখাবারের সময় সুমন তার স্ত্রীকে বলছে,জানো তোমাকে নিয়ে আজেবাজে স্বপ্ন দেখেছি অন্য পুরুষের সঙ্গে। তার বৌ ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে,তা তো দেখবেই। তুমি তো আমাকে সন্দেহ করো। আমি তো খারাপ মেয়েছেলে।

সন্দেহ কিন্তু সুমনের এমনি এমনি হয় না। বিয়ের পরে অষ্টমঙ্গলার সময় শ্বশুরবাড়ি গেছিলো সুমন। মাংস রান্না হচ্ছে বিকেল থেকে। অনেকে নিমন্ত্রিত।বন্ধু বান্ধবীদের আনা গোনায় বাড়ি রমরমা। 

সুমনের চারপাশে দাদু দিদারা বসে আছেন। তারা ঠাট্টা ইয়ার্কি করছেন। এক দাদু জলের বোতল বগলে করে মাতালের অভিনয় করে দেখাচ্ছেন।সুমন একটা ছবি তুলে নিলো।

সুমনের চোখ এইবার তার স্ত্রী সুমনার দিকে গেলো। জলপাই রঙের বেনারসীতে বেশ মানিয়েছে সুমনাকে। এমনিতেই সুন্দরী।তারপর আবার মেক আপ। কথা বলছে এক বন্ধুর সঙ্গে।বন্ধুটি কালো,বেঁটে। কিন্তু স্মার্ট। সুমনের বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে।বন্ধুরা বলে, বৌ নিবি খেদুরি,জমি নিবি বাকুরি।সুমন ভাবে, আমার বৌ এত সুন্দরী। বাড়ির উঠোনে ঢিল পড়বে না তো? সুন্দরী বৌ মানেই বিপদ। এইসব চিন্তা করছে হঠাৎ নজর পড়লো সুমনাকে ছেলেটা একটা সাদা খাম দিলো হাতে। সুমন সঙ্গে সঙ্গে সুমনাকে অনুসরণ করলো। সুমনা দৌড়ে দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকলো।সুমন দাঁড়িয়ে থাকলো দরজার পাশে। সুমনার এক বান্ধবী এসে হাত ধরে সুমনকে পাশের ঘরে নিয়ে গেলো। সে বললো,জানেন সুমনা একটা ছেলেকে ভালোবাসে।সে যাতে ক্ষতি না করতে পারে লক্ষ্য রাখবেন।এই কথা বলে সে পালিয়ে গেলো।প্রায় তিরিশ মিনিট পরে সুমনা বাইরে এলো চোখ মুছতে মুছতে। তারপর রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। এবার সুমন গোয়েন্দার মত সব কিছু খুঁজতে শুরু করলো। বইয়ের তাকে অনেক খাতা, বই। খাতাগুলো উল্টে,পাল্টে দেখলো সব পাতায় লেখা বৃন্দাবন। এই জন্যই বোধ হয় মেয়েটার পড়াশুনা হয় নি। সাদা খামটা একটা বইয়ের ভেতর ছিলো।খামের মুখ খোলা। চিঠিটা বের করে দেখলো বৃন্দাবনের চিঠি।লেখা আছে, এবার বিয়ে হয়ে গেছে,কি মজা বলো। মনে পড়ে প্রথম নরম অনুভবের কথা। সুমন আর পড়লো না। রেখে দিলো। এই বয়সে এইসব হয়। কিন্তু বিয়ের পরে মেয়েটা বলছে ক্ষতি করবে। বিয়ের পরে তো সব ঠিক হয়ে যায়। সুমন ভাবে আমিও তো পিউকে ভালোবাসতাম। ওর বিয়ে হওয়ার পরে তো আর দেখা করি নি। কিন্তু সবাই তো এক রকমের হয় না। 

তারপর খাওয়া দাওয়া করে শুতে রাত দশটা বেজে গেলো। সুমনা বিছানায় উঠেই বললো,মন শরীর ভালো নেই। শুয়ে পড়ো। সুমন সুযোগ পেয়ে বললো,মন খারাপ কেন? তুমি কোনো ছেলেকে ভালোবাসতে?-কি কি হবে এসব কথা শুনে?
-না, বলো না
-হুঁ
-কি নাম ছেলেটার?------- আজকে ছেলেটা এসেছিলো না কি?
-হ্যাঁ, এসেছিলো
-আচ্ছা তোমাকে কিছু করেছে?
-কিস করেছে
-আর কিছু
-আর একটা ছেলে, সিনেমার হলে বুকে হাত দিয়েছিলো।
- আর কিছু
-আর শুনতে হবে না। শুয়ে পড়ো।
সুমনের সারারাত ঘুম এলো না। ভাবলো,শালা জালি মালটা আমার কপালেই জুটলো।
সুমনা খুব সরল সহজ মেয়ে। তার সরলতার সুযোগে দু একজন খারাপ ব্যবহার করেছে। কিন্তু তার জন্য সুমনার মত মেয়েদের কোনো দোষ নেই।
কিন্তু বিষফল পুঁতে দিলো সংসারে সুমনার সরলতা। এত সরল হওয়ার প্রয়োজন নেই,যে সরলতা সমস্ত সুখ কেড়ে নেয়।
পরের দিন সুমন বৃন্দাবনকে বাজারে ধরেছিলো।বলেছিলো,শালা বিয়ের পরে হারামীগিরি আমি সহ্য করবো না। এরপর যদি দেখি তোকে তাহলে তোর বৌ কে তোর বিয়ের পিঁড়ে থেকে তুলে সকলের সামনে শালা... আর বললাম না। বৃন্দাবন জোড় হাতে ক্ষমা চেয়ে পালিয়েছিলো।সুমন দেখেছিলো পরে বৃন্দাবন আর একটা সুন্দরী মেয়েকে পটিয়েছে।

আজ স্বপ্ন দেখে সুমন স্বপ্নের কথাগুলো বলছে। সুমনা বলছে,তুমি যখন সন্দেহ করো তাহলে আমি ওইরকম কাজই করবো।-
-কি জানি,মেয়েটা আমার মেয়ে না বৃন্দের মেয়ে?
-তাহলে ডি এন টেষ্ট করে নাও।
-তাহলে তোমারও সন্দেহ আছে।
তারপর একমাস কথা বন্ধ। কোনোদিন সুমনা সুন্দর ভাবে গ্রহণ করেনি বিছানায়। মুখ ঢাকা দিয়ে হয়তো বৃন্দাবনের কথা ভাবতো।
আবার সুমনা ভাবে এমন জায়গায় পরলাম যেখানে ভালোবাসা নেই, আনন্দ নেই। এরকম বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। সে ঠিক করে ফেললো যখন মেয়েটা স্কুলে যাবে তখনই ট্রেনে মাথা দেবে।
একদিন সকালে সুমন অফিসে চলে গেলো। মেয়েটাকে স্কুলের গাড়িতে তুলে দিলো। তারপর বেনারসী শাড়িটা পরে গলায় দড়ি দেবার জন্য একটা চেয়ার নিয়ে এলো। দড়ি কই?  তাড়াতাড়ি শাড়ি পাল্টে, জলপাই রঙের শাড়িটা দড়ির মত পাকিয়ে নিলো। সুমনা ভাবলো,বিষফলটা নিজেই পুঁতেছে। সেই ফল আজকে চারা থেকে বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। কি হবে এই জীবনে। শুধু ঝগড়া, মারামারি। কোনো ভালোবাসা নেই। প্রেম নেই। সুমনার চোখের সামনে ভেসে উঠলো বৃন্দাবনের কঙ্কাল মূর্তি। তার মূর্তি দেখে সে শিউরে উঠলো। বৃন্দাবন এগিয়ে আসছে তার পচা, গলা দেহ নিয়ে। সুমনা দেখলো একটা গোলাপের বাগান দূরে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে যাবে, নিশ্চয় যাবে পচা গন্ধটা ঢাকার জন্য একটা গোলাপ সে তুলবেই....