গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৮

পার্থ রায়

গন্ধ


ঘুম থেকে উঠে বাথরুমের কাজ সেরে এক কাপ চা নিয়ে ব্যাল্কনিতে বসা বাসবদত্তার অনেক দিনের প্রিয় শখ কিন্তু আজকাল সকালবেলা ফ্ল্যাটের ব্যাল্কনিতে দাঁড়ালেই ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। শখ করে লাগানো হ্যাঙ্গিং ফুলের টবগুলোর পাশে নানা রঙের চুলের কুণ্ডলী ঝুলতে ঝুলতে, দোল খেতে খেতে ওকে গুড মর্নিংবলে। ডিসগাসটিং! বেশির ভাগই
ওপরের তলার মাসীমা ফেলেন। সাদা শনের মতো চুলের থেকে কড়া সুগন্ধি তেলের গন্ধ ছাড়ে। বুড়িকে কায়দা করে, রেখে ঢেকে অনেক বার বলেছে বাসবদত্তা। গুরুজন, মায়ের বয়েসি- বেশী কিছু বলাও যায় না। ফ্ল্যাট কমিটির মিটিংএও বার কয়েক তুলেছে। শুনে কমিটির সেক্রেটারি নিখিলেশ বাবু গা জ্বালানো হাসি হেসেছে, কাজের কাজ কিছু হয় নি। হাসির ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট। হু হু, বাবা, আমি বলে খারাপ হই, আর আমে দুধে মিলে যাও। আরে বাবা কেউ বাড়ি বয়ে এসে তরকারী, আচার এটা সেটা যদি দিয়ে যায়- াকে কি না বলা যায়? তোদের ইয়ে ফাটছে কেন? হ্যা, এটা সত্যি মাসীমা দারুন রান্না করেন। লতির পাতুরি, চালতার টক, মোচার ঘণ্ট, নানা রকম আচার মুখে লেগে থাকে। এমনকি মাসীমার শুঁটকি মাছ রান্নার সময় যে বাসবদত্তা নাকে কাপড় দেয়, একবার নির্জনের জন্য দেওয়া শুটকির বাটি থেকে মেয়েলি কৌতূহলের রাশ আলগা করে আঙ্গুল দিয়ে তুলে খেয়ে ব্যোম মেরে গেছিল। ওই পচা মাছগুলোর স্বাদ এমন হয়? সত্যি বুড়ীর হাতে যাদু আছে। তার মধ্যে নির্জন চায় না বাসবদত্তা কিছু বলুক। আসলে ছোট বেলা মা মারা যাওয়াতে, মাসীমার প্রতি ওর একটা দুর্বলতা আছে। সব ঠিক আছে। হাহ! িজেরতো আর রোজ রোজ ঝাড়ন দিয়ে ওই বস্তুগুলো সাফ করতে হয় না। ##    
কিন্তু, ব্যাপার কি? আজ বাহারি ফুলগুলোর পাশে ঝুলন্ত চুলের দোল খাওয়া নেই। আজ কি সুজ্জি মামা দিক ভুল করেছে? বাসবদত্তা চায়ের কাপে একটা জম্পেশ চুমুক দিয়ে নিজের মনে কুলুকুলু হেসে উঠল। ফুল গাছগুলোতে একটু জল দিয়ে উঠতে না উঠতেই কলিং বেলের আওয়াজ। কাজের বউটা এলো। নির্জন দরজা খোলার আদেশনামা শুনিয়ে দিয়ে খবরের কাগজে ঢুকে পড়ল। সত্যি বাবা! ব্যাটা ছেলেগুলো এমনই, স্বার্থপর। আবার কলিং বেলের আওয়াজ, আবার। কাজের মেয়েগুলো যেন পায়ে ঘোড়ার পায়ের খুড় লাগিয়ে রাখে। যাই ইই... বলে দরজা খুলতেই কাজের বউ রত্না হাউমাউ করে বলল, “তোমরা টের পাও নি, বৌদি? উপরের ফ্যলাটের মাসীমা আর নেই গো। কাল নাত্তিরেই ইষ্টোক হয়ে মারা গেছে   
নির্জন লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল -মানে? কি বলছ কি? কখন? কেউ একটু খবর দিল নাবাসবদত্তাও কেমন থ মেরে গেল।  
-   মাঝ রাত্তিরে। ফ্যালাট হোল এমনই গো দাদা, শহরের বস্তী। দজ্জা বন্ধ করলে, জগত সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন। খালি কুট কাচালির খপর ঘোরে ফেরে। আসল খপরটা এই রত্না ছাড়া....  
-   বাসু, চলো। বাসবদত্তার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে সিঁড়ি দিয়ে ছুটল নির্জন। বাসবদত্তা টের পেল নির্জনের হাত কাঁপছে। আচমকা এক দুসংবাদে ও দিশেহারা। নির্জনটা এরকমই, বড্ড আবেগ প্রবণ। যাকে ভালবাসে তাকে উজাড় করে ভালবাসে। তেইশ বছর ঘর করা বাসবদত্তা কি সেটা জানে না? কিন্তু আজ সেই আবেগ ছোঁয়াচে রোগের মত ওর মধ্যেও যে সংক্রামিত। ওর বুকের ভেতরেও একটা শূন্যতা গ্রাস করে আছে। ##
মাসীমাদের ফ্ল্যাটের বাইরে অনেক চপ্পল। এক লহমা মুখ চাওয়া চায়ি করল নির্জন আর বাসবদত্তা। অপরাধী চলনে দুজনে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকল। নিজের ঘরের বিছানায় সাদা চুলগুলো ছড়িয়ে শুয়ে আছেন। যেন অপার শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন। এতোটুকু বিকৃতি নেই। সমস্ত জাগতিক মোহ, বন্ধন মুক্তির আনন্দে পাড়ি দিয়েছেন সেই দূর দেশে, যেখান থেকে আর ফেরা যায় না। ঘর জুড়ে সেই তেলের গন্ধটা। আজ অন্য রকম, কেমন জানি স্নেহ মাখা। বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল। একটু আসছি বলে, হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে হাঁটা দিল বাসবদত্তা। ওই গন্ধটা থেকে মুক্তি পেতে ওর যে একটু কান্নার ভীষণ দরকার।
(সমাপ্ত)