গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৮

অঞ্জন সরকার


একটি সাক্ষাৎকার 


তেইশ বছরের দ্বীপেন সান্যাল, দিল্লির কাশ্মীরি গেট বাস টারমিনাসের ওয়েটিং হলের এক কোনে বসে।হলের উল্টোদিকে, এসক্যালেটরের কাছেই, একটি উগ্রপ্রসাধন সজ্জিতা মেয়ে পর্যাপ্ত যৌবন প্রদর্শন করে বসে আছে। দ্বীপেনের নজর ঘনঘন মেয়েটির দিকে চলে যাচ্ছিলো, আর চোখাচোখি হওয়ার মুহূর্তেই নজর সরিয়ে নিচ্ছিল। মেয়েটি বেস স্মার্ট দেখতে, ও অধুনা চলতি ফ্যাশানের চটকদার অফ্-শোলডার টপের সঙ্গে আঁটোশাটো জীন্স পরেছে। যেন, সঙ্গ ইচ্ছুক পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই বসেছে। দু একবার দ্বীপেনের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। মেয়েটিও যেন টের পেয়ে, একটু ঔৎসুক্যের চাহুনি দিয়ে তাকিয়েছিল দু একবার। আজকাল নাকি অনেক হোটেলের ওয়েটিং লাউঞ্জে, এয়ারপোর্টে, বাস টারমিনাসের ওয়েটিং হলে, এরকম মেয়েছেলেদের দেখা যায় সন্ধ্যার দিকে। 
মেয়েটি নিজের ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বার করে, কাউকে ফোন করার চেষ্টা করে, এক মিনিট কথা বলেই ফোনটা আবার ব্যাগের ভেতরে রেখে দেয়।বাইরে কোন দূর পাল্লার বাসের প্রস্থানমুহূর্ত ঘোষণা করা হয়, ও তার সঙ্গেই ওয়েটিং হলের অনেকেই বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যায়। বিরাট হলের মধ্যে থেকে যায় চার পাঁচজন অপেক্ষারত যাত্রী, দ্বীপেন ও সেই মেয়েটি।
 
একটু পরে, এসক্যালেটরের দিকে চোখ যেতেই, দ্বিপেন দেখে মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখে চোখ পড়তে, মেয়েটি উঠে দ্বীপেনের দিকেই এগোয়। দ্বীপেন একটু সন্ত্রস্ত হয়ে নড়েচড়ে বসে। আসন্ন কোন সাঙ্ঘাতিক ঘটনার উৎকণ্ঠা তার চোখেমুখে। মেয়েটি দ্বিপেনের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। ঠোঁটে চাপা হাসির ইঙ্গিত।
 
দ্বীপেন এতক্ষনে উঠে দাঁড়িয়েছে।একটু যেন ভয়ই পেয়েছে। একাধিকবার তাকানোর জন্য তিরস্কার, এমনকি একটা চড় কষিয়ে দেয় যদি! দ্বীপেন কিছু বলার আগেই, চোখে চোখ রেখে মেয়েটি বলে ওঠে, “কি! চেনা মনে হচ্ছে? চল না ওই কোনাটায় গিয়ে বসি, নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে।বলেই, মেয়েটি দ্বীপেনের হাত ধরে প্রায় টেনে নিয়ে যায় হলের ভেতরের কোনের দিকে। দ্বীপেন যেন যন্ত্রচালিতের মতন হলের কোনের দিকে এগিয়ে যায়।
 
মেয়েটিও তাহলে বাঙালি, অথবা বাংলা ভালো জানে।
 
-“চেনার চেষ্টা করছিলে, না আলাপ করার চিন্তা করছিলে
দ্বীপেনে ভেবে উঠতে পারছে না কী বলবে।
 
-“তুমি দিপু না?দ্বীপান্বিতাদির ভাই? বিষ্ণুপুরের বসাকপাড়ায় বাড়ি তো? ব্রজমন্দির স্কুলে পড়তে। সাইকেলে স্কুলে যেতে।
 
দ্বীপেনের অবস্থা প্রায় হতবাক, কোনঠাসা। চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ প্রকট। কোনমতে মাথা হেলিয়ে জানায় যে দ্বীপান্বিতা সান্যাল তারই দিদি।
মেয়েটি আরো বলতে থাকে, “দ্বীপান্বিতাদি তো লেখাপড়ায় বেশ ভালো ছিলো।এমএতে ভর্তি হয়েছিল না? বি এ পাস করার কয়েক মাসের মধ্যেই ত মেশোমশাই মারা যান। সংসার চালানো, মায়ের দেখাশোনা, ভাইয়ের লেখাপড়া, এইসব দায়িত্ব দ্বীপান্বিতাদির ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। দ্বীপান্বিতাদি তার পর থেকেই ত টিউশানির পেশাটা ধরে নেয়।
 
দ্বীপেন এতক্ষন পরে, ইতস্তত করে জিজ্ঞ্যেস করে- আমাদের সম্বন্ধে এত কিছু বলার পরেও কিন্তু ঠিক চিনে উঠতে পারি নি।আপনিও কি...
 
দ্বীপেনকে থামিয়ে দিয়ে মেয়েটি বলে ওঠে আমাকে না চিনলেও, পেশাটা আন্দাজ করতে পারছো বোধ হয়।... দ্বীপান্বিতাদি ত এখনও বিয়ে করেনি, তাই না? তুমি কি সমীরনদাকে চেনো? সমীরনদাও তো এখনও বিয়ে করেনি।
 
দ্বীপেনের আশ্চর্য ভাবটা আরও বেড়ে যায়। সমীরনদাকে ত এখনও, টিউশানি থেকে ফেরার পথে, দিদির সঙ্গে দেখা করতে দেখেছে কয়েকদিন। দ্বীপেন মনের আনাচে কানাচে খুঁচিয়ে চেষ্টা করে স্কুলজীবনের বন্ধু বান্ধবীদের নাম মনে করতে। কিছুতেই, চেহারার সঙ্গে নাম মিলিয়ে মনে করতে পারে না। দ্বীপেনের প্রশ্নের জবাবে মেয়েটি সরাসরি পরিচয় দিচ্ছে না।
 
একটু পরেই, মেয়েটির গলা যেন স্বগতোক্তির মতন কিছুটা ভারী শোনায়।--মেশোমশাই মারা যাওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই বাবাও মারা যান। ভাগ্যিস দিদির বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল।দিদিদের শ্বশুরবাড়ির অবস্থাও খুব একটা স্বচ্ছল ছিলো না। দিদি জামাইবাবুর গলগ্রহ হয়ে থাকাও বেশীদিন সম্ভব হল না। আমাকেও একটা কাজের কথা ভাবতে হোল।চাকুরীর প্রলোভনে, দিল্লি এসে, একটা পেশার তকমা লেগে গেল।
 
এক সেকেন্ড থামতেই, গলার স্বর যেন আরও ভারী হয়ে ওঠে, “জানো দিপু, তোমাকে না আমার খুব হিংসে হয়। আমার যদি, তোমার দিদির মতন একটা দ্বীপাদি থাকতো! দ্বীপাদির এখনকার দায়বদ্ধতার থেকে মুক্তি তার ভাইয়ের পাশ করে, চাকুরী পেয়ে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরে।
 
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস দ্বীপেন যেন টেরই পেলো না।
 
দ্বীপেনের আরো কাছে এগিয়ে আসে মেয়েটি। চোখে চোখ রেখে, কষ্ট করে আনা, হাসি দিয়ে, যেন কিছুটা আবদার আর অনুনয়ের স্বরে বলে,-“দ্বীপাদির কথা ভেবে অন্তত, তাকে দায়বদ্ধতার থেকে মুক্ত করা পর্যন্ত, কোন প্রলোভনের দিকে তাকিও না।বলেই, দ্বীপেনের চুলের মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে, পেছন ফিরে হনহন করে বেরোবার দরজার দিকে হাঁটা দিল।
দ্বীপেন জিজ্ঞ্যেস করার চেষ্টা করলো, “নামটা ত বললে না?”
 
মনে করতে পারলে না তো? দরকার কী? যদি ভবিতব্য হয়, আবার দেখা হয়েও যেতে পারে কখনো!দরজার কাছ থেকে ঘাড় ফিরিয়ে দ্বীপেনের দিকে কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে, মেয়েটি বাইরের দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
 
ঘাড় ফিরিয়ে কথা বলার সময় দ্বীপেনের হঠাৎ চোখে পড়ে, অফ্-শোলডার টপের খালি ঘাড়ের পিছন দিকে কালো জরুলটা। মনে পড়ে যায়, স্কুলে তারই ক্লাসের কলা বিভাগে পড়ত দেবস্মিতা। দোলের সময় রঙ মাখাতে গিয়ে টের পেয়েছিল জরুলটা। দ্বীপেন দৌড়ে দরজার বাইরে বেরিয়ে ডাকতে যায়। ততক্ষনে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেছে দেবস্মিতা।...