১
ছোট্ট পলা
বাবার পাঞ্জাবীর হাতা ধরে আলতো টান দেয়। মাইকে ভেসে আসছে ঘোষণা—‘দর্শনার্থীদের
কাছে অনুরোধ, আপনারা ধীরে ধীরে শান্তিপূর্ণ ভাবে অগ্রসর হন, অপরকেও
প্রতিমা দর্শনের সুযোগ করে দিন...পূজোর আগামী
দিনগুলো আপনাদের মঙ্গলময় হয়ে উঠুক...।’ পলাশবাবু
দীর্ঘ দেহ ঝুঁকিয়ে তাঁর মেয়ের মুখের কাছে নামিয়ে আনেন কান, ‘কি বলছ
মামনী?’
ক’টা ঠাকুর
দেখা হল, গুনেছ?
হ্যাঁ, অনে—ক গুলো...একটা, দুটো, তিনটে, পাঁচটা, ছটা...নটা। বাবা, নটা ঠাকুর
দেখা হয়ে গেছে!
দশটা হোক
তবে। এটাই লাস্ট। তুমি তো বলেছিলে, দশটা ঠাকুর দেখবে! ভালো লাগছে না?
পলা পায়ের
ব্যথা চেপে হাসি মুখে বলে, ‘হ্যাঁ—অ্যাঁ খু—ব ভালো। এটা দেখেই বাড়ি যাবো।
বেলঘরিয়া
বেকারি রোডের কাছের ছোট্ট ভাড়া বাড়িটা এখন পলার একমাত্র শান্তির ঠিকানা। তার নিজস্ব বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়তে পারলে এই মুহূর্তে আর সে কিচ্ছু চায় না। মাথার কাছে আছে একটা দক্ষিণখোলা জানলা, সেই
জানলার বাইরে কদম গাছের ছায়া ফেলা একটা মজা পুকুর, মাথার বালিশের কাছে শুকতারা, মা বকলেও, কম আলোয় হলেও শোয়ার আগে একটু চোখ বোলাবেই, আর ঐ
পুকুরের নীচে সকলের অলক্ষ্যে পাতালপুরীতে নিশ্চিত ঘুমিয়ে থাকা এক একলা রাজকন্যার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়া—এইটুকু
জীবনের সব থেকে নিশ্চিন্ত সুখ!
২
‘পলা, পা চালিয়ে
চলো, এখনো ১১ বাড়ি বাকি, ভাবতে পারছ!’
একমাত্র
ছেলের বিয়ে বলে কথা! কোথাও কোনও ত্রুটি তারা রাখতে চায় না। মেয়ে দেখা থেকে শুরু করে বিয়ের বাজার করা, কার্ড ছাপানো, ডেকরেটর্স-ক্যাটারার ঠিক করা, বাড়ি ভাড়া
নেওয়া—এই সমস্ত প্রায় দেড় বছর আগে থেকে করছে দুজন মিলে। সায়ন আসবে আর বলা যায় একেবারে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে। সুজয়ের বেসরকারী কম্পানিতে চাকরি, ছুটি বেশী পায় না। আরও পাঁচ বছর কাজ করবে ভেবে রেখেছে। ৬০-এ অবসরের পর পরই এই কম্পানিতে জয়েন করেছে। শরীর এখনও কর্মক্ষম, কাজ থেকে বসে গেলেই হঠাৎ বুড়োটে মেরে যাবে। তাই সুজয় আগে থেকেই পরিকল্পনা করে ব্যবস্থা করে রেখেছিল। কিন্তু আগের মতো দৌড়ঝাঁপ করতে তো পারে না! পলার
অবস্থাও তথৈবচ।
তাই দুজনে মিলে টুকটুক করে সব কাজ গুছিয়েছে। এখন একেবারে নিকট আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিমন্ত্রণ পত্র দিয়ে আসার কাজটা বাকি। সেটাই এই সপ্তাহান্তের প্রধান কাজ। যদিও গাড়ি ভাড়া করেছে সারাদিনের জন্য, কিন্তু সব জায়গায় তো গাড়ি ঢোকে না। অগত্যা হাঁটা নয় নয় করেও কম হল না। সকাল নটায় বেরিয়েছে, এখন বিকেল চারটে। আজ সব বাড়ি কভার করা হয়ে উঠবে না। কাল আবার বেরোতে হবে। পলার পা দুটো টনটন করছে।
সকাল থেকে
বেরিয়ে বারোটা বাড়ি কভার করেছে ওরা। এখন তো আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাওয়া-আসা প্রায় উঠেই গেছে। এই
অবসরে ওদের পেয়ে কেউ সহজে ছাড়তে চায় না। অনেক কিছু জানতে চায়, ‘ছেলে কি
বিদেশেই থেকে যাবে? বিয়ের পর বৌ তোমাদের কাছে থাকবে, নাকি সায়ন নিয়ে যাবে? মেয়ের ঠিকুজী মিলিয়েছ?’ ইত্যাদি কত প্রশ্ন। পলা-সুজয় যথাসাধ্য
সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে কর্তব্য সেরে পরের গন্তব্যে যায়।
‘শুনছ?’ পলার ডাকে
সুজয় মুখ ফেরায়। ওরা এখন সুজয়ের মাসতুতো দিদির বাড়ির সামনে। ‘আজ এটাই
লাস্ট, কি বলো?’
কেন, তুমিই তো
বলেছিলে, আজকেই সব সেরে ফেলবে?
না না, পারছি না
গো! ভীষণ পা ব্যথা
করছে।
পলার এখন
একমাত্র চাওয়া সল্টলেকে তাঁদের ছিমছাম সাজানো দুজনের সংসারের ছোট্ট ফ্ল্যাটের বেডরুমে গা এলিয়ে দেওয়া। আহা, নিজের বাড়িতে, নিজের বিছানায় শুয়ে থাকার মতো আরাম আর কীসে আছে!
৩
সায়ন
ঠাণ্ডা মাথার ছেলে। কিন্তু আজ ও পৌলোমীকে ভীষণ বকেছে। গ্রোসারি শপিং-এ মা-কে একলা ছাড়া তার মোটেই উচিৎ হয়নি। শত হলেও আমেরিকার পথঘাট এখনও মা-র কাছে সরগড় হয়নি। তার উপর বাবা চলে গেলেন সেও মাত্র কয়েকটা মাসই তো হয়েছে! পৌলোমীও
অপ্রস্তুত। সারাদিন
ধরে দুজন মিলে গাড়ি নিয়ে তন্ন তন্ন করে সমস্ত শহর চষে ফেলে একটি পার্কে অবশেষে পলাকে খুঁজে পেয়েছে। সায়নকে দেখেই বলে ওঠেন, ‘বাড়ি যাবো
রে, আর হাঁটতে পারি না! সেই কখন থেকে বাড়িটা খুঁজছি! বাড়িটা যে
কোথায়, খুঁজেই পাচ্ছি না!’