গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৮

মনোজিৎকুমার দাস

উতল মন

সে আমাকে প্রথম ভালবাসতে শিখিয়েছিল।  কতই বা তখন আমার বয়স । আমি সবেমাত্র সাত ক্লাস পাশ করে আট ক্লাসে উঠেছি, ও আমার থেকে দুক্লাস উপরে পড়তো। একই পাড়াতেই আমরা থাকি। ক্লাস সেভেন থেকে আমি প্রথম হয়ে এইটে উঠলাম। আর ও ক্লাস নাইন থেকে প্রথম হয়ে টেনে প্রমোশন পেল। একই স্কুল বাসে আমরা রোজ স্কুলে যেতাম , ও কিন্তু আমার সঙ্গে যেতে আলাপ করতে আসেনি একদিনও ।  উপর ক্লাসের ছাত্রদের সাথে কথা বলার সাহস আমার সে বয়সে ছিল না। 
মিরপুরে ১০ নম্বর গোলচত্ত্বর থেকে আমরা স্কুলে যাওয়ার  জন্যে স্কুল বাসে উঠতাম ,আর স্কুল শেষে আবার ওখানটাতে বাস থেকে নামতাম। আমাদের মধ্যে সুশোভন ও থাকতো। স্কুলবাসের প্রায়  সবাই আমাকে চিনে , আমি মনে মনে ভাবতাম।  প্রতি ক্লাসে সুশোভন  প্রথম হওয়ায় সবাই সুশোভনকে যেমন চিনতো, আমিও তেমন ভাবেই চিনতাম।  সুশোভন আমাকে চিনতো তবে তেমনভাবে চিনতো কিনা জানি না।
স্বাস্থ্যচেহারায় আমি আর পাঁচজনের চাইতে ভাল এটা আমি নিজেও বুঝতাম । সত্যি কথা বলতে নজর কারার মতো চেহারা আমার ,তা আমাদের ক্লাসের ছেলেমেয়েদের বুঝতে কষ্ট হয়নি।  একই পাড়ায় বাস করে, একই স্কুলবাসে যাতায়াত করেও আমার চোখ কিন্তু সুশোভনের  দিকে পড়েনি ।
আমাদের স্কুলের অডিটোরিয়ামে বার্ষিক পরীক্ষাফল ঘোষণা করেছিলেন হেডস্যার। অন্যান্য স্যার ছিলেন,ছিলেন  অভিভাবকেরাসহ অনেক গুণীজন। আনুষ্ঠানিকতা শেষে হেডস্যার ক্লাস নাইন থেকে ফল ঘোষণা করতে শুরু করলেন। সুশোভনের নামটা তার মুখ থেকে প্রথমে উচ্চারিত হলো। সুশোভন ডেক্স চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানালো।
আমি তার মুখটা দেখেই চিনে ফেললাম। ওতো আমাদের পাড়ার , আমরা একই স্কুল বাসে যাতায়াত করি,আমি মনে মনে বললাম। আমাদের স্কুলটা ঢাকার নাম করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এক এক ক্লাসে চার পাঁচটা করে সেকশন । একই ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের চেনার উপায় নেই। এক সময় আমাদের ক্লাসের রেজাল্ট ঘোষণার পালা এলো। ক্লাসের প্রথম হিসাবে আমার নাম হেডস্যার ঘোষণা করলেন। আমার আশা ছিল আমি প্রথম না হলেও সেকেন্ড হবো।আমার রেজাল্ট আমি উল্লাসিত। রেজাল্ট ঘোষণার অনুষ্ঠান শেষে ফটো তোলার হিড়িক পড়ে গেল। সুশোভনই প্রথম এগিয়ে এসে আমাকে বললোকনগ্রাচুলেশন অন ইওর এক্সসেলেন্ট রেজাল্ট, সুরঞ্জনা।”  আমার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলোসেম টু ইউ । উইথ গুড উইসেস।ওটাই ছিল আমাদের প্রথম কথা বলা। তারপর থেকে আমাদের দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা পড়ে উঠলো।
তারপর সুশোভন এক বছরের কয়েক মাস বেশি স্কুলে থাকলো। ক্লাস টেনের টেস্টের পরও এস.এস.সি. পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা একসাথেই স্কুলে যেতাম ।ওদের পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পরও ওর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। পরীক্ষা দেবার পর প্রায় প্রায়ই ও আমাদের বাড়ি আসতো। আমার বাবামা আর ভাইবোনেরা তাকে ভালচোখেই দেখতো।আমার মা আর েেছাট বোনটির সাথে আমিও দুতিন বার ওদের বাসায়ও গিয়েছি।
ওর বাবা একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এক্সিকিউভিট পদে প্রমোশন পেয়ে মিরপুর থেকে  সিলেটে শহরে বদলী হওয়ায় বাবা মা ভাইবোনের সঙ্গে সুশোভনকেও  সিলেট শহরে চলে  যেতে হলো। সেই থেকে  সুশোভনের সঙ্গে আমার সর্ম্পকের ছেদ পড়লো।
ও আমাকে ভালবাসতে শিখিয়েছিল। সত্যি এক সময় আমরা পরষ্পর পরষ্পরকে ভালবেসে ফেলি ।  বয়:সন্ধিক্ষণের দুজন তরুণতরুণীর মধ্যে নিষ্কাম প্রেমের একটা সম্পর্ক আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল।
তারপর কয়েক বছর কেটে গেছে । ওর  দেখা পাইনি। সে সময়  মোবাইল ফোন থাকলে এমনটা হয়তো হতো না।  মনের অজান্তে একদিন ওকে ভুলে গেলাম।
এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি ইংরেজিতে। অনার্সে ভাল রেজাল্ট করেছি। মাস্টার্স শেষ করে বের হয়ে যাব অল্পদিনের মধ্যে ।
বয়ঃসন্ধিক্ষণ পেরিয়ে আসার বছর দুতিন পর  ডিপার্টমেন্টের একটা ছেলের সঙ্গে আমার প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠায় আমাদের দিন ভালই কাটছিল । এখন আমাকে পূর্ণ যৌবনা তরুণীই বলতে হয় । এখন আমার ভালোমন্দ বুঝবার ক্ষমতা আমার আছে বলে মনে হয় ।
 হঠাৎ করে একদিন সুশোভন আগমন ঘটলো।এতদিন কোথায় ছিলে সুশোভন ?” এতদিন পরে তার সাথে প্রথম সাক্ষাতে আমার প্রশ্ন । ও আমতা আমতা করে কি যেন বলতে চাইলো ।
ওকে এড়িয়ে যেতে চাইলাম, এখনো এড়িয়েই যেতে চাচ্ছি। কিন্তু ওকে এড়িয়ে যেতে পারছি না,আসলে কিন্তু ওইতো প্রথম আমাকে ভালবাসা কাকে বলে শিখিয়েছিল। আমাকে ছাড়া ও এক সময় যেন নিঃশ্বাস নিতে পারতো না।
ওর সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছে প্রতিদিনই এখনো । ওকে কাছে পেলে এখনো আমার খুব ভাল লাগে । এদিকে, ডিপার্টমেন্টের ছেলেটিকে  আমি কী বলবো ; ভেবে পাচ্ছি না। এখন আমি কী  করবো!