গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৮

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

লোভ 

কাপড়ের দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল অনিমেষ। ঝাড়া দুঘন্টা দাঁড়িয়ে আছে সে। শ্রীরূপা ভিতরে ঢুকেছে শাড়ি কিনতে। এবার বিরক্ত লাগছে
, ক্রমেই অধৈর্য হয়ে উঠছে অনিমেষ। স্ত্রীকে সে ভালবাসে,একটু বেশিই ভালবাসে। শ্রীরূপার কোন ব্যাপারেই তাকে নিরাশ করে না।  কিন্তু এই একটা ব্যাপার সে একেবারেই পছন্দ করেনা। মেয়েদের শাড়ি-গয়না কেনা, পছন্দ করা কোনটারই চোখ তার নেই,  মেজাজও নয়। তোমার যা টাকার দরকার নিয়ে যাও বাপু, সারাদিন ধরে কেনাকাটা করো, কোন আপত্তি অনিমেষের নেই। সে বড় চাকরি করে, স্ত্রীর প্রয়োজনমত টাকা-পয়সা সে দেয়, দিতেও পারে। চাই কি বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সারাদিন কোথাও ঘুরে এস, অনিমেষের তাতেও আপত্তি নেই। বিনোদ আছে, পুরনো লোক। অনিমেষের কি চাই সে জানে। দুপুরে, বিকেলে অফিস থেকে ফিরলে দু-একটা দিন সে চালিয়ে নিতে পারবে।

গতকাল কি মরতে যে কথা দিয়েছিলো শ্রীকে, অনিমেষই  জানে! তখন রাতের বেলা, স্ত্রীর সঙ্গে  সোহাগের সময়। সে সময় অমন দু-চার কথা দিয়ে ফেলতেই পারে। কিন্তু সত্যি সত্যিই যে সকাল হতেই কোনরকমে নাকেমুখে ব্রেকফাস্ট গুঁজে বাজার ছুটতে হবে, অনিমেষ ভাবে নি। রবিবারের একটা বেলা গেল মাটি হয়ে। এখন বসে থাক, কখন বেরোবেন তিনি। বেরোন তো নয়, আবির্ভাব! বিরক্তমুখে আবার একটা সিগারেট ধরাতে গিয়েও ধরালো না অনিমেষ। প্যান্টের পকেট থেকে গাড়ির চাবি বার করে এগিয়ে গেল। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে গাড়িতে বসে থাকাই ভাল। এখানে দেখতে না পেলে শ্রীরূপা ফোন করে জেনে নেবে সে কোথায় আছে। তার নিজের বুদ্ধিতে গাড়ির কাছেও চলে যেতে  পারে। সুতরাং,  সেখানে গিয়ে বসাই ভাল।
এগিয়ে গেল অনিমেষ।

(২)

গাড়ির ভিতর বসে একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিল  অনিমেষ। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সে বুঝতে পারেনি। হঠাৎ গাড়ির কাঁচে একটা জোর ধাক্কা আর কিছু মানুষের আওয়াজে তার ঘুম   ভাঙ্গল। বাইরে বেশ বড় জটলা। জোর গলায় তাকে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বলা হচ্ছে। ভুরু  কুঁচকে উদ্বিগ্ন মুখে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল অনিমেষ। অনেক লোক তার গাড়িটাকে  ঘিরে রয়েছে, সবাই মিলে কি যে বলছে, কিছু বুঝতে পারল না সে। কারো কথাই শোনা যাচ্ছে না। হাত উলটে ঘড়ি দেখল অনিমেষ। এখন প্রায় সোয়া তিনটে। শ্রীরূপার এখনও শাড়ি কেনা হল না? চিন্তিত দেখাল তাকে। কিছু একটা বলতে গেল অনিমেষ, জনতার চীৎকারে তার গলা ডুবে গেল। সকলেই কিছু বলছে, কি যে বলছে.... বুঝতে পারছে না। হাত তুলে থামাতে চাইল, কিন্তু লোকজন যেন মারমুখী। শেষে একজন হাত তুলে থামতে বললে কিছুটা গোলমাল শান্ত হল। যা জানা গেল, তা এইরকম---
কাপড়ের দোকানে একজন মহিলা কাস্টমার শাড়ি কিনতে এসে তিনখানা দামী শাড়ি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর হাতব্যাগের ভিতরে দুটো আর পরণের শাড়ির  কুঁচির ভিতরে লুকোন ছিল  আরো একটা। দোকানের এক কর্মচারীর চোখে পড়লে সে জবাবদিহি করে, কিন্তু মহিলাটি অস্বীকার করেছেন। দোকানে দাম মিটিয়ে শাড়ি নিয়ে চলে যেতে বলায়, তাও অস্বীকার করাতে শেষে পুলিশ ডাকতে হয়। মহিলা পুলিশ এসে সার্চ করে তিনখানি শাড়ি পায়। শাড়ি তিনখানির দাম মোট এগারো হাজার টাকা। কিন্তু তাঁর কাছে সে টাকা না থাকায় পুলিশ তাঁকে দোকানে আটকে রেখেছে। সেই মহিলার নাম শ্রীরূপা রায়, অনিমেষের স্ত্রী। 

মাথায় যেন বাজ ভেঙ্গে পড়ল অনিমেষের। চোখমুখ অপমানে লাল। কি করে জানা গেল, মহিলা তার স্ত্রী? মহিলা নিজেই জানিয়েছেন, দোকানের মালিককে, গাড়িতে যে তাঁর স্বামী অপেক্ষা করোছেন তাও বলেছেন। গাড়ির নম্বরও। মাত্র এগারো হাজার টাকা, তার জন্য চুরি! মান- সম্মানের  কথা তার কি একবারও মনে হল না, অনিমেষের কথাও নয়! দোকানে যেতে ইচ্ছে করল না। কোন মুখে সে যাবে? আর ওই মুখের সামনে ঠিক এই মুহূর্তে যাবার ইচ্ছে নেই। গাড়ির ভিতরে এসে বসতে চাইল অনিমেষ। তার এখন নিজের কাছে দুদন্ড বসা দরকার। কিন্তু জনতা দাবী  করছে আগে টাকা মেটানো হোক, নইলে মহিলা সারারাত থাকবেন পুলিশের লকআপে। অপমানের চূড়ান্ত! সেই ভদ্রলোককে ডেকে নিল অনিমেষ। মাথা স্থির করে নিয়েছে সে। ডেকে বললে, বাড়ি থেকে টাকা এনে  এখনই মিটিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, আগে যেতে দিক। কিন্তু তারা মানতে রাজী নয়। এমন টাকা দেবার নাম করে সবাই পালায়, তারা আর কাউকে বিশ্বাস করে না। স্ত্রীকে  এইভাবে রোজগারের রাস্তায় নামার কথাও কেউ কেউ চীৎকার করে বলছে। মাথায়  রক্ত উঠে গেল অনিমেষের। শেষে এও ছিল কপালে!  ভদ্রলোককে সঙ্গে যাবার জন্য অনুরোধ করল অনিমেষ। তার সঙ্গে গিয়ে টাকাটা নিয়ে এসে দোকানে মিটিয়ে দিলে যদি তাঁরা শ্রীকে ছেড়ে দেন...। তাহলে তো আর অনিমেষের পালিয়ে যাবার ভয় থাকে না। চাই কি আরো দু একজনকে ডেকে নিতেও পারেন উনি।  রাজি হলেন ভদ্রলোক।

মনস্থির আগেই করে নিয়েছিল অনিমেষ। গাড়িতে যেতে যেতে আরও মন কঠিন হল। সামান্য কটা শাড়ির জন্য এত লোভ! কত দাম শাড়িগুলোর, মাত্র এগারোহাজার টাকা, এর জন্য নিজের,  পরিবারের সমস্ত মান-সম্মান ধুলোয় মেশানো! কিন্তু সে নিজেও কি হাত বাড়ায়নি লোভীর মত গতকাল রাতে? সেই লোভেই তো আজ শ্রীরূপা দোকানে এল। সেই লোভেই তো অনিমেষ আজ তাকে সঙ্গ দিল।  চোখ ভরে এল জলে। মাথার শিরা দপ্‌দপ্‌ করতে লাগল। 

(৩)

বাড়িতে ঢুকেই হাঁক দিল বিনোদকে। অনিমেষের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল বিনোদ। দাদাবাবুর একি হাল! কিন্তু দিদিমনি কই? তাঁর কি কিছু হয়েছে? কিন্তু প্রশ্ন করার সুযোগ সে পেল না। তার আগেই অনিমেষ ভিতরের ঘরে ঢুকে গেছে। বিনোদ সেই ভদ্রলোকটীকে কিছু জিজ্ঞেস করবে ভেবেও কি মনে করে কোন কথা বলল না। তাঁকে একটি চেয়ারে বসিয়ে ভিতরে ঢুকতে যাবে, অনিমেষ বাইরে এল। বিনোদের হাতে টাকা দিয়ে নির্দেশ দিল ভদ্রলোকের সঙ্গে গিয়ে দোকানে  টাকা মিটিয়ে বৌদিকে নিয়ে আসতে। কথা শেষ, ভিতরে ঢুকে গেল অনিমেষ।

তারপর থেকে অনিমেষকে আর কেউ দেখেনি। বিনোদ নয়, শ্রীরূপা নয়, তার অফিসের লোকেরা নয়, পাড়ার লোকেরা নয়...এমন কি তার বাড়ির লোকেরাও নয়। সে হারিয়ে গেছে। অনিমেষ কি তার ভিতরের লোভটাকে সংযত করতে হারিয়ে গেল? কোথায় যে গেল!
লোভ বড় কষ্টের...ভালবাসার লোভ আরো, আরো কষ্টের...!!