ইন্দোরের
স্বস্তিক ইমারত
ইন্দোরের
স্বস্তিক ইমারত তখন তৈরি হচ্ছিলো। সেখানে অনেক লেবার,
রাজমিস্ত্রি, ঠিকাদার মিলে ইমারত তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। দিন সারা চলতে থাকতো
কাজকর্ম সেই সঙ্গে লোকজনের শোরগোলও। পাহারার কাজেও ছিল বেশ কিছু গার্ড। গার্ডের মধ্যে
একজনের নাম ছিল ইকবাল। ইকবালের আর্থিক অবস্থা একেবারে খারাপ ছিল না কিন্তু তার ছিল পানের
দোষ। আর হাতে দু চারটে উপরি টাকা এলো তো ব্যাস,
সে বসে যেত জুয়ার আড্ডায়। এ সব কারণে এমন একটা দিন এলো যখন তার সংসার আর
চলতে চাইলো না, ধার
দেনায় সে ডুবে গেলো। ফলত মনের দিক থেকে সব সময় সে অস্থির থাকত।
এমনি
একদিনের কথা। সে দিন সে বোধহয় স্বাভাবিক থেকে একটু বেশীই পান করে নিয়েছিল। ডিউটিতে
এসেই চৌকিদারকে চারদিক একবার ঘুরে দেখে নিতে হয় তখনকার জিনিসপত্র কোনটা কোথায় আছে বলে।
ইকবাল সেদিন গ্রাউন্ডের সব কিছুই দেখে নিয়ে তারপর ছাদে গেলো। সেখানে কি কি আছে না আছে
তাই হবে সে দেখতে গিয়েছিল। টলতে টলতে সিঁড়ি বেয়ে তো সে ছাদে গিয়ে হাজির হল। ইকবাল আর
একজন চৌকিদার তখন ছাদে ছিল। এর মধ্যে ইকবাল নাকি ছাদ থেকে উঁকি মেরে কিছু দেখার চেষ্টা করছিল আর ঠিক এমনি সময় পা তার
হড়কে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে আঃ আঃ আঃ শব্দের পরেই ভয়ানক একটা মৃত্যু চীৎকার শোনা গেলো। ইকবালের শরীরটা ছাদ
থেকে একেবারে নিচে গিয়ে পড়ল। বেশ কিছু স্থানীয় লেবার ও লোকজন এসে দেখল, ইকবালের মৃত
দেহ রক্তাক্ত হয়ে থেঁতলে পড়ে আছে। দেহটা তার চারদিক থেকে ফেটে গেছে, মাথায় চির খেয়েছে। একটা হাত, শরীরের কিছু মাংসের টুকরো এদিক ওদিক ছড়িয়ে
ছিটিয়ে পড়ে আছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য। এতটা হবার কারণ ছিল। তার দেহটা প্রথমে এসে পড়েছিল
ভূতলে রাখা এক কঠিন পাথরের ওপর, সেই পাথরের আঘাতে ইকবালের দেহটা এমনি বিকৃত আকার ধারণ করেছিল।
এ
মৃত্যু নিয়ে নানা লোকে নানা কথা বলে, কেউ বলে ইকবাল আত্মহত্যা করেছে। ও নাকি চরম অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছিল।
আবার কেউ বলে, সেদিন
ছাদে তার সঙ্গে যে চৌকিদার ছিল সেই নাকি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। আবার কেউ এও
বলে যে ওসব কিছু না--অতিরিক্ত
নেশা করার ফলে শরীরের তাল রাখতে না পেরে এমনি ঘটনা ঘটে গেছে।
সে
যাই হোক, ইকবাল
অকালে, অস্বাভাবিক
ভাবে মারা গেছে এটাই সত্যি ছিল। তারপর বেশ কটা বছর কেটে গেছে। স্বস্তিক বিল্ডিং এখন
মার্কেট কমপ্লেক্স। অনেক দোকানপাট রয়েছে এতে সে সঙ্গে আছে একাধিক এ.টি.এম. চেম্বারও।
এ জাগায় দিনভর লোকজনের আনাগোনা, চহল-পহল
চলতে থাকে। রাত নটার পর থেকে চুপচাপ হতে শুরু করে। দিনের পাহারার জন্যে কিছু গার্ড
নিযুক্ত আছে। আর রাতের পাহারায় থাকে কিছু নাইট গার্ড । এখানে প্রায় সবাই জানে যে ইকবাল
মারা যাবার পর থেকে বিল্ডিঙে কিছু কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে চলছিল। কিন্তু সে সব ছিল
ছুট-ছাট ঘটনা। যার জন্যে বাইরে
তার প্রচার-প্রসার
বিশেষ একটা ছিল না।
মার্কেট
শুরু হবার বছর খানেক পরে ঘটলো একটা ঘটনা। রাজভান দিনের বেলায় শুয়ে ছিল, মানে দুপুরে খেয়ে একটু দেওয়াল ঘেঁষা নিদ্রা
নিচ্ছিল, ঠিক
এমনি সময় একটা লোক এলো, বলল এই ডিউটিতে ঘুমাবি না। রাজভান ঘুমের মধ্যেই তাকে গালি দিয়ে উঠলো।
তারপর ঝিম ঘুমের মধ্যে ওর মনে হল লোকটা ওর পা ধরে টানছে। ওকে টেনে প্রায় এক হাত দূরে
নিয়ে গেল। রাজভান, এই,
এই, ছাড়, ছাড়, বলে উঠে বসল। সে তার সামনে একটা ছায়া
আকৃতির লোককে
দেখল। ওকে কিছু বলতে যেতেই লোকটা ভেনিস হয়ে গেলো
!
অন্য
এক গার্ড মনোজ একদিন রাজভানকে বলল, একটা লোককে দেখলি, তাকে দেখে কেমন যেন মনে হল,
লোকটার শরীরের রং কেমন যেন বদলে যাচ্ছিলো। লাইটের নিচে
তাকে কেমন ফেকাসে লাগছিল। আবার অন্ধকারে দাঁড়ালে তাকে ভীষণ কালো লাগছিলো, যেন শুধু একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছিল !
রাজভান
বলেছিল--আমি
জানি এ ইমারতে ভূত আছে। কেউ রাতে হঠাৎ হঠাৎ আলো জ্বালায়-নিভায়। জানিস তো এখানকার লিফ্ট বেশী রাতে হলে আপনি আপনি চলে, আপনি আপনি
থেমে যায়।
মনোজ
বলে--আমি তো তা জানি না, আমি তো ভাই দু দিন আগেই এখানে জয়েন করেছি।
তবে একটা গল্প এক জনের কাছে শুনলাম, এই বিল্ডিঙে নাকি ইকবালের ভূত থাকে। ও বিল্ডিং তৈরির সময়ে ছাদ থেকে
পড়ে মরে ছিল। ও এখানকার চৌকিদার, গার্ডকে নাকি দিনের বেলাতেও ভয় দেখায়
!
তার
এক দিন পরের কথা। মনোজ দুপুরে ঘর থেকে আনা খাবার খেয়ে একটা চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছিল।
ঝিমানোর মাঝেই সেই কালকের লোকটা এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালো। সে চীৎকার করে বলে উঠলো, এই ঘুমাচ্ছিস কেন রে ! বলার সাথে সাথে লোকটা থাপ্পড় দেবার জন্যে
তার একটা হাত মনোজের গালের কাছে নিয়ে এলো। কিন্তু সে চেষ্টা করেও মনোজের গাল ছুঁতে
পারছিল না। মনোজের ঝিমঘুমে দেখতে পারছিল সব কিছু। তার সম্পূর্ণ ঘুম ভাঙতেই লোকটা দ্রুত
পায়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো ! পরে মনোজের মনে হয়েছিল লোকটা ইকবালের ভূত হবে। তার হাতে মন্ত্রপূত তাবিজ
ছিল বলে তাকে আর থাপ্পড় মারতে পারে নি।
এরপর
আরও এক দিনের কথা। এটাই এখানকার সবচে বড় ঘটনা। সে দিন চৌহান নামের একজন গার্ড রাতের ডিউটিতে ছিল। রাত তখন
এগারটা বেজেছে। একটা কালো মত লোক তার সামনে এসে বলল,
আমায় টপ ফ্লোরে যেতে হবে। লিফটটা চালু করে দেবে ?
চৌহান
তার সঙ্গে গেলো। লিফটের পাশের দেওয়াল থেকে কানেকশনের সুইচ ও অন করে দিয়ে বলল, এবার যান
!
--তুমি আমার সঙ্গে একটু চলো, আগন্তুক লোকটা বলল।
চৌহান
তাকে সাহায্য করতে লিফটে ওর সঙ্গে চড়ে বসলো। ও বলল, ক’তলায় যাবেন ?
লোকটা
এবার বলল, ছ’তলায়--
চৌহান
বলে উঠলো, না
লিফ্ট তো পাঁচ তালা অবধি আছে, ছয় তালা তো ছাদ ?
আগন্তুক
লোকটা বলে উঠলো, তবে
ছয় তালার সুইচ লাগা কেন ?
ছয়
তালার সুইচ ? আশ্চর্য
হল চৌহান, এই
পাঁচ তালা
বিল্ডিঙে ছ’তলার
সুইচ এলো কি করে ! ওর
চোখের সামনে ছয় নম্বরের সুইচটা অন্য নম্বরের সাথে জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল। ততক্ষণে চৌহানের
সামনে লোকটা ছ’তালার
সুইচ চেপে দিয়েছে। সাঁই সাঁই করে লিফ্ট ওপরে উঠে চলেছে। চৌহানের চোখ এবার ভাল ভাবে
লোকটার দিকে পড়লো। ও তৎক্ষণাৎ ভয়ে কেঁপে উঠলো,
লোকটার শরীর নেই,
শুধু একটা ছায়া ধারণ করে আছে। ভয়ে চীৎকার দিয়ে উঠলো চৌহান,
কে তুমি ?
লোকটাকে
তখন মাতাল বলে মনে হল, ও
বলল, এসো, আমি কে আমি দেখাচ্ছি
তোমায়।
চৌহান
যেন স্বপ্ন দেখছে, লিফ্ট
একেবারে খোলা ছাদে উঠে এসেছে। ছায়াধারী আগন্তুক তখন চৌহানকে ধমকে উঠল, এই আয় এখানে। আমার নাম তুই শুনেছিস ? আমি আজ সাত বছর ধরে এখানে আছি। আয় দেখবি,
তুমি, থেকে একেবারে তুই’তে ছলে গেছে লোকটা !
চৌহানের
মনে হল, সে
যেন আর নিজের সত্ত্বায় নেই, সে লোকটার পেছনে পেছনে এগিয়ে গেলো। লোকটা ছাদের এক কিনারায় এসে বলল, আমি ইকবাল,
ছাদের এই কিনারায় আমায় রোজ আসতে হয়।
স্তব্ধ
হয়ে চৌহান দাঁড়িয়ে আছে। তাকে কেউ যেন চারদিক থেকে বেঁধে দিয়েছে। ও নড়াচড়া করতে পারছিল
না। ও যেন শুধু মাত্র দর্শকের ভূমিকা পালন করতে এখানে এসেছে।
ইকবালের
প্রেতাত্মা আরও এগিয়ে গেল, ছাদের রেলিং ধরে বারবার উঁকি মারতে লাগলো।
চৌহান
কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু
পারছে না। ও দেখতে পেলো, লোকটা, লোকটা
হাওয়ার মত তার দু’পা রেলিঙের ওপর তুলে দিয়েছে
!
অনেক
কষ্টে চৌহানের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, এই, এই, আরে...
দেখতে
দেখতে চৌহানের সামনে লোকটা ঝাঁপ দিলো, আঃ আঃ আঃ শব্দ হল, লোকটা ছাদ থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে,
মুহূর্ত পরে ভীষণ জোরে একটা আর্তনাদ চৌহানের
কান যেন বিদীর্ণ করে গেলো। তারপর আর কিছু তার মনে নেই।
পরদিন
সকালে চৌহানের যখন জ্ঞান ফিরল ও নিজেকে একটা হাসপাতালে পেলো। সহকর্মী কয়েকজন গার্ড
তাকে ঘিরে আছে।
রাজভান
প্রশ্ন করল, কি
হয়েছিল তোমার ?
চৌহান
চিন্তা করতে থাকলো।
--কি হয়েছিল তোমার ? মনোজ চৌহানের একটা হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে উঠলো।
--হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়ছে তার নাম--ইক-বাল, লোকটা মরে গেছে ? চৌহান উল্টো প্রশ্ন করলো।
রাজভান
কিছুই বুঝতে পারল না, বলল, কে মরে গেছে
?
--ইকবাল আমার সামনে ছাদ থেকে ঝাঁপ দিলো। ওর মরার চীৎকার আমি শুনেছি, ভয়ের সুর নিয়ে চৌহান বলে উঠলো।
সঙ্গের
এক সিনিয়র গার্ড গম্ভীর গলায় বলল, ওকে এখন বিশ্রাম করতে দে। আমি ধারণা করতে পারছি ওর কি হয়েছিল।
সমাপ্ত