‘এবং অস্পৃশ্য হাত’ / বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়
গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ৩৭টি গল্প নিয়ে ।
আকার ও প্রকরণের দিক দিয়ে গল্পগুলিকে অনুগল্পই বলবো । বাংলা সাহিত্যে গল্প
বা গদ্যকাহিনীর ক্ষেত্রে ‘অণুগল্প’ ধারণাটি
নিতান্তই নবীন । ওয়েব পত্রিকাগুলিই অণুগল্পের ধাত্রীগৃহ । অভিধা থেকেই স্পষ্ট এমন
গল্প আকারে ছোট হবে । কিন্তু কত ছোট তার কোন সর্বজনগ্রাহ্য মিমাংসা এখনও পর্যন্ত
কেউ করেছেন এমন জানা নেই । অনেকে বলেন অনুগল্পের পরিধি এক হাজার শব্দের কম হবে,
আবার চিনা সাহিত্যে নাকি এমন ক্ষুদ্র অবয়বের
গল্পকে বলে ‘স্মোকলং
ফিকশন, ইংরাজি সাহিত্যে
ফ্ল্যাস ফিকশন নামটিও বেশ পরিচিত । অন্তর্জালের সামাজিক পরিসরে এবং ওয়েব
পত্রিকাগুলির সৌজন্যে অনেক অনুগল্প পড়ার সুযোগ হচ্ছে,বেশ কিছু অনুগল্পের সংকলনও বের হচ্ছে । এটা
নিশিতভাবেই অভিনন্দনযোগ্য ।
প্রকরণগতভাবে ছোট গল্পের সঙ্গে অনুগল্পের খুব বেশি প্রভেদ আছে বলে আমি মনে
করিনা । সার্থক ছোট গল্পের নির্মাণের যে মূলগত উপাদান নাটকীয় আকর্ষণীয়তা,
উৎকন্ঠা, চরম মূহুর্ত এবং লিখনশৈলীর সঙ্ঘবদ্ধতা । অণুগল্পের
ক্ষেত্রেও এই মূলগত বৈশিষ্ট্যগুলি বজায় থাকা চাই । ছোট গল্পের ভগীরথ রবীন্দ্রনাথের
কথায় -
...... নাহি বর্ণনার ছটা
ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ব নাহি উপদেশ ।
অন্তরে অতৃপ্ত রবে
সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ” ।
ছোট গল্পের মত
অনুগল্পেও থাকবে না ঘটনার ঘনঘটা কিংবা বর্ণণার ছটা, থাকে না তত্ব, উপদেশ, থাকে অতৃপ্তি - শেষ না হওয়ার অতৃপ্তি । তবে দুটির মধ্যে একটা
মূলগত প্রভেদ থাকেই । গল্প তৈরি হয় কতকগুলো
মুহূর্ত নিয়ে একাধিক দৃশ্যকল্পের নির্মাণ হতে পারে । কিন্তু একটি সার্থক অনুগল্পে
একটি বিশেষ মুহূর্ত একক দৃশ্যকল্প নির্মাণের মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত হয়। কিছু পরিষ্কার
করে বলা হবে না,
কেবল একটা ইঙ্গিত ছুঁড়ে দিয়েই গল্প শেষ ।
এই যে পাঠকের
অতৃপ্তি যা অনুগল্পের মূল বৈশিষ্ট্য, সেই প্রসঙ্গে আলোচ্য সংকলনের ‘যে
মেয়েটি একদিন’ গল্পটি উল্লেখ করছি । মেধা নামের বন্ধু মেয়েটিকে চিনতেন
লেখক সেই স্কুল জীবন থেকেই । কবিতা লিখতো মেধা । তার সঙ্গে বন্ধুত্বে
লেখক গর্বিত । তারপর স্কুল জীবন শেষ,
সময়ের সাথে দূরে সরে গেছে তারা, মেধা কি করছে্ কত লিখেছে তা জানায় আগ্রহী লেখক
মেধার সন্ধান পান যখন সে শুভময় মাষ্টারের বৌ । সে আর কবিতা লেখে না । “মেধা
নয় শুভময় মাষ্টারের বউ । সে আর কবিতা লেখে না” - এই দুটিমাত্র খন্ড বাক্যের মধ্যই কাহিনীর না বলা বহুস্তরীয় বিস্তার পাঠকের ভাবনায় আসতে পারে । পাঠকের ভাবনাকে উসকে
দেওয়াই অনুগল্পকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত । বিপ্লব সেই লক্ষ্যে সফল ।
বুঝতে অসুবিধা
হয় না যে,
বিপ্লব তাঁর গল্পগুলির উপকরণ সংগ্রহ করেছেন আমাদের মধ্যবিত্ত যাপনের নানান
বিসঙ্গতি আর তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অভিঘাত থেকে । কখনো বা কোন চেনা চরিত্র তাঁর গল্প রচনার
সহায়ক হয়েছে । আমাদের চারপাশের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষনে উঠে এসেছে আমাদের জিজ্ঞাসা, বিষন্নতা,
দ্বিচারিতা, ভন্ডামি, মাটিমাখা মানুষের ঘাম-গন্ধ এবং জীবনের স্বপ্নও । এ সবই বিপ্লবের গল্পগুলির ভাববীজ । অগ্নিদার চোখে লেগে থাকা স্বপ্নের দাগ
দেখেছেন (“আবার কুড়ি বছর পরে’), বৃষ্টিভেজা
যমুনার
ভাঙ্গা চুল্লিতে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িতে ‘স্বপ্নের লিরিক’
শুনতে পেয়েছেন । (‘উড়ন্ত স্বপ্নের লিরিক’) ।
অনুগল্পের নির্মাণশৈলীর সারসত্য শব্দ
ও ভাবনার সার্থক ব্যবহার । সংকলনের নাতিদীর্ঘ ভূমিকায় লেখক সেকথা স্বীকার করেছেন, বলেছেন
“এখানে
চরিত্র আঁকার কোন সুযোগ নেই, আছে
শুধু গল্পের নির্যাস ও দীর্ঘস্থায়ী ফ্লেভার”
। তেমনই একটি গল্পের উল্লেখ করি, গল্পের নাম ‘স্বপ্ন’
। স্বল্পবাক মানব বিশ্বাস মানুষের
লড়াই আর স্বপ্নের গল্প লিখতেন । তাঁর বুকের মধ্যে অষ্ফূট অনুচ্চারিত শব্দের জমাটবাঁধা
স্তর লেখক অনুভব করেছেন । মানবের বুক পকেটে একটা টুকরো কাগজ থাকতো । ঘরে আগুন
লাগলো,
আগুনে পুড়ে মানবের
প্রাণ গেল কিন্তু সেই টুলরো কাগজটাকে আপ্রাণ চেষ্টা করে বাঁচিয়ে রাখলেন । টুকরো
কাগজটায় একটি মাত্র শব্দ লেখা ছিল ‘স্বপ্ন’ । গল্পটা পড়ে আমার মনে হয়েছে ‘অনুগল্পে চরিত্র আঁকার কোন সুযোগ নেই’ এই কথাটার সবটা সত্য নয় । ভাবনার গাঁথুনি আর শব্দের মোচড়ে একট মাত্র
বাক্যেই তা আঁকা যায় বৈকি ! বিপ্লবের গল্পগুলি আমাদের জীবনবাদী ভাবনাকে উসকে দিয়েছে
। অবয়ব ক্ষুদ্র, কিন্তু পাঠ-সুখের রেশ থেকে যাবে দীর্ঘ সময় ।
মেঘ অদিতি কৃত শোভন প্রচ্ছদে ‘কেতকী’ প্রকাশিত
সংকলনটি পাঠক সমাদর পাবে বলেই আমার বিশ্বাস । ৪৮ পৃষ্ঠার অনুগল্প
সংকলনটির দাম সত্তর টাকা ।