গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৮

নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

 অন্যপথ

মনোবিদ দাসগুপ্তের আজ এটাই শেষ রোগী। দরজা খুলে ঢুকলেন চল্লিশ শেষের দিকের এক মহিলা। চেনা মুখ। স্বাভাবিক সৌজন্যের হাসি দিয়ে বসতে বললেন  মনোবিদ দাসগুপ্ত।ভদ্র মহিলা কে চিনতে পারলেন, মেয়ের সহপাঠীর মা। ইনার ছেলেটির খাতা প্রায় তাঁর আদুরে মেয়ের লাগতো। বার কয়েক পাশের আবাসনে মেয়ে কে নিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে।সাধারন মধ্যবিত্ত পরিবার। চা খেতে হয়েছে একবার। গায়ে পড়া অতিথি পরায়ণ একটু মফস্বলের আচরণ। ভদ্রমহিলা কে অত্যন্ত স্বাভাবিক একজন মানুষ বলেই তো তাঁর মনে হয়েছে।
“ আরে আপনি ...নাম লিখিয়ে আসার কি দরকার... কার সমস্যা?” মনোবিদ দাসগুপ্ত মানবিক হবার চেষ্টা করলেন। খুব অস্বস্তি নিয়ে ভদ্র মহিলা বললেন , “ আমার ... মানে ঠিক আর কাউকে  চিনি না তো... আপনাকে একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে”। 
-“ কি সমস্যা ...বলুন”।
- “ আমি ডিপ্রেশনের রুগি এইটা একটু একটা প্রেস্‌কিপসানে লিখে দিন না...মানে লিখুন খুব মানসিক ভাবে অবসাদ গ্রস্থ ... এই ভাবে”। 
-“ কি অসুবিধা হচ্ছে বলুন।... ঘুম হচ্ছে না...মন খারাপ থাকছে?”
- “আসলে প্রেস্‌কিপসানে ওটা লিখে দিন আমি ডিপ্রেশনের রুগি।ওটাই চাইছি। তাহলেই হয়ে যাবে।”
- হ্যা লিখে দেবো কিন্তু কি কি অসুবিধা সেটা বলুন? আমি সাহায্য করতে পারবো
- “ আমার কোন অসুবিধা নেই। ”
- “তাহলে প্রেস্‌কিপসানে আমি লিখবো কেন? আর সাথে কাউকে আনেন নি কেন? আমি অকারণে এভাবে লিখতে পারি না।”পেশাদার দাসগুপ্ত বিনীত অথচ পরিষ্কার ভাবে বল্লেন।
- “ আমার অবস্থা টা বোঝাতে পারছি না। মানে আমাকে অন্য কারোর কাছে যেতে হবে তাহলে...”।“আপনার কি সমস্যা একটু খুলে বলুন”একটু দৃঢ়তার সাথে বলেন মনোবিদ দাসগুপ্ত।
-“ আসলে আমি সংসার ছেড়ে চলে যেতে চাইছি। আমি এবার সত্যি আর এভাবে বাঁচতে চাইছি না।”
মনোবিদ দাসগুপ্ত এবার ধরলেন,অসুস্থ দাম্পত্য। “ হ্যা বলুন কি কি সমস্যা। আপনার স্বামীর সাথে কবে থেকে, ?”
-“ আমার স্বামী খুব সোজা মানুষ জানেন। খুব ভালো। সেই জন্যেই চাইছি। আমি চলে গেলে যাতে কোন সমস্যার মধ্যে না পড়েন। লোকজন যেন তাঁকে কিছু না বলেন।”
মনোবিদ দাসগুপ্ত অবাক হলেন ভদ্রমহিলার কথায় একটু অবাক হলেন। “  আপনার ছেলে এ বছর চাকরি পেল তো...কোথায় যেন আছে? আপনি কোথায়  যাবেন?”
“ আমাকে তো সংসারে আর দরকার নেই। আমি চলে যাবো।”
“মানে ছেলে স্বামী এদের কে আপনি তো ভালবাসেন আপনি যাবেন কেন?আর দরকার নেই এই কথা ভাবছেন কেন।?”
খুব সোজা চোখে তাকালেন রোগিণী। একটু বেশী ঋজু শিরদাঁড়ায়।
“ আমাকে মা খুব যত্ন করে গান শিখিয়ে ছিলেন জানেন।কষ্টের সংসারে গান শেখানো।ঐ গান দেখেই আমার বিয়ের ঠিক হয় । কিন্তু বিয়ে হবার পর আমি কেবল সংসার করেছি। রান্না, ঘরের অন্যকাজ, শ্বশুর  -শ্বাশুরী ,অতিথি আপ্যায়ন, ছেলে মানুষ করা যা একজন বাড়ির বউ কে করতে হয়।”ভদ্রমহিলা  চুপ করলেন সামনের গ্লাস থেকে জল খেলেন। “ জানেন সব্বাই কেমন যেন ভুলে গেল যে আমি গান করতাম। চারমাস আগের ঘটনা জানেন ডঃ দাসগুপ্ত , বাড়িতে এলেন পণ্ডিত ধীমান সেন। উনি কি করে জানলেন আমি গান জানি। আমাকে রান্না ঘর থেকে ডেকে পাঠালেন। আমি তো লজ্জায় এক শেষ। হাতের হলুদ ভালো করে ধুয়ে আসিনি।সাথে উনার এক অল্প বয়সী ছাত্রী। সে কি সমস্যা। উনি  মুলতানি  গাইতে শুরু করলেন। আমার ঐ বন্ধিস টি জানা। আমি চারপাশ ভুলে গিয়ে গেয়ে ফেললাম। বাড়ির সব্বাই একটু অবাক । উনি হারমোনিয়ামের বেলো লক্‌ করে অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন। কোথায় শিখেছি কত দিন শিখেছি। আমাকে বল্লেন আমি আমি ভীমপলশ্রী জানি কিনা। আমি কেমন লজ্জাহীন হয়ে গেয়ে দিলাম।” ডঃ দাসগুপ্ত চুপ করে শুনছেন। মাথা নিচু করে ছিলেন ভদ্র মহিলা। এবার ডঃ এর দিকে তাকালেন। “ হ্যাঁ বলুন ।গান করলেন তারপর কি হল ”।“ ওটা ফোনে রেকর্ড করেছিল ভাগ্নের বাচ্চা ছেলে। সে ফেসবুকে দিয়ে দিল।তারপর সেটা আর বলার নয় ।প্রচুর মানুষ ভালো বল্ল...... ” । “ বাহ এতো দারুউউন ব্যাপার খুব আনন্দের।” বললেন ডঃ দাসগুপ্ত। হঠাৎ বড্ড ভারী এবং জটিল হয়ে উঠল রোগিণীর চোখ। নীচের ঠোঁটে ফুঁসে উঠছে তীব্র আবেগ।“ আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ জানেন খুব নাম। সব্বাই বলে উনার দয়ার হৃদয়।জানেন...” আর বলতে পারছেন না রোগিণী। শব্দ হীন হয়ে থাকলো সংলাপ।ডঃ দাসগুপ্ত শান্ত হয়ে অপেক্ষা করলেন। “ আমার গান নিয়ে উনি কিছু বললেন না। আমি ভাবলাম উনি এই বয়সে জানাতে লজ্জা পাচ্ছেন।এক সপ্তাহ আগে বাড়িতে সব্বাই এসেছে।আমার বাপের বাড়ির কেউ তো নেই।  আমি এটাকেই তো বাড়ি মনে করি।কিন্তু......” এবার চোখ দিয়ে জল বার হয়ে এলো।“ জানেন সব্বাই আমার গান নিয়ে ঠাট্টা করছিল। আমি জানতাম এটাই হবে। প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু উনি হঠাৎ বাজে মুখ ভঙ্গি করে বললেন যে , উহ কি বাইজীদের মতো গান। অসহ্য।”
ডঃ দাসগুপ্ত বললেন, “কিন্তু আপনি ওদের জানান যে এটা আপনার খারাপ লেগেছে। তাই না।এতো দিনের ঘর,আপনার তৈরি করা সংসার।”
“আপনি লিখে দিন না আমার অবসাদ আছে। একটু সাহায্য করুন। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। হরিদ্বারে  গঙ্গামার আশ্রমে আমার এক চেনা মানুষ আছেন।ওখানে গান করার সুযোগ ও আছে।ওদের সাথে কথা বলা আছে আমার। আমি গয়নাগাঁটি কিছু নেব না। চুপচাপ চলে যাব। বয়স হয়েছে আর তো অন্য কিছু ভয় নেই। আমি গান করবো আর নিজের জন্যে বাঁচবো। প্রেস্কিপ্সানে  লেখা থাকবে আমি অবসাদগ্রস্থ ।ওটা সামনে রেখে যাব।ওরা কিছু দিন খুঁজবে। তারপর ভাববে পাগল হয়ে হারিয়ে গেছে। দিন না লিখে ডাক্তার বাবু”।