গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৮

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

    গৌর সামন্ত

    কার কথা দিয়ে গল্পটা এগুবে বা এগুনো উচিত তা আমি নিজেই জানিনা । সত্তর বছরের পঙ্গু বৃদ্ধ গৌর সামন্ত, আঠেরো বছর আগে মারা যাওয়া সুনন্দা বৌদি কিংবা পয়তাল্লিশ বছর আগে চাইবাসা জেলে পুলিশের গুলিতে খুণ হওয়া বিনয় মুখার্জী যে কারো কথা দিয়েই গল্পটা শুরু হতে পারতো । বিনয় মুখার্জী জেলখানার ভেতরে পুলিশ গুলিতে নিহত হয়েছিল না পিটিয়ে মেরেছিল সেটাও সঠিক জানা যায় না । সেটা আমার জন্মের বছর চারেক আগের ব্যাপার । পরে পাড়ার রাস্তার মোড়ে একটা শহিদ বেদী হয়েছিল, সাদা পাথরে কালো অক্ষরে মৃত্যু তারিখ দিয়ে লেখা ছিল শহিদ বিনয় মুখার্জী এখন আর বেদিটা দেখতে পাই না । ইটগুলো কারো পাঁচিল তৈরীর কাজে লেগে গেছে মনে হয়সুনন্দা বৌদিকেও আমি দেখিনি, ছেলে চারুর বছর চারেক বয়সে গৌরদাকে একা রেখে মারা যান । তখন বারো বছর বয়সী আমার পক্ষে সেই সব বৃত্তান্ত জানার কথা নয়জেনেছি অনেক পরে, গৌরদার কাছে শুনে  ।

    গৌর সামন্ত মানুষটা আমাকে টানতো । কেন টানতো তা আমি বলতে পারবো না শুধু যে ওর চায়ের ঠেকে প্রায় রোজই কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসতাম সে জন্য নয়, অনেকেই তো যায় । অথচ আকর্ষণ করার মত কিছুই ছিল না গৌরদার । কিন্তু ওর চোখে একটা স্বপ্ন ছিল । বলতো, দেখবি মানুষের সব দুঃখ কষ্ট শেষ হবেই একদিন । ঠাট্টা করতাম, হ্যাঁ তোমার দোকান তিন তারা হবে, তখন কি আর আমরা ভাঁড়ের চা খাবো ? ছেলের পড়াশোনা কেমন হচ্ছে জিজ্ঞাসা করলে গৌরদার চোখটা চিকচিক করে উঠতো । ছেলেটা এ বছর উচ্চমাধ্যমিক দেবে । গৌরদা বলেছিল, চারুকে আমি আনতে চাইনি । সুনন্দাকেও বলেছিলাম । সুনন্দা বলেছিল যে আসবে সেও তো আমাদের স্বপ্নটাকেই বয়ে নিয়ে যাবে ।

    গৌরদা আমাকে টানতো । বেঁচে থাকার জন্য কীই না করেছে গৌর দা । দশ বারো বছর বয়সে বাবা, মা দুজনেই মারা যাবার পরে নিজের চেষ্টায় একটা লেদ কারখানায় কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল, কারখানাটা বন্ধ হয়ে যেতে বাস হেল্পারের কাজে ঢুকে পড়েছিল । একদিন ভীড় বাসে যাত্রী তোলার পর নিজেই চলন্ত বাসের পাদানি থেকে পড়ে গিয়ে পাটা খোয়ালো, েল্পারের কাজটাও । ততদিনে সুনন্দা বৌদি চলে এসেছে তার জীবনে, ছেলে চারু তখন বছর তিনেকের । বাস ডিপোর ড্রাইভার কনডাকটররা কিছু চাঁদা তুলে দিয়েছিল গৌরদার হাতে আর ডিপোর কাছে একটা ছাউনির ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল । সুনন্দা বৌদির টিউসানির জমানো কিছু টাকা নিয়ে একটা ছোট চায়ের দোকান দিল গৌর দা । এইসব বৃত্তান্ত গৌরদার মুখ থেকেই শোনা । গৌর দা আমাকে টানতো । সেই টানেই প্রায় রোজই অফিস থেকে ফেরার পথে বাড়ি না গিয়ে বাস থেকে নেমেই গৌরদার দোকানে ঠেক মারতাম । ঐ সময় দোকানে বসে আড্ডা মারার ভীড় থাকতো না।

    গৌরদার দোকানে একটা ছবি টাঙানো থাকতো । একটি কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে আর তার সমবয়সী এক তরুণী । একদিন ছবিটাতে ফুলের মালা দিয়েছে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এরা কারা গৌর দা ? য়েক মিনিট ছবিটার দিকে চেয়ে রইলো, দেখলাম চোখে জল চিকচিক করছে । নিজেকে সামলে নিয়ে গৌর দা বললো, ওরা হল বিনয় মুখার্জী মানে বিনয় দা আর সুনন্দা, চারুর মা । ওদের একসঙ্গে কলেজে পড়ার সময় তুলেছিল, নন্দার কাছে ছিল । নন্দা তখন সবে বিএ পাশ করেছে, ঐ যে তোরা অনার্স না কি বলিস তাই নিয়ে । আজ বিনয়দার মৃত্যুদিন, তাই মালা দিয়েছি । আমার মুখ দিয়ে কথা সরলো না কিছুক্ষণ । এই বিনয় মুখার্জী ? পয়তাল্লিশ বছর আগে রাষ্ট্র বুলেটবিদ্ধ করে হত্যা করেছিল এই উজ্বল তরুণটিকে ! কিন্তু আমার বিস্ময় অন্য যায়গায় । পয়তাল্লিশ বছর আগে মৃত বিনয় মুখার্জীর সঙ্গে গৌরদার ঘরনী সুনন্দা বৌদির ছবি কেন ? আর কি করেই বা সে লেদ কারখানার ছাঁটাই হওয়া দৈনিক রোজের মজুর থেকে বাস হেল্পার হওয়া গৌর সামন্তর জীবনসঙ্গিনী হয়ে গেল ! বলেছিলাম বৌদির কথা বল না গৌরদা । গৌরদা বলেছিল সেসব পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা শুনে কি করবি । গৌরদা বলেছিল বিনয় মুখার্জী আর নন্দা বৌদির কথা । সে তো আমার জন্মেরও আগেকার কথা । তাই হুবহু গৌরদার বয়ানেই বলি ।

চাইবাসা সেন্ট্রাল জেল থেকে টেলিগ্রামটা এসেছিল, ‘লেখা ছিল গতকাল রাত্রে  জেলে পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে মৃত্যু হয়েছে বিনয় মুখার্জীরবিনয়দার মা পাথরের মত স্থির এক চিলতে ঘরের তক্তাপোষে আর সুনন্দা তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে । আমরা কজন সুনন্দাকে সামলাবার চেষ্টা করছি । বিনয়দার মা বলেছিলেন ওকে কাঁদতে দে গৌর, এই ঘরে আমার কাছেই তো সুনন্দার আসার কথা ছিল এক সময় নন্দাদির কান্না থামলে মা বললেন আমার মনটা তো তৈরিই ছিল, কিন্তু নন্দা কোথায় যাবে এখন ? তোরা বিনয়ের স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখবি না গৌর ? পুলিশের নজরবন্দী বিনয়দার বাড়িতে তখন কোন শোকসভা করা যায় নি কোন শ্রাদ্ধের আয়োজনও হয়নি । আমি প্রায় রোজই যেতাম বিনয়দার মার কাছে । রোজই দেখতাম নন্দাদি বিনয়দার মাকে জড়িয়ে কেমন নিশ্চল পাথরের মত বসে আছে । একদিন বিনয়দার মা ডাকলেন, গৌর কাছে আয় । বললেন বিনয়ের স্বপ্নটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়টা তোকে নিতে হবে গৌর । বিনয়কে ঘিরে নন্দার স্বপ্নটাকে শেষ হতে দিস না গৌর । আমি নিজে নন্দাকে তোর হাতে তুলে দেবো । বিনয়দার মায়ের এই ডাক আমি ফেলতে পারিনি, নন্দাও পারেনি গৌরদা থামলো । আমিও সেদিন আর কোন কথা বলতে পারিনি, বলা সম্ভবও ছিল না ।

    গৌরদার গল্পটা শুনেছিলাম বছর পাঁচেক আগে । তারপর বাস টার্মিনাসের কাছে গৌরদার চায়ের দোকানটাও বন্ধ হয়ে গেল জেনেছিলাম গৌরদা অসুস্থ্ আর দোকান চালাতে পারছে না । তারপর আজ অফিস থেকে ফেরার পথে গৌরদার চায়ের দোকানের সামনে ভিড় দেখে দাঁড়ালামকে একজন বললো কিছুক্ষণ আগে গৌর সামন্ত মারা গেছে । ওরা গৌরদার শেষকৃত্যের জন্য চাঁদা তুলছে । একজন শেষকৃত্যের জিনিস নিয়ে এলো, গৌরদার দেহ নিয়ে ওরা শ্মশানে যাবে এবার ।  বাড়িতে ফোন করে জানালাম আমার ফিরতে একটু দেরি হবে । ওদের বললাম চলো, আমিও যাবো তোমাদের সঙ্গে গৌরদাকে শেষ দেখাটা দেখে আসি । গেলাম ।


    গৌরদার ছেলে চারু এক কোণে নিষ্পলক দাড়িয়েছিল । ওকে কাঁদতে দেখলাম না । কোথায় যাবে, কি করবে চারু এরপর ? গৌরদা আর সুনন্দা বৌদির স্বপ্নটাকে বয়ে বেড়াবার দায় যে তার ! কত দূর যাবে চারু ? আমার কাছে  এই জিজ্ঞাসার কোন উত্তর ছিল না !