গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৭

অসিত বরণ চট্টোপাধ্যায়

অস্তরাগ

তখনও সূর্য অস্ত যায় নাই। পাটে বসিতে বেশ কয়েকদন্ড বাকী। নির্মল আকাশ। পথিপার্শ্বে দুই দিকে হৈমন্তী স্বর্ণাভ ধান্য উত্তুরে হাওয়ায় মাথা দুলাইতেছে। গো শকট দুল্কিচালে চলিতেছে কুসুমপুর অভিমুখে। শকট অভ্যন্তরে একাকী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মহিলা।
তিনি নিরুপমা। কুসুমপুরের ডাকাসাইটে জমিদার বিজয়প্রতাপের স্ত্রী। পলাশডাঙার অত্যন্ত সাধারণ পরিবারের কন্যা। আজ প্রায় ত্রিশ বৎসর কাল পরে তিনি শ্বশুরালয় অভিমুখে রওয়ানা হইয়াছেন। আভূষণ বলিতে হাতে দুইটা সোনার চুড়ি আর শাঁখাপলা, গলায় অত্যন্ত সরু সুত,কানে মামুলি দুইটি কানপাশা। পরণে চওড়া লাল পাড় সাদা শাড়ী,আর রক্তরঙা ব্লাউজ। নরম রৌদ্র তাঁহার সর্বাঙ্গ ঠিকরাইয়া পড়িতেছে। মাঝে মাঝে স্বর্ণাঙ্গী বলিয়া ভ্রম হয়। তাঁহার চক্ষু মুখমন্ডলের দীপ্তি ব্যক্তিত্বময়ী  করিয়া তুলিয়াছে।সঙ্গী বলিতে গোশকটের গাড়োয়ান গোপীনাথ। গোধুলির নির্মল আকাশ।
পথিমধ্যে শিমুলতলা। সেইখানে মহাকাল মন্দির। গোপীনাথকে বলিয়া দিয়াছেন সন্ধ্যারতির সময় নাগাদ ওখানে পৌঁছাইতে হইবে। কিন্তু গোল বাধাইয়াছে গোশকট। শত পাঁচনের বাড়ি খাইয়াও তাহার গতির পরিবর্তন হইতেছে না। গাড়ীর চাকার অবিরাম ক্যাঁচোর ক্যাঁচোর শব্দে বিরক্ত উৎপাদিত হইলেও নির্জন রাস্তায় এই শব্দ একাকীত্বকে কিছুটা হইলেও ম্লান করিতেছে। মাঝে মধ্যেই গোপীনাথ শকটচক্রে ধাক্কা মারিয়া গতি বাড়াইবার চেষ্টা করিতেছে। গতি তাহাতে কতটা বাড়িতেছে তাহা গাড়োয়ান গোপীনাথই ভাল বুঝিতেছে। কেননা সময়ের সঙ্গে তাল রহিতেছে না। অবশেষে কুমারী সন্ধ্যা বিধবা রাত্রির সন্ধিক্ষনে গো-শকট গিয়া শিমুলতলার মহাকাল মন্দিরে উপস্থিত হইল। তৎক্ষনে মন্দিরে সন্ধ্যারতি সমাপ্ত হইয়াছে। পুরোহিত আপন কর্ম সমাধান করিয়া অনেক আগেই গৃহাভিমুখে রওয়ানা দিয়াছেন। নির্জন মন্দির মধ্যস্থ গর্ভগৃহে মহাকালের পদতলে একটিমাত্র প্রদীপ টিম টিম করিয়া জ্বলিতেছে। চারিদিকে অন্ধকার। প্রদীপের মোম আলোয় মহাকাল মুর্তি  দর্শণ করিয়াই ক্ষান্ত হইলেন। নিরুপমা কপাল চাপড়াইয়া নিজের ভাগ্যকে দোষারুপ করিতে লাগিলেন। সঠিক সময়ে উপস্থিত হইতে না পারার কারণে আক্ষেপ করিতে লাগিলেন। এই ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে গা ছমছম করিতে লাগিল। কিন্তু অদুরে মন্দির প্রাঙ্গন বাহিরে একজন পুরুষ সঙ্গী থাকার কারণে কিছুটা সাহস সঞ্চার করিয়া মুল মন্দির তিনবার প্রদক্ষিণ করিয়া মহাকালের উদ্দ্যেশে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম  করিতে না করিতেই এক নবজাতকের চিঁ চিঁ ক্রন্দন শুনিতে পাইয়া সবেগে উঠিয়া পড়িলেন। যেটুকু সাহস ছিল তাহাও নিঃশেষ হইল। ভাবিতে লাগিলেন এই অন্ধকার নির্জন মন্দিরপ্রাঙ্গনের কোথা হইতে শিশুর ক্রন্দন ভাসিয়া আসিতেছে। অন্ধকারে কিছুই ঠাহর করিতে পারিলেন না। অবশেষে মন্দির হইতেই গোপীনাথকে ডাকিলেন। ডাকিয়া কহিলেন,
তোমার কাছে নিশ্চয়ই দেশলাই আছে,তা আমাকে দাও।
গোপীনাথ কহিল,
-
মা ঠাকরুণ, আমি নিচু জাতি, আমার মন্দিরে উঠিবার অধিকার নাই তা ছাড়াও আমার কাছে দেশলাইও নাই।
-
ঠিক আছে তুমি মন্দির প্রাঙ্গণে দাঁড়াও,দেখি আমি কি করতে পারি।
এই বলিয়া নিরুপমা মন্দিরের দরজার কাছে গিয়া উবু হইয়া বসিলেন।

দরজায় চাবি দেওয়া ছিল ঠিকই কিন্তু লোহার শিক দিয়া নির্মিত দরজার ফাঁকে হাত গলাইয়া প্রদীপ বাহির করা যাইতেও পারে ভাবিয়া নিরুপমা হাত গলাইল। বহু চেষ্টা করিয়া প্রদীপের নাগাল পাইবামাত্র তৎক্ষণাৎ  আবারও শিশুর চিঁ চিঁ কান্নার আওয়াজ পাইয়া শিহরিয়া উঠিলেন। অতি সন্তর্পনে প্রদীপ বাহির করিয়া বাম হাতটি শিখা আড়াল করিয়া মৃদু আলোয় শিশুর কান্না ঠাহর করিয়া খুঁজিতে লাগিলেন। প্রায় দুইদন্ড খোঁজার পর দেখিলেন মন্দিরের দুইটি খিলানের মধ্যবর্তী স্থানে কিছু কাপড়ে মোড়া একটি নবজাতক কে বা কাহারা রাখিয়া গিয়াছে। পরমযত্নে নিরুপমা শিশুটিকে ক্রোড়ে তুলিয়া লইলেন। প্রদীপ শিখার তাপ লইয়া শিশুটির অনাবৃত মুখে কপালে দিলেন। স্বগতোক্তি করিলেন,"কে সেই পাতকিনী এই চাঁদপানা শিশুপুত্রকে এই হিমেল পরিবেশে রেখে পালিয়েছে?"
নিঃসন্তান নিরুপমার হৃদয় মাতৃস্নেহে উথলিয়া উঠিল। পরম আদরে নবজাতককে ক্রোড়ে তুলিয়া পুনরায় গোশকটে যাত্রী হইলেন। গাড়োয়ান গোপীনাথ কহিল,

-
মা ঠাকরুণ, এটা কি পেলেন।
-
গোপী, আজ থেকে আমি বাবা মহাকালের দয়ায় মা হলুম রে।
-
তাই মা ঠাকরুণ?
-
জানিস গোপী, আমার তখন বয়স তেরো কি চৌদ্দ সেই সময় আমাদের বাড়িতে এক জ্যোতিষী এসেছিলেন।বাবা ওঁর কাছে আমার হাত আর ঠিকুজি দেখিয়েছিলেন। তা জ্যোতিষী কি বলেছিলেন জানিস গোপী?
-
কি?
-
মেয়ে শনি যুক্ত মঙ্গলের জাতিকা। ভৌমদোষযুক্তা। বিশাল বাড়ীতে ওর বিয়ে হবে, কিন্তু স্বামীসঙ্গ ঠিকমত হবে না। তবে ওর সন্তান রাজ তিলকযুক্ত হবে। সসাগরা নাম হবে ওর সন্তানের। পুত্রগরবিনী মায়ের নাম ছড়িয়ে পড়বে দেশ বিদেশে।
একনাগাড়ে নিরুপমা বলিয়া চলিলেন। 

-
দেখ গোপী তুই তো আমার সব জানিস। কুসুমপুরে জমিদার বাড়িতেই বিয়ে হয়েছে আমার। কিন্তু স্বামীসঙ্গ পাইনি। আজ এতদিন পর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি মৃতপ্রায় স্বামীকে দেখতে তাও কিনা দেবদত্ত শিশুকে নিয়ে। জ্যোতিষীর অভ্রান্ত গননা, কি বলিস?
গুরুগম্ভীর কথার মানে কি বুঝিয়াছিল তাহা গোপীনাথই জানে, প্রত্যুত্তরে সে "হুম" কহিল।
রাত্রি একপ্রহর অতিক্রান্ত হইল। চারিদিক হইতে শিবাকুলের হুক্কা হুয়া চিৎকারধ্বনিতে তখন আকাশ বাতাস তোলপাড়। ঝিঁঝিঁরাও ভয়ে মাঝে মাঝে গান থামাইয়া দিতেছে। গোশকট রায় পরিবারের বিশাল সিংহদরজার সামনে হাজির হইল।
দুই তালপাতার সেপাই দরজা খুলিয়া দিল। রায় পরিবারে বৈভবের সূর্য অস্ত গেলে কি হইবে,আড়ম্বর ষোলআনা বজায় আছে।
নিরুপমা সযত্নে শিশু ক্রোড়ে লইয়া গৃহাভ্যন্তর উদ্দ্যেশে যাত্রা করিবামাত্র দাসীগন জলধারা দিতে লাগিল। তাহা অনুসরণ করিয়া নিরুপমা গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন।
বিজয় প্রতাপ রায়। একদা কুসুমপুরের বিরাশী মৌজার জমিদার। জমিদারী প্রথা বিলোপের পর কুসুমপুরের পঁচাত্তর বিঘা জমির মালিকানা পান। চারিত্রিক দোষ আর বেহিসাবি খরচের ধাক্কায় এক্ষনে তাহা কয়েক বিঘায় পরিনত হইয়াছে। একসময় পিতা অমর প্রতাপ রায় তাঁহার বিশাল জমি রক্ষা করিয়াছিলেন বৃটিশের বদান্যতায়। রায়বাহাদুর খেতাবও পাইয়াছিলেন। দিনবদলের পালায় সবকিছুই ওলট পালট হইয়া গিয়াছে। পুত্রকে সংসারী করিবার উদ্দ্যেশে বিবাহ দিয়াছিলেন পলাশবনীর জমিদার কন্যা অনিন্দসুন্দরীর সঙ্গে। সন্তানাদি হওয়ার আগেই বিজয় প্রতাপের অত্যাচারে তিনি গলায় দড়ির ফাঁস লইয়া ইহলোক ত্যাগ করেন। দ্বিতীয় বিবাহ হয় তাহার কয়েক বৎসর পর ধনুকতোড়ের জমিদার কন্যা চারুবালার সাথে। সেই বিবাহ বেশীদিন স্থায়ী হয় নাই। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়া শিশুকন্যার গলা নাড়ীর ফাঁসে জড়াইয়া উভয়েরই জীবনদীপ নির্বাপিত হয়। অতঃপর অমর প্রতাপ বংশ রক্ষার তাগিদে পলাশডাঙ্গার নিম্নবিত্ত পরিবারের কন্যা নিরুপমার সহিত বিবাহ দিয়া পরম নিশ্চিন্তে কয়েকমাস পরেই স্বর্গবাস করেন।
নিরুপমা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে মানুষ হইলেও লেখাপড়া করিয়া ম্যাট্রিক পাস করিয়াছিলেন।  তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্না, মানবিক এবং দয়ালু ছিলেন। দেবদ্বিজে ভক্তি ছিল প্রগাঢ়। দাসদাসীদের সহিত সম্পর্ক ছিল অতীব মধুর। কিন্তু ফুলশয্যার প্রথম রাত্রিতেই জানিতে পারেন তাঁহার স্বামী যৌন রোগাক্রান্ত। তাই নিরুপমা সহবাসে অপারগতা প্রকাশ করেন। এতদকারণে বিজয় প্রতাপ নিরুপমাকে শারীরিক অত্যাচার শুরু করেন। তিনমাস অতিক্রান্ত হইতে না হইতেই রায়বাড়ী হইতে নিরুপমা বহিস্কৃত হন। সেই হইতেই তিনি পলাশডাঙ্গার পিতৃগৃহে থাকিয়া সমাজসেবামুলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখিয়াছিলেন।  সম্ভবত বিধাতার ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। যে গৃহ হইতে নির্বাসিত হইয়াছিলেন সেই গৃহের মৃতপ্রায় গৃহস্বামীর কাতর অনুরোধ প্রত্যাখান করিতে পারেন নাই তাহার বড় কারণ রোগাক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী গৃহস্বামী তাঁহার অগ্নিসাক্ষী করা স্বামীও বটে। অতএব একজন নিষ্ঠাবতী হিন্দু রমনীর পক্ষে স্বামীর শেষসময়ের ডাক প্রত্যাখান করা প্রায় অসম্ভব।
কিয়ৎক্ষন বিশ্রাম লইয়া হস্তপদ প্রক্ষালন করতঃ শাড়ীজামা পরিবর্তন  করিয়া শিশুপুত্রকে পুঁটুলির মত ক্রোড়ে লইলেন এবং বিজয় প্রতাপ সন্দর্শনে তাঁহার গৃহাভ্যন্তর কক্ষে প্রবেশ করিলেন।

কটুগন্ধময় কক্ষে প্রবেশ করিয়া তাঁহার নয়ন বিস্ফারিত হইল। কোথা সেই বিজয় প্রতাপের প্রতাপান্বিত চেহারা। মুখমন্ডল চুপসাইয়া গিয়াছে, উর্ধাঙ্গ কঙ্কালসার, বক্ষপঞ্জর দৃশ্যমান।
আবৃত গোপনাঙ্গে খুব সম্ভবত পচন ধরিয়া দুর্গন্ধ ছড়াইতেছে, অনাবৃত সরু দুই পা মাঝে মধ্যেই কাঁপিয়া উঠিতেছে। একমাত্র পুরুষ্ট পক্ক গোঁফজোড়া সাক্ষ্য বহন করিতেছে তিনি একদা জমিদার ছিলেন। ঝাপসা চক্ষে খুব সম্ভবত ঠাহর করিলেন নিরুপমা আসিয়াছেন। ক্ষীনকন্ঠে কহিলেন,
-
কে নিরুপমা? আমি জানতাম তুমি আসবে। এও জানতাম তুমি আমায় ক্ষমা করে দেবে। নিরু আমি নুতন করে বাঁচতে চাই।
নিরুপমা নিশ্চুপ। অবাক বিস্ময়ে স্বামীর কাতরোক্তি শুনিতে লাগিলেন।
-
নিরু তুমি আমায় ক্ষমা করেছ তো?
এবারও নিরুপমা নিশ্চুপ রহিলেন।
নিজের অজান্তেই কপোল বাহিয়া কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়াইয়া পড়িল।
-
নিরু কথা কইছো না কেন? তোমার কোলে পুঁটুলি  কিসের?
মুহুর্তে শিশুপুত্র চিঁ চিঁ করিয়া উঠিল।
খুব সম্ভবত ক্ষুধার তাড়নায়। দীর্ঘসময় মাতৃস্তন্য পায় নাই,তাহারই ফলশ্রুতি। এইবার নিরুপমা নির্বাক রহিতে পারিলেন না। বলিলেন -
-
আপনি তো অনেক আগেই আমাকে খবর করতে পারতেন।এ কি শরীর হয়েছে আপনার?
-
নিরু ঘর থেকে যাকে নির্মম ভাবে বিতাড়িত করেছি তাকে কোন অধিকারে আমার দুঃসময়ে ফিরে ডাকবো? বা ফিরে আসতে বলবো?
-
কেন স্বামীর অধিকারে।
-
আজ আমি আমার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করছি নিরু। বলতে দ্বিধা নেই আমি অনেক মেয়ের  সর্বনাশ করেছি। অনেক অন্যায় অত্যাচার করেছি তার ফল তো আমায় ভুগতেই হবে। কিন্তু আমার আরেকটি প্রশ্নের উত্তর তো দিলে না।
-
কি?
-
পুটুলির মধ্যে কি?
-
পুঁটুলির মধ্যে তোমার আমার সন্তান। মহাকাল প্রদত্ত সন্তান। নাম ওর 'তমোঘ্ন'
-
কিছু বুঝলাম না।
-
আসার পথে মহাকাল মন্দিরে এই পরিত্যক্ত শিশুকে কুড়িয়ে পেলাম গো। আহা বেচারা। বেচারার জন্ম বড়জোর এক কি দুইদিন। মন মানল না তাই নিয়ে এলাম। একদিন তো বংশরক্ষার জন্য ঘরময় চিৎকৃত হতো। তাই হয়তো ঠাকুর আমাদের বাড়ীতে বংশধর পাঠিয়েছেন। তোমার অমত নেই তো?
-
  না। ঠিক করেছ, তুমি ওর ভালকরে পরিচর্যা কোর। ওই আমাদের দেবদত্ত উত্তরসুরি।
নিরুপমার মন শান্ত হইল। ক্ষুধার্ত শিশুর খাবারের নিমিত্ত সকল দাসীদের ডাকিলেন। কে সদ্য মা হইয়াছে তাহার খোঁজ খবর লইলেন।
জানিতে পারিলেন ক্ষেমী নাম্নী ত্রিশ বর্ষীয়া এক দাসী তিনমাস আগে মা হইয়াছে। তাহাকে ডাকিয়া কহিলেন,
-
ক্ষেমী আজ থেকে তোকে আর বাড়ীর কাজ করতে হবে না। তোর ছেলে আর আমার ছেলেকে অন্ততপক্ষে ছমাস দুধ খাওয়াতে হবে। আমি একটা ঘর পরিস্কার করিয়ে দিচ্ছি, ওখানেই থাকবি। রাত্রে  তমোঘ্ন আমার কাছে থাকবে, দরকারে তোকে ডেকে পাঠাবো। আর স্নানঘরে যা, শীত পড়ছে,পুরো গা ধুতে হবে না স্তনগুলো ভাল করে ধুয়ে আয়, আমি পরিস্কার শাড়ী জামা দিচ্ছি, পরে নিস আর আমার বাছাকে একটু দুধ খাইয়ে দিস। বাছা আমার ভীষণ ক্ষিদেয় রয়েছে। আরেকটা কথা, তুই এখানে রাত্রিতে থাকবি সেটা তোর বাড়ীতে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। তাছাড়া তোর ছেলেটাকেও এনে দেওয়ার কথা বলছি।
ক্ষেমী এককথায় রাজী হইয়া গেল।
পরদিন সকালে রায়বাড়িতে নুতন সুর্য উঠিল। নিরুপমা সকল দাসদাসীদের আপন কার্য ভাগ করিয়া দিলেন। স্বামীর পরিচর্যার ভার নিজ হস্তে গ্রহন করিলেন। 
প্রথমেই স্বামীর দুর্গন্ধময় কক্ষ পরিস্কার করিয়া তাহাতে সুগন্ধী ছড়াইলেন। স্বামীর ক্ষতস্থান নিজ হস্তে পরিস্কার করিয়া স্নান করাইয়া নবশয্যায় স্থানান্তর করিলেন। এবং একজনকে সদরে পাঠাইলেন একজন ভাল চিকিৎসক আনয়নের জন্য। এতদিন কবিরাজী চলিয়াছে এক্ষনে শহরের শিক্ষিত এলাপাথি চিকিৎসক সেবিকা না হইলেই নহে।
বিজয় প্রতাপ দেখিলেন একটি সকালেই লক্ষীর হস্তস্পর্শে কি অসম্ভব  দ্রুতলয়ে সংসারের চাকা ঘুরিতে লাগিয়াছে। অন্যদিকে ক্ষেমীর হাতে তমোঘ্নকে দুধ খাওয়াবার ভারাভার দিলেও শিশুপরিচর্যার অন্যান্য ব্যাপারস্যাপারগুলি নিজ হস্তে রাখিয়াছেন।
পরদিন সদর শহর হইতে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক সেবিকা আসিল। চিকিৎসক নানারুপ পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন। বুঝিলেন কঠিন যৌনরোগাক্রান্ত বিজয়প্রতাপের আয়ু প্রায় শেষের দিকে। সত্বর সদরে স্থানান্তর করিয়া প্রথমেই শল্যচিকিৎসার দ্বারা দুইটি অন্ডকোষ বাদ দিতে হইবে। তাহার পর দীর্ঘদিন পেনিসিলিন জাতীয় ঔষধ প্রয়োগ করিলে হয়ত বা পরমায়ু কিছুটা হইলেও দীর্ঘায়িত হইতে পারে। তবে সময় ভীষণ কম।
সেবিকা ক্ষতস্থান পরিস্কার করিয়া ব্যান্ডেজ বাঁধিয়া দিলেন। চিকিৎসক কিছু ঔষধ লিখিয়া সদরে স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়া বিদায় লইলেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সবকিছু হইল।সাতদিন পর হাসপাতাল হইতে ছাড়া পাইয়া নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন। নিরুপমার  নিরবিচ্ছিন্ন সেবায় বিজয় প্রতাপ ধীরে ধীরে সুস্থ হইয়া উঠিলেন। রায় বাড়ীর চেহারা আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হইতে লাগিল। ছয়মাস অতিক্রান্ত  হইল। অপরপার্শে তিল তিল করিয়া তমোঘ্ন হামাগুড়ি দিতে শিখিল। তমোঘ্নের হামাগুড়ি দেখিয়া বিজয় প্রতাপ যারপরনাই আনন্দে উদ্বেলিত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার জন্মের পর এই দীর্ঘসময়কালে এই গৃহে কোন শিশুর কলরব শোনা যায় নাই। আজ শিশুপুত্রকে দেখিয়া আনন্দে আত্মহারা হইয়া তাহাকে ক্রোড়ে তুলিয়া লইলেন। নিরুপমাকে ডাকিয়া কহিলেন

-
দেখো দেখো নিরুপমা আমাদের সন্তান কত বড় হয়ে গেছে। স্বয়ং ঈশ্বর আমাদের বাড়ীতে এই সন্তান প্রেরণ করেছেন। তোমার রাখা নাম সার্থক। তমোঘ্ন। আমার ঘর তো অন্ধকারই ছিল,সেই অন্ধকার ফুঁড়ে দেখো আলোর রোশনাই ভরে গেছে চারিদিক।
আনন্দের আতিশয্যে দুর্বল বিজয়প্রতাপ নিরুপমার ক্রোড়ে তমোঘ্নকে সমর্পন করিয়া শয্যা গ্রহণ করিলেন। সম্ভবত সুর্যের পাটে বসিবার সময় হইল।