সদ্য শেষ করা গান্ধর্ব উপন্যাসের নায়িকা অপালার কথা ভাবতে ভাবতে পথ
চলছিলাম। এর আগেও কয়েকবার বইটি পড়েছি। সুর পাগল গান্ধর্বের মেয়েটি আমাকে খুব
আকৃষ্ট করেছে বুঝতে পারলাম তখনই যখন প্রায় গায়ের ওপর উঠে পড়া রিকশা থেকে বাঁচতে
গিয়ে নতুন শাড়িটি ছিঁড়ে ফেললাম। আনকোরা ভাঁজভাঙা শাড়িটার জন্য মন ভারি হয়ে গেল।
শাড়ি ছিঁড়লে কার না মন খারাপ হয়! তার ওপর সদ্য কেনা পছন্দের শাড়ি। শাড়ির দুঃখ বুকে
চেপে পথ হাঁটছি আমি, অপালা মেহজাবিন। ব্যাংকে চাকরি। বাসা থেকে হাঁটা পথ। মাত্র
পাঁচমিনিট। খুব আস্তে হাঁটি, বাজারের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হয়, লাগে দশ মিনিট। সকালের
দিকে বাজারের ভীড় বেশি থাকে। দোকানির পসরা আর ক্রেতার ভীড় ঘিঞ্জি করে তোলে
বাজারটিকে। এখানে ওখানে নোংরা আবর্জনা আরও ঘিঞ্জি করেছে বাজারটিকে। হাঁটার
অনুপোযোগি তবুও হাঁটতে হয়। রিকশাতে গেলে হাঁটার থেকেও দেরি হয়; তাছাড়া রিকশাতে
গেলে সাজানো পসরার রূপ দেখা যায় না। বিক্রেতারা খুব সুন্দর করে সাজায় পসরা। এই
সুন্দর করে সাজানোটাও আকৃষ্ট করে ক্রেতাদের।
ভালো লাগে থরে থরে সাজানো সব্জি-পসরা দেখতে; এমন সুন্দর ডাঁই করে
আটা,মশলা,চাউল রাখে ওরা সেটা আমার কাছে একধরণের শিল্পকর্ম মনে হয়! চাউল আটা বিক্রি
হলে আবার সাজিয়ে রাখে, সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে সব্জি, সব্জি শুকিয়ে গেলে পানি
ছিটিয়ে দেয়। ওরা গুড় বিক্রি করে , সেখানে মাছি ভিনভিন করে; সেই মাছি তাড়ানোর জন্য
একটি কাঠির ডগায় ন্যাকড়ার ফালি জড়িয়ে রেখেছে, প্রয়োজনে তাই ব্যবহার করে মাছি তাড়ায়।
প্রতিদিন ওই পথ দিয়ে যখন যাই তখন কাউকে না কাউকে চাউল, আটা, সব্জি, মশলা কিনতে
দেখি; দেখতে দেখতে ভাবি সবাই- যারা এই সব খাবার কিনে নিচ্ছে তারা কী তাদের প্রয়োজন
অনুযায়ী খাবারের চাহিদা মিটিাতে পারছে, তাদের প্রতিদিনের ক্যালোরির চাহিদা কী পূরণ
হচ্ছে! কিংবা সবাই কি প্রতিদিন তাদের খাদ্য সামগ্রী কিনতে পারছে। পারছে না। যদি
পারতো তাহলে ডাস্টবিনে কুকুরের সঙ্গে, কাকের সঙ্গে মানুষের খাবার নিয়ে ভাগাভাগি
করতে হতো না। ভিক্ষে করতে হতো না মানুষকে!
‘অ, আপা মিন্তি লাগবো?’ পেছনে ছোট কণ্ঠ শুনে
ভাবনায় ছেদ পড়ে আমার। তাকিয়ে দেখি নয় দশ বছরের একটি ছেলে। হাতে একটি ঝাঁকা। খালি
গা, পরনে হাফ প্যান্ট। ওর দিকে তাকাতেই বলল, ‘আপা, কন কই যাইবেন, তিন টাকা দিয়েন।’
ওর কথার জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করি ‘তোর নাম কি?’ ছোট করে উত্তর দিলো, ‘আসলাম।’
‘তুই স্কুলে যাস না’ কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,‘না আপা। ইসকুলে গেলে
খামু কী? মা আর বোনরে খাওয়ামু কী?’ ওর মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘তোর বাবা
নাই।’ ওর চোখ ছলছল করে। বলে,‘বাপ আছে তয় কাছে লয় না। বাপে ... ও স্যার মিন্তি
লাগবো?’ আমার কথার জবাব না দিয়ে ছুট লাগালো অন্য এক ভদ্রলোকের কাছে।
আমার সঙ্গে গল্প করলে তো চলবে না ওর। কাজ করতে হবে। উপার্জন করতে হবে, না
হলে খাওয়া হবে না ওর আর ওর পরিবারের। একটি শিশু ওর ওপর একটি পরিবারের দায়িত্ব
চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ ওদের এখন হেসে খেলে বেড়ানোর বয়স! জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা
ব্যবস্থায় ‘খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা’ কর্মসূচি চালু হয়েছে। শিশু অধিকার সপ্তাহ,
বিশ্ব শিশু দিবস কতো রকম কিছু পালিত হচ্ছে। যাদের জন্য এত কিছু অথচ তারা যে তিমিরে
সেই তিমিরেই আছে! সুবিধা বঞ্চিত এই সব শিশুদের দরিদ্র পিতা-মাতা অন্যের বাড়িতে
কাজ, ইট ভাঙার কাজ, মিন্তির কাজ, চোরাচালানসহ নানারকম কাজে আগ্রহী কারণ এতে
উপার্জন বেশি। এতে ওদের তো কোন দোষ নেই। আগে খাওয়া তারপরে তো শিক্ষা। যে দেশের
অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বাস করে সেখানে আবার শিক্ষা! তবুও উদ্যোগ নিতে
হয়, নিচ্ছেও; সরকারি বেসরকারিভঅবে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
অফিসে পৌঁছুতে দেরি হয়ে গেছে। অফিসে প্যেঁছুতেই ম্যানেজার সাহেব ঘড়ি
দেখলেন, ‘কী ব্যাপার আপা?’ ‘একটু দেরি হয়ে গেল স্যার।’ ‘দেরি হলে কী করে চলে ভাই?
পনেরো মিনিট লেট।’ কথা বাড়ালাম না। সীটে এসে বসলাম। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জনা
ছয়েক মানুষ। বসতে না বসতে কাজ শুরু করতে হবে। এভাবে কাজ করতে ভালো লাগে না আমার।
আজ কার মুখ দেখে যে উঠেছিলাম। আমি প্রতিদিন উঠে আয়নায় নিজের মুখ দেখি, আজ দেখিনি।
মনের ক্ষোভ মিটাতে গুনগুন করি ‘ও মনে বাবলা পাতার কষ লাইগ্যাছে গুরু...’ কেন যে এই
কলি মনে এলো জানি না। হাসি পেলো। ওদিক থেকে তাগাদার পর তাগাদা আসছে। ‘আপা আমার
এফডিআর’, ‘আপা, একটা পে-অর্ডার করতে হবে’, ‘আপা, একটা টিটি করে দেন না, একটু তাড়া
আছে।’ চারদিকের কথায় মন তিক্ত হয়ে উঠলেও প্রকাশ করলাম না। তিক্তভাব গোপন করে বললাম
‘প্লিজ একটু দাঁড়ান, সবাইকে একে একে দিবো।’
সবাইকে বিদায় করতে প্রায়
ঘন্টাখানেক লাগলো। হাজিরা খাতা টেনে নিলাম। লাল কালি নেই! স্বাক্ষর করলাম। এমন সময়
জয়গুন এল, জয়গুন টাইপিস্ট। একটু তির্যক হেসে বলল, ‘দ্যাখছেন আপা, আপনার আগে আইসেও
লাল দাগ খাইছি কিন্তু...’ কথা শেষ না বিশ্রি রকমভাবে হেসে চলে গেল। মন খারাপ হয়ে
গেল, তার সঙ্গে রাগও হলো। একটা মেয়ে কখনও
আর একটা মেয়ের সাহায্যে এগিয়ে আসে না কেন? উল্টে বাগড়া দেয় কেন?ভাবতে ভাবতে কাজ
করতে লাগলাম।
দিনের শেষ। সারাদিনে কাজের ব্যস্ততায় কোন দিকে মন দিতে পারিনি। অফিসে চাপা
উত্তেজনা। ম্যানেজার সাহেবের রূমে বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। উত্তেজিতভাবে কথা বলছে
অ্যাকাউন্ট্যান্ট করিম খান। ‘কী ভাবে করলেন রফিক সাহেব। একটু দেখেশুনে কাজ করতে
হয়। এখন কোথা থেকে আনবেন এত টাকা!’ রফিক সাহেব নতুন মানুষ। তিনদিন হলো নওগাঁ থেকে
এসেছে। একটি হিসাবে আসে মাত্র তিনশত টাকা, সেখানে ত্রিশ হাজার টাকা পোস্টিং
দিয়েছে। টাকা নিয়ে চলে গেছে। এখন ক্লিনক্যাশ মিলাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। সকলে মিলে
বকাবকি করছে রফিক সাহবকে! বেচারা! আসলে চেকটি পোস্টিং-ই হয়নি। স্বাক্ষর জাল করেছে!
ম্যানেজার সাহেব ভালো মনের মানুষ। রফিক সাহেবের মুখ দেখেই বুঝেছেন যে রফিক
কাজটি করেনি। স্বাক্ষরও ওর নয়! ভয়ে বলেছে স্বাক্ষর ওর। তাছাড়া একবারেই যে অমিল তা
নয়! কিছুটা মিল আছে। ম্যানেজার সাহেব অ্যাকাউণ্ট্যান্ট সাহেবকে বললেন,‘এখন
রাগারাগি করে কোন লাভ নেই করিম সাহেব। আপনি ঠিকানা বের করেন, ওকে সঙ্গে নিয়ে সেই
ঠিকানায় চলে যান। যদি ওদের দেখা পান তো ভালো, আর না পেলে তখন দেখা যাবে কী করা
যায়।’ ওরা চলে গেল।
অতিরিক্ত ক্যাশ নেওয়ার জন্য গাড়ি এসেছে। নিয়ম অনুসারে এই শাখায় সাত লক্ষ টাকার অতিরিক্ত অর্থ রাখা
যায় না। এই শাখার ভোল্ট-লিমিট সাত লক্ষ টাকা। আজ সপ্তাহের শেষ দিন, জমা পড়েছে
ত্রিশ লক্ষ। লোকাল অফিস থেকে গাড়ি এসেছে। ক্যাশ-ইনচার্জ টাকাও গুনে বস্তাবন্দী করেছে।
ক্যাশ-সেকশন থেকে বস্তা বের করতে যাবে এমন সময়
গুলির শব্দ সেই সঙ্গে বোমার আওয়াজ। চারদিক ধোয়ায় ছেয়ে গেছে। তাড়িতাড়ি
ক্যাশ-সেকশন তালা বন্ধ করা হলো। গার্ড রুখে দাঁড়িয়েছে গেটে। আমরা সকলেই হাত ধরাধরি
করে লাইনবন্দী যাতে ভেতরে ঢুকতে না পারে ডাকাতদল। ওরা ঢুকতে না পেরে গুলি করে
এলোপাথাড়ি, একটা গুলি লাগে গার্ডের কাঁধে। থানা কাছে, পুলিশ আসতে সময় লাগে না।
পুলিশের গাড়ির আওয়াজে ডাকাতদলেআর একটা বোমা ফাটিয়ে পালিয়ে যায়। গার্ডকে হাসপাতালে
পাঠানো হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। কেউ ব্যাংক থেকে যেতে পারেনি। সারাদিনের
পরিশ্যম, উত্তেজনা; সবার মন বিষণ্ন। ফোন এল, ধরা পড়েছে ডাকাতের দল। আর ওদিকের খবর পাওয়া গেল, ত্রিশ হাজার টাকার
টাকার অর্ধেক পাওয়া গিয়েছে, বাঁকিটাও পাওয়া যাবে এমন আশ্বাস দিয়েছে ওই
ফ্রডি-লোকটি।ওই ফ্রডি-লোকটির সঙ্গে জড়িত ব্যাংকের একজন ক্লার্ক। ব্যাংকের কেউ একজন
জড়িত না থাকলে বাইরের কারও পক্ষে ফ্রড করা সম্ভব নয় সবাই জানে।
রাত আটটা। বাড়ি ফিরছি। প্রতিদিনের চেনা পথ। রোজকার মতো হেঁটে হেঁটে ফিরছি।
কিন্তু আমার ভেতরের আমি রোজকার মতো নেই। সে আজ আলাদা। আজকের সকালটির মতোই সে
আলাদা।