গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৭

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

বদরু 


বদরুদ্দীন সবে পাখীর খাঁচাটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, সোনাপট্টির ছগন শেঠ আর কাপড়গলির নিত্য বসাক সামনে এসে দাঁড়াল। বদরু ওদের দেখে একটা সেলাম ঠুকে দাঁড়িয়ে রইল। ভাবখানা এমন, এবার আজ্ঞা করুন হুজুর, নইলে ঘরে ফিরতে দেরী হবে যে!
ছগন শেঠ বাঁদিকের খাঁচায় কতগুলো টিয়া আছে,গুণে দেখছিলেন। হিসাব করে দেখলেন ঠিক তেরোটা। গুণেই মুখটা বাঁকালেন-- এ হেঃ হেঃ ...একি করেছ মিঞা, তেরোটা আবার কেউ রাখে, একটা বেচে দাও। তেরোর গুণতি ভাল নয়, জানো না!
বদরু খুব জানে। তেরো যত না খারাপ, ছগন শেঠ যে তার চেয়েও খারাপ তা সে জানে বৈকি! কয়েকদিন  আগে চকবাজারে আন্ডা বেচতে এসেছিল রহিমা, তাকে চোখের ইশারা করেছে এই বদতমিজ! একটু তাড়া দেখিয়ে বদরু বললেঘর যাব হুজুর, আপনি যদি পাখি  নেবেন তো নেন,নইলে পা বাড়াই।
নিত্য বসাক এতক্ষণ বদরুর পাখির খাঁচা দেখতে দেখতে ওদের কথা শুনছিলেন। ছগনের হয়ে মেজাজ  দেখালেন বদরুকে--তোর কিসের এতো তাড়া রে! দেখছিস, ছগন বাবু পাখি দেখছেন, কিনবেন  বলে...আর তুই ঘর যাবার কথা কইছিস! ভাত জোটে  তো পাখি বেচে, তাও চুরি করে জাল ফেলে পাখি ধরিস। ভাবিস আমরা কেউ জানি না? পুলিশে খবর দিলে কত টাকা গচ্চা দিতে হবে, তা জানিস? পাখি বেচার যেন কোন গরজ নেই, নাকি মাসকাবারীর খরচা ঐ বাবুদের বাড়ি থেকেই পাস?
বিরক্ত হল বদরু--অত কথা কেন হুজুর,পাখি বেচব বলেই তো সারাদিন জলে-ঝড়ে হাটে বসে আছি। নেবেন তো বলুন, ঝাঁপ খুলি...
 --ছগন বাবুকে বেচবি কিরে? উনি দয়া করে নিচ্ছেন, সেই তো অনেক। ঐ বাঁদিকের পাখিদুটো কি রে, নীলকন্ঠী মনে হচ্ছে...দে, ঐ দুটো আমায় দিয়ে দে।খাঁচায় নীলকন্ঠ পাখীদুটোর দিকে নজর পড়ে নিত্য বসাকের।
--না হুজুর,ও পাখি বেচবার পাখি নয়, বায়না করা আছে। ও পাখি তো আমি বেচব না হুজুর
--পাখি আবার কে বায়না করল?
--আছে হুজুর, ঐ বাবুদের বাড়ি প্রতি বছর নেয়, ওদের এনে দেই হুজুর, ওরা পাখি কেনেন, কিন্তু পাখি ধরে রাখেন না হুজুর, উড়িয়ে দেন, তাই বড় ভাল লাগে। আর হুজুর দুগ্‌গা ঠাকুর ঠিক আমার জন্যে পাখি ধরিয়ে দেয় হুজুর।
  --বটে! তোর আবার দুগ্‌গা ঠাকুর হল কবে থেকে, হ্যাঁ?বদরুর দিকে ত্যারছা চোখে তাকান নিত্য বসাক। কত দাম বল, ডবল দিয়ে দেব...দে পাখিজোড়া
নিত্য বসাকের কথায় অনড় বদরু, কিন্তু মুখে সেকথা প্রকাশ করে না।
 --তা হুজুর আপনাদের দুগ্‌গা ঠাকুর তো  আপনাদের মাঈই আছে...বড় ভালবাসায় কথা বলে বদরু।
--বটে বটে! তা দুগ্‌গা মায়ের আর কি কি কাজ করা হয়, শুনি?
--কাজ আর কি হুজুর, বাবুরা ফি বছর পাখি দুটো এনে দিতে বলেন হুজুর, বখশিস মেলে, পাখি দেই,  কিন্তু পাখি তো আবার বনে যায় হুজুর...তেনারা তো আর পাখি শিকার করেন না, তাই দিই হুজুর, পাখি ধরি বটে কিন্তু মারধর করলে বড় লাগে হুজুর
বদরুর এতেই আনন্দ। সে পাখি বেচে খায় বটে, কিন্তু মনে বড় লাগে। এনারা পাখিকে উড়িয়ে দেন, তাই  ভাল লাগে। আর অবাক কান্ড! ফি বছর বাবুরা পাখি উড়িয়ে দেন, কিন্তু ফি বছরই সে ঠিক কোথাও না কোথাও একজোড়া পাখি খুঁজে পায়, ধরে এনে বাবুদের হাতে দেয়। তাই বাবুদের কাছে বদরুর কদরও আছে। বাবুরা তার বদলে পুজোর মিষ্টি, খাবার-দাবার, একখানা লুঙ্গি এমন কি গতবছর রহিমাকে একখানা ছাপা শাড়িও দিয়েছিল। তবে সেই বা কেন বাবুদের সঙ্গে অধর্ম করবে!
--কই রে, দে পাখি দুটোনিত্য বসাকের এক গোঁ।
ওই পাখিজোড়া আমায় দে, আর টিয়াটা ছগন বাবুকে দিয়ে দে।
--ও পাখি আমি বেচব না হুজুর, আপনাদের তো বলেইছি অনড় বদরু। আল্লাহ্‌! বাড়ির পথ তো ধরেই ফেলেছিলাম, আর একটু মেহেরবানি করলে তো ঘরেই ফিরে যেতাম, এই বদতমিজ...... মনে মনে ভাবে বদরু।  
ছগন এবার ভুরু কুঁচকে বদরুর দিকে তাকান।আচ্ছা, বসাকবাবুর পাখি দুটা দিয়ে দাও আর হামি ভি তুমাকে কুছু পয়সা দিব, আমাকে টিয়া দিয়ে দাও
এবার রীতিমত রুষ্ট হল বদরুআপনার টিয়া আপনি কিনলে কিনুন হুজুর, কিন্তু ও পাখি আমি বেচব না। আমি জান থাকতে নিমকহারামি করব না হুজুর। আমি বাবুদের বাড়ি কথা দিয়েছি
হঠাৎ ক্ষেপে ওঠেন নিত্য বসাকতুই কি দুগগা ঠাকুর দেখাচ্ছিস রে? শালা...চোর! তাও আবার লেড়ে...আমায় দুগগা দেখাস। খাস তো চুরি করে। পুলিশে দিলে কত টাকা তোর আছে, যে ছাড়ান পাবি? দে শালা...দে তোর পাখি...কেমন না দিস দেখি!বলে জোর করে কেড়ে নিতে যান খাঁচা থেকে পাখি দুটো। বদরু হাত দিয়ে আগলে ধরে থাকে খাঁচা। জোর-জবরদস্তি...শেষে লোহার খাঁচার একটা কোণায়  লেগে বদরুর গালে একটু রক্তপাত আর এই ধস্তাধস্তিতে খাঁচা খুলে একটা পাখি উড়ে পালায়, তাকে ধরতে গিয়ে খাঁচা উলটে আরো একটা । বদরু দু হাত দিয়ে এতো বড় খাঁচা ধরে রাখতে পারে না, টাল সামলাতে গিয়ে মাটিতে উলটে পড়ে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কি যেন ঘটে যায়। টিয়াগুলোও  ঝটপট ঝটপট করতে করতে দু একটা বাদ দিয়ে বাকি গুলো সব উড়ে পালায়। নিত্য বসাক পাখি দুটো উড়ে পালানোয় হতভম্ব হয়ে যান। বাকি টিয়াগুলোকে খাঁচা থেকে বার করে উড়িয়ে দিতে দিতে অকস্মাৎ জোরে জোরে হেসে ওঠে বদরু...ও আপনাদের দুগগা ঠাকুরের  কাছেই পলালো হুজুর...ধরেন ধরেন...যদি পারেন ধরতে...
বদরুর সঙ্গে পাখি নিয়ে আকচা-আকচিতে কয়েকজন মুটেমজুর, রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল। তারাও হেসে ওঠে বদরুর হাসি দেখে।
--ধম্মে সইবে না হুজুর, গরীবের মা-বাপ আছেন, আছেন মা দুগ্‌গা...পাখি নিজেই পালালো হুজুর। কি করবেন এবার, বুঝুন!
ধীরে ধীরে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায় বদরু। চোখে এবার জল এসে পড়ে তার। বাবুদের পাখি না দিতে পারলে বদরুর  নিমকহারামি হবে, বদনাম হবে। তার চেয়ে বাবুদের সব কথা খুলে বলাই ভাল, কিন্তু হায় আল্লাহ্‌!  আর কি পাখি এসে ধরা দেবে?
শূন্য খাঁচা কাঁধে ঝুলিয়ে বাবুদের বাড়ি রওনা হল বদরু।