গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৭

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

ক্লাউন 

ক্লাসে ঢুকেই দেয়ালে টাঙ্গানো ব্ল্যাকবোর্ডে একটা মানুষের মুখ এঁকে ফেললেন মাষ্টারমশাই। সেদিন ক্লাসে পড়া বিশেষ ছিল না, তাই এইসব গল্প-ছবি আঁকা। মানুষের মুখটা এঁকেই বলে উঠলেনএই ধরো, এটা একটা ক্লাউন!
আমার তখন ক্লাস সিক্স। কিছুদিন আগেই মা-বাবার সঙ্গে গিয়ে সার্কাস দেখে এসেছি। তাই বলে উঠলামমাষ্টারমশাই, নাকের ডগায় একটা আপেল লাগানো থাকে, আর গাল গুলো সাদা হয়।
মাষ্টারমশাই আমার দিকে চেয়ে অল্প একটু হাসলেন
,বললেনওসব কিছু না থেকেও ক্লাউন হওয়া যায়। আজ তোমাদের একটা ক্লাউনের গল্প বলি। ক্লাউন কাকে বলে জান তো?’
 
আমরা সবাই খুব জোরে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালাম। মাষ্টারমশাই বললেন
ক্লাউন শুধু অন্যকে হাসায় তা নয়, সে এমন কিছু উল্টোপাল্টা কাজ করে, তাই দেখে, ভেবেও মানুষ হাসে। নিজে নিজেও হাসা যায়, হাসতে হয় অনেকসময়। আমাদের মানুষের মধ্যেও অনেক ক্লাউন আছে।
মাষ্টারমশাই সেদিন নিজের কথাই বলেছিলেন, অনেকদিন পর সেটা বুঝেছিলাম। বলেছিলেন,  একটা সোজা রাস্তায় চলতে চলতে কিছুটা পথ কি সুন্দর ভাবে সহজ পথে এগিয়ে গিয়ে আর  একটা পথ দেখে নাকি তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন। সেই রাস্তাটাও যে খুব খারাপ ছিল তা নয়,  কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, আগের টাতে গেলেই তো হত। সবচেয়ে মুশকিলের কথা, দ্বিতীয় রাস্তাটা কিছু দুর গিয়ে কেমন যেন কাঁটাঝোপে ভর্তি আর এবড়ো-খেবড়ো । তাই পাশ দিয়ে  আরো একটা রাস্তায়  নেমে পড়েছিলেন। কিন্তু অবাক কান্ড! আবার কিছু দুর গিয়ে দেখেন দ্বিতীয় আর তৃতীয় রাস্তাটা প্রায় একসঙ্গে মিশে গেছে, তার মানে সেই কাঁটাঝোপ আর এবড়ো-খেবড়ো। --আচ্ছা, তোমরাই বল, এর চেয়ে একেবারে প্রথম রাস্তাটাতে গেলেই হত। মাঝখান থেকে যাওয়াটাই আটকে রইল। এই যে কান্ড একে কি লোকে পাগলামো বলবে না? লোকে তো হাসাহাসি করবেই! আর কাকে দেখে লোকে হাসে, ক্লাউনকে দেখে, যে কিনা উল্টোপাল্টা কাজ করে। কি, ঠিক কিনা? আমার কাজটাও সেই ক্লাউনের মতই।এই বলে আমাদের দিকে চেয়ে রইলেন মাষ্টারমশাই।
সেদিন ঠিক মানুষের মধ্যে ক্লাউন আর সত্যিকারের ক্লাউন এই দুয়ের ফারাক বুঝিনি। কিন্তু মাষ্টারমশাই যে গল্পটা বলেছিলেন, সেটা অনেকদিন অবধি মনে ছিল।  

আমি তখন ক্লাস ইলেভেন, সবকিছু না বুঝলেও অনেককিছু বুঝি। বাড়িতে একদিন রন্টি দাদাকে মাষ্টারমশাইয়ের সেই গল্পটা বলেছিলাম। কেন এতদিন পর মনে পড়েছিল, তা বলতে পারব না। রন্টি দাদা আমার বড় পিসির ছেলে, আমাদের কাছে থেকে পড়াশোনা করত। একেবারে পাগল ছেলে। রন্টিদাদা গল্পটা শুনেই বলল---একেবারে আমার মতই। এই দ্যাখ্‌না,আমি ডাক্তারী পড়তে গিয়ে মনে হল, এর চেয়ে ইংরাজি নিয়ে পড়লে ভাল হত। ভর্তি হলাম নামী-দামী কলেজে। কিন্তু পড়া শেষ হতে না হতেই আমার মনে হল বটানি নিয়ে পড়লেই সবচেয়ে ভাল হত। বটানি নিয়ে পড়লে আমি কেমন ঝপাস করে গবেষণার কাজে লেগে যেতাম! কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ডাক্তারীর থার্ড ইয়ার অবধি পড়া হয়ে গিয়েছিল, ওটাই তো আমার সবচেয়ে সহজ, সবচেয়ে সুবিধে ছিল, করলাম কি! আমাকে ক্লাউন ছাড়া আর কি বলা যায়? এখন যে আমাকে দেখে, সেই হাসে। 
রন্টি দাদার কথার মাঝে হঠাৎ দেখি ছোটপিসি কখন এসে দাঁড়িয়েছে। ছোটপিসি এখানে একটা
 স্কুলে পড়ায়। রন্টি দাদাকে বলল---তুই আর ঝন্টিগিরি করিস না তো! সবই যেন ক্রিকেট, ঝপাস করে ঝন্টির ক্যাচ ধরা...!!
রন্টি দাদা বলে উঠলনয় তো কি তোর মত? জানিস মাষ্টারমশাই ...সেই কবে কি একটা ভালবাসা-টাসা হয়ে গেছে...তুই এখনও...কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখি ছোটপিসি নেই। রন্টি  দাদা ছোটপিসিকে তুই বলে।
বললাম-- ছোটপিসি ...মাষ্টারমশাই...তার মানেরন্টিদাদা মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেতবে আর বলছি কি! সব এক একটা ক্লাউন। মাষ্টারমশাই রাস্তা ভুল করলেন, ছোটপিসি এখনও বসে রইল...কোন মানে হয়?’
--যদি কোনদিন না আসেন?
রন্টি দাদা মন খারাপের মুখ করে বললে
তাই তো ভাবি রে বিলু... প্রথম রাস্তাটা যে মাষ্টারমশাইয়ের ফেলে যাওয়া ঠিক হয়নি, সেটা উনিও জানেন, সেটাই তো ছোটপিসির আশা রে।
--কিন্তু ধর,যদি না আসেন?
--আরে
, সবাই কি ক্লাউন নাকি? কি মুশকিল, আসবেন না মানে, আসবেন ...ঠিক আসবেন,
 তুই দেখে নিস! 
আশায় আছি
, মাষ্টারমশাই যেন আসেন,নইলে ছোটপিসি...আর ভাবতে ভাল লাগে না।