প্রতিদিন
কতো যে অদ্ভুত সব ঘটনার সাক্ষী হতে হয়, অদ্ভুত সব মানুষের সাথে পরিচিত হতে হয়,
ভেবে হাসিও
পায় আবার দুঃখও হয়। এদের কে ভুলতে চাইলেও কিন্তু ভোলা যায় না। মনের গভীরে বাসা
বেঁধে রয়েই যায়। আজ এরকমই একজন আপাত নিরীহ গোবেচারা মানুষকে দীর্ঘ দিন পরে রাস্তায়
হঠাৎ দেখে এক যুগ আগের এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগের রাতের কথা মনে পড়ে গেল। ভদ্রলোকের সাথে
প্রত্যক্ষ
পরিচয় না
থাকলেও, তাঁকে রাস্তাঘাটে প্রায়ই দেখতাম।
মার্চ
মাসের একটা দুপুর, অফিসে কাজের ভয়ঙ্কর চাপ, হঠাৎ এক অত্যন্ত ঘনিষ্ট বন্ধুর ফোন, তার মা মারা গেছেন। ওর মা’কে মাসিমা বলে ডাকতাম। তিনি আমাকে পুত্রসম স্নেহ করতেন, কতোবার
ওদের বাড়ি গিয়ে কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে এসেছি,
একসাথে বেড়াতে গেছি। যদিও বন্ধুর বাড়ি, আমার
বাড়ির কাছেই তবু সহকর্মীদের ওপর হাতের কাজ চাপিয়ে সোজা তার বাড়ি গিয়ে
উপস্থিত হলাম। আকাশের অবস্থা খুব ভালো বলে মনে হলো না, তাই প্রাথমিক শোক সামলে নিয়ে একসময় একটা ম্যটাডোরে শবদেহ
নিয়ে নিকটতম শ্মশান ঘাটে নিয়ে যাওয়া হলো। উল্লিখিত ভদ্রলোককে ওই পাড়ার বাসিন্দা
হওয়ার সুবাদে সঙ্গে যেতে দেখলাম। তখনও নিমতলা, কেওড়াতলা, ইত্যাদি মহাশ্মশান ছাড়া আর সব শ্মশানেই কাঠের চিতায় শবদাহ করা হতো। হাওড়ার
শ্মশান ঘাটগুলোয় বৈদ্যুতিক চুল্লি হয়তো স্বপ্নের পর্যায়েই ছিল। যাইহোক, তখনও শবদাহ
করতে যাওয়াটা এখনকার মতো ঠিক ‘জুলে রিমে ট্রফি’ জয়লাভের আনন্দানুষ্ঠানের পর্যায়ে পড়তো না, হরিধ্বনি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো বটে, তবে সেই
ধ্বনির তীব্রতা কখনই সহনীয় ডেসিবেল মাত্রা অতিক্রম করতো না।
সে যাহোক্, যেকথা বলছিলাম,
রওনা হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই
মুষলধারে শিলাবৃষ্টি শুরু হলো। চশমা খুলে রেখে হাত দিয়ে মাথা বাঁচিয়ে
আমরা কোনমতে শ্মশান ঘাটে গিয়ে হাজির হলাম। এই শ্মশানটায় গোটা চারেক চুল্লির ব্যবস্থা থাকলেও, বৃষ্টির জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিলো না। শ্মশান
চত্বরে একটা মন্দির, তার সামনে
বেশ খানিকটা জায়গা উঁচু করে লাল সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো চাতাল। শ্মশান যাত্রীরা ও ভক্তরা সেই চাতালে বসে
পূজা দেখেন, বিশ্রাম
নেন। আমরা ভিজে পোষাকে সেই চাতালের ওপর দাঁড়িয়ে আছি, কারণ লাল তেলতেলে বাঁধানো চাতালটা এখন আর বসার মতো অবস্থায় নেই।
চাতালের ঠিক নীচে শবদাহের চুল্লির অঞ্চলটি জলমগ্ন, জলের হাত থেকে বাঁচতে কয়েকটা কুকর সেই চাতালে আশ্রয় নিয়েছে। ভিজে কর্দমাক্ত নোংরা চাতালে মাছি ভনভন্
করছে। অবশেষে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে ধীরে ধীরে জল নেমে গেলে, শবদাহর জন্য প্রস্তুতি পর্ব সমাপ্ত হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে মুখাগ্নি ও চিতায়
অগ্নিসংযোগ করা হলে, আমরা ভিজে পোষাকে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপত চাতালের ওপর দাঁড়িয়ে রইলাম। অবস্থার গভীরতা অনুভব করে বন্ধুর বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা
গরম চাদরও ইতিমধ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শ্মশানের
কাজ মিটতে বেশ রাত হয়ে গেলো। গাড়িটাকেও চুক্তিমতো ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর
বেশ অনেকটা পথ হেঁটে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে অস্থি ভাসিয়ে
স্নান করা,
বন্ধু ও তার ভাইকে
কাছা ধারণ করতে
সাহায্য করা, ইত্যাদি
মিটিয়ে যখন বাড়ির পথ ধরলাম, তখন অনেক রাত। মনে একটাই চিন্তা, আমার নিজের কোন সংস্কার না থাকলেও,
সঙ্গে অনেক লোক থাকলেও, বন্ধুর
বাড়ি একবার যেতেই হবে। সেখানে লোহা ছুঁয়ে,
দাঁতে নিমপাতা কেটে, আগুনের
তাপ নিয়ে, নিজের বাড়ি ফেরার পথে কুকুরের আক্রমণের মুখে না পড়তে
হয়।
যাইহোক বেশ ফিরছিলাম। রাস্তায় যত্রতত্র কুকুর শুয়ে
থাকলেও, তারা
বোধহয় আমাদের আজ এই দুঃখের দিনে তেড়ে আসতে সংকোচ বোধ করে একবার মুখ ঘুরিয়ে দেখে
আবার শুয়ে থাকলো। কিন্তু ফেরার পথে অনেকক্ষণ পরপর অনুচ্চ স্বরে হরিধ্বনি দেওয়া
হলেও, অল্প বয়সী
যুবকরা মাঝেমাঝেই সুর করে উচ্চৈঃস্বরে “মধু বোঁদে” বলে চিৎকার করছিল। কেন করছিল বা কার উদ্দেশ্যে করছিল বুঝতে না পারলেও, একটা আসন্ন ঝামেলার আঁচ অনুভব করছিলাম।
কিছুক্ষণ পরেই মধু বোঁদে চিৎকারের সাথে সাথেই সামনে থেকে
“তোর বাপকে গিয়ে বল্”
উত্তর শুনতে পেলাম। এরপর থেকে
মধু বোঁদে চিৎকারের পর্দা ও সংখ্যা,
উভয়ই বেড়ে গেল। বেড়ে গেল সামনে
থেকে ওই ভদ্রলোকের মুখ থেকে চোখা চোখা উত্তরের সংখ্যা। ক্লান্ত অবসন্ন
দেহে কাঁপতে কাঁপতে সারাদিন পর ফেরার পথে, এমন একটি দিনে শ্মশান বন্ধুদের এই আচরণ ক্রমশঃ বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।
বেশ ফিরছিলাম, আর হয়তো আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবো, এমন একটা সময় অতি নিরীহ ভদ্রলোকটি অতি হিংস্র রূপ ধারণ করে “শালা, তোদের
বাপরা আমাকে দাদা বলে ডাকে আর তোরা কাল কা যোগী, আমায় নাম ধরে ডাকছিস? এসব কথা তোদের বাপেদের গিয়ে বলগে যা”
সাথে সঙ্গী যুবকদের বাপেদের
উদ্দেশ্যে চোখা চোখা বিশেষণ উচ্চরণ করে একজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মারামারি, ধস্তাধস্তি, চিৎকার
করে গলিগালাজের বন্যা বইতে শুরু করায়, শুয়ে থাকা
কুকুররা পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে দলবদ্ধ হয়ে অন্যান্য পাড়ার সঙ্গীদের ডেকে এনে প্রতিবাদ
শুরু করে দিলো। কয়েকজন পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেও বিফল হলো। বাধ্য হয়ে আমরা
কয়েকজন বাস রাস্তার ওপর বসে একটা আশঙ্কা নিয়ে যুদ্ধ বিরতির অপেক্ষা করতে লাগলাম।
রাতদুপুরে এই চিৎকার চেঁচামিচিতে না স্থানীয় লোকেরা বিরক্ত হয়ে ঝামেলা শুরু করেন।
যাহোক্,
অনেক চেষ্টার পর পরিস্থিতি
ঠান্ডা হওয়ায় আমরা বন্ধুর বাড়ি অক্ষত দেহে ফিরে এসে প্রয়োজনীয় নিয়ম কানুন
সুসম্পন্ন করে যে যার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
পরে মধু
বোঁদে রহস্য উদঘাটন হয়েছিল। জানা গেল কোন এক উৎসব বাড়িতে মধু নামক ওই ভদ্রলোক
বোঁদে পরিবেশন করেছিলেন, তারপর থেকে তাঁকে ‘মধু বোঁদে’ বললেই তিনি ওইরকম উত্তেজিত হয়ে পড়েন। জানি না যে উৎসব বাড়িতে মিষ্টি
হিসাবে একমাত্র বোঁদেই হয়েছিল, সেখানে তাঁর দোষটা কোথায়? তিনি সেখানে বোঁদের পরিবর্তে কিভাবে রসগোল্লা পরিবেশন করবেন, ভেবে পেলাম না।