এক
আমি সনাতন। গ্রামের ছেলে। বাবার
চাষবাস। পুরন্দরপুর গ্রামে আমাদের বাড়ি। জেলা বীরভূম। আমি ইঞ্জিনিয়ার। পড়াশুনো
সাউথ ইন্ডিয়ায়। বাবার পয়সায় কিছুটা, বাকিটা নিজের মেধায়। আমার স্ত্রীর নাম মধুমন্তী। শহরের মেয়ে। বাবার চাকরি, সাইডে ব্যবসা। বালিগঞ্জের ডোভার
লেনে বাড়ি। পড়াশুনো কলকাতায়। বাবার পয়সায়,
নিজের মেধায়।
আমরা প্রেম করে বিয়ে করেছি।
মাত্র কয়েক মাসের প্রেম।
দুই
কোন এক কমন ফ্রেন্ডের বাড়িতে
আলাপ হয়েছিল। তার কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানে। কীরকম যেন দূর সম্পর্কের বোন হয়
দুলালের। যা হয়। একটা মাঠের মধ্যে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে ব্যুফে খাবার। প্যাঁ প্যাঁ
করে সানাই বাজছে। এদিক ওদিক ফুল আর ডেকোরেশন। বরফের হাতি না গণেশ কী যেন একটা
গলছে। তিরতিরে ফোয়ারা। নকল গাছ। সবুজ আলো। কেউ একজন আলাপ করিয়েছে আমাদের। সময়
কাটানোর জন্য এটা ওটা গল্প। পাশাপাশি চেয়ারে বসে। টেলিফোন নম্বরে মিসড কল। নম্বর
সেভ ইত্যাদি।
আমার আবার আইটির চাকরি। বেশিরভাগ
ইঞ্জিনিয়ারদের যা গন্তব্য। মধুমন্তীকে জানালাম সামনের জুন মাসে নিউ জার্সিতে
পোস্টিং পাচ্ছি।
মধুমন্তীর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
তিন
কিছুদিনের মধ্যেই মধুমন্তীর বাবা-মা আমাদের নেমন্তন্ন করলেন।
চার
এতো ঝকঝকে পেল্লায় ফ্ল্যাট আমি
আগে দেখিনি। গোটা ফ্ল্যাটের আন্দাজ পাবার চেষ্টা করলাম ড্রয়িং রুমে বসে। ছোট বড়
মিলিয়ে অন্তত আরও খান পাঁচেক ঘর আছে। যার তিনটে তো বেডরুম হবেই। নানা ধাতু আর
টেরাকোটার মূর্তি – ফুলের টব। কী নেই।
ফ্ল্যাটে বসে আমার মা আর দিদি।
বাবা অসুস্থ। আসেননি। বড় বড় মিষ্টি খেতে খেতে কথা পাকাপাকি হয়ে গেল।
পাঁচ
নিউ জার্সির পিস্ক্যাট্যাওয়েতে
আমার অ্যাপার্টমেন্ট। জায়গাটা একটা ব্যারাকের মতো। এতো দৃষ্টি পীড়াদায়ক বাড়ির সারি
আমি কমই দেখেছি। বাড়ি ভাড়া দিয়ে অন্য খরচ চালিয়ে যতটুকু পয়সা বাঁচে মধুমন্তী
গোটাটাই উড়িয়ে দেয় শপিং মলে ঢুকে কস্টিউম জুয়েলারি আর ডিজাইনার পোষাকে। বায়না ধরে
নানা জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্য। ফাঁক পেলেই আমাকে বাড়িতে রেখে আমার
সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়িটা নিয়ে কোথায় না কোথায় উধাও হয়ে যায়।
আমি একদিনই ওকে বলেছিলাম পিৎজা
খেতে আমার ভালো লাগে না। তারপর থেকে মধুমন্তী কখনই আমার জন্য কোন খাবার কিনে আনে
না। যা আনে একা একা খায়। বাকিটা ফেলে দেয়। রান্নাবান্নার বালাইও নেই। আমার বাড়ির
কারও সঙ্গেই টেলিফোনে কথা বলে না। আমার সঙ্গেও খুব কম কথা বলে।
যত কথা ওর মার সঙ্গে।
ছয়
আমাকে খুব বেশিদিন অ্যামেরিকাতে
থাকতে হয়নি। প্রোজেক্ট কমপ্লিশনের সঙ্গে সঙ্গেই ফেরত এলাম ব্যাঙ্গালোরে। মধুমন্তীর
মেজাজ খারাপ। চোখের আগুন নিভে গেল। অ্যামেরিকান ড্রিম নিভে গেল।
ধীরে ধীরে আমাদের সম্পর্কও নিভে
নিভে আসছে। আমি বেশিরভাগ সময়েই বাইরে থেকে খেয়ে আসি। সামান্য কিছু নিজের মত রাঁধি
কখনও সখনও। সেদ্ধ খাই। আমার আনা খাবার – আমার কোন রান্না মধুমন্তী মুখেও তোলে না কোনদিন।
যত কথা আর গল্প ওর মার সঙ্গে।
সাত
আমাদের সম্পর্কের এই বাঁকের খবর
বাড়িতে কাউকে বলিনি।
আমরা তখন
ব্যাঙ্গালোরে ফিরে এসেছি। গোল বাধলো আমার মামাতো ভাইয়ের বিয়ের সময়। মধুমন্তী বেঁকে
বসলো। এ বিয়েতে কিছুতেই অ্যাটেন্ড করবে না সে। আমাদের বাড়ির সঙ্গে কোন সম্পর্ক সে
রাখবে না। কারণ- এক- আমাদের
বাড়ির লোকেরা, অর্থাৎ আমার মা-দিদি ও
আমি নাকি মধুমন্তীকে একটি প্রদর্শনযোগ্য বস্তু ভাবি এবং সেই ভাবে তাকে আত্মীয়-স্বজনের
সামনে উপস্থিত করি। এতে নাকি তার অত্যন্ত অস্বস্তি ও বিরক্তি উপস্থিত হয়। কারণ-দুই- আমাদের বাড়ির অবস্থা এবং আত্মীয়স্বজন আর মধুমন্তীর বাপের বাড়ির অবস্থা এবং
আত্মীয়স্বজনের গুণগত মান ও শিক্ষাগত যোগ্যতায় আকাশ পাতাল ফারাক। এতেও তার অত্যন্ত
অস্বস্তি ও বিরক্তি উপস্থিত হয়।
আমি রেগে গিয়ে বললাম, এভাবে আর থাকা যায় না।
সেই রাতে
মধুমন্তীর বাবা ফোন করে আমাকে বললেন, ডিভোর্স দিতে মধুমন্তীর বা তাঁদের তরফ থেকে আপত্তির কিছু নেই। তবে সেক্ষেত্রে
ষাট লক্ষ টাকা দামের একটি ফ্ল্যাট- নগদে আরও তিরিশ লাখ- বিয়েতে পাওয়া যাবতীয় উপহার আসবাব অলংকারাদি ফেরত দিতে হবে।
এছাড়া মাসে মাসে হাজার চল্লিশেক
টাকা দিলেই চলবে।
আট
আমার
ক্ষমতা নেই। আমি ভয় পেয়ে গেছি। কাউকেই কিছু বলি নি। আমার বৌ আমাকে উঠতে বললে উঠি।
বসতে বললে বসি। কিছু না বললে চুপচাপ থাকি। মধুমন্তীও থাকে নিজের মতো। যখন খুশি
কলকাতায় যায় আসে। এয়ার জার্নি ছাড়া যাতায়াত করেই না। যা ইচ্ছে তাই কেনাকাটা করে।
আমার পয়সায়।
নয়
আমার মা আর দিদি একদিন
মধুমন্তীদের বাড়ি যাবে ঠিক করেও যেতে পারল না।
বেহালায়
আমার মাসির বাড়িতে উঠেছিল তারা। ল্যান্ড লাইনে ফোন করল মা। ফোন ধরেছিলেন মধুমন্তীর
বাবা। হ্যাঁ হ্যাঁ চলে আসুন। বলেই সঙ্গে সঙ্গে ঢোঁক গিললেন তিনি। না না আমরা থাকছি
না। এক্ষুনি বেড়িয়ে যাচ্ছি। ফিরতে রাত হবে। পুরো বোঝা যাচ্ছে পাশ থেকে মধুমন্তীর
মা প্রম্পট করে যাচ্ছেন ফিসফিস করে। এরপর থেকে আমরা কেউ মধুমন্তীদের বাড়িতে
কোনদিনই যেতে পারিনি। সবসময়ই সেই একই অজুহাত। আমাদের আসার খবর পেলেই সবাই বাড়ি
ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন।
দশ
মধুমন্তী
পড়াশুনো করতে চাইল। আরও। যাতে ভালো চাকরি পেতে পারে। পড়াশুনোয় তো সে কোনদিনই খারাপ
নয়। আমার কয়েক লাখ টাকা শেষ হয়ে গেল। কিন্তু বৌ চাকরি পেল। দেশে বিদেশে ট্রেনিং
ইত্যাদির শেষে আবার সেই ব্যাঙ্গালোরেই চাকরি। একই ছাদের তলায় আমরা দুটি প্রাণী।
একটা মেস বা বোর্ডিং হাউসের দুটি অধিবাসীর মধ্যে যতটা নৈকট্য থাকে, আমাদের সেটুকুও নেই। লোকে জানে
আমরা স্বামী স্ত্রী। কিন্তু মধুমন্তী আমার ফোনও সবসময় রিসিভ করে না। সব প্রশ্নের
জবাবও দেয় না। ও বেডরুমটায় শোয় আর আমি শুই ড্রয়িং রুমের সোফা-কাম বেডটায়।
অনেক রাত্তির পর্যন্ত মার সঙ্গে
অস্ফুট স্বরে কী যেন বলে যায় মধুমন্তী। আমি টের পাই।
এগার
আমাদের কারও জীবনেই কিন্তু অন্য
কোন নায়ক-নায়িকা নেই।
ক্রমশ এই
জীবন আমার সহ্য হয়ে যাচ্ছে। মধুমন্তী অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকছে। আগে আমাকে ওর জন্য
অনেক সময় দিতে হতো, কাজের ক্ষতি করে হলেও। এখন আমাকে নিয়ে ভাবার অতটা সময় নেই। অফিস থেকে ফিরে
ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে। আমিও অনেকটাই ছন্দে ফিরছি। আমার ওপর আর্থিক চাপটাও কমে
গেছে। অনেক খরচ নিজের রোজগার থেকেই চালিয়ে নিচ্ছে মধুমন্তী।
মাঝে মাঝে মধুমন্তীর মা আসেন
আমাদের আস্তানায়। কয়েকদিন থেকে যান।
আমাদের কথাবার্তা এরকম হয়।
কেমন আছেন?
ভালো।
ফ্লাইট তো সময়মতই ছিল।
হ্যাঁ।
কী খাবেন রাত্তিরে?
দেখি মেয়ে কী আনায়।
আচ্ছা,
গুড নাইট। কাল আবার দেখা হবে।
গুড নাইট।
বারো
আমার
শাশুড়ি যে হঠাৎ শয্যাশায়ী হয়ে পড়বেন আমি জানতাম না। মানে বুঝতে পারিনি।
সেরিব্র্যাল অ্যাটাকে পঙ্গু হয়ে গেছেন। আমরা বার দুয়েক ঘুরে এসেছি কলকাতা থেকে এর
মধ্যেই। বাদিকটা পড়ে গেছে। মুখটা বেঁকে আছে। কথা বলতে পারছেন না। ডাক্তার কিন্তু
আশাবাদী-
ক্রমাগত বলে যাচ্ছেন- আজও মির্যাকল
হয়।
মার ইনফ্লুয়েন্সটা কমে যাওয়াতে
মধুমন্তী অনেক স্বাভাবিক এখন।
যদিও আমরা
আলাদা শুই, মাঝে মাঝে
সোফা-কাম-বেডে আমার পাশে একটা বালিশ নিয়ে এসে শুয়ে পড়ে সে। খাবারদাবার একটু বেশি করে
কেনে যাতে আমরা দুজনেই খেতে পারি। দুএকটা পদ রান্নাও করে কোন কোন দিন, মুড হলে।
তের
মধুমন্তীর
মা ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছেন কলকাতায়। মধুমন্তী একদিন আমাকে বলল, অনেকদিন ফিল্ম দেখি না, চল দেখে আসি। আইনক্স জেপি নগর, এইটুকু তো পথ। হেঁটে যাতায়াত করি
সে রাত্তিরে ফিল্ম দেখে অনেকটা
পথ হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরলাম। গাড়ি ছাড়া যাতায়াত করা হয়ে ওঠে না। তাই বড় ভালো
লাগছিল।
অনেক রাত্তিরে সেই আগের মতোই
মধুমন্তীর মায়ের ফোন এলো।
কথোপকথনে বুঝতে পারছি, মির্যাকল হচ্ছে। মহিলা সুস্থ
হয়ে উঠছেন। কথার জড়তা কেটে যাচ্ছে।
মধুমন্তী কি আবার প্রভাবিত হবে? আবার আলাদা খাওয়া শোয়া?
একই ছাদের তলায় দুটি বিচ্ছিন্ন
মানুষ!
আবার!
বারান্দার
গ্রিল ভেদ করে আকাশে উড়ে যাওয়া তো যাবে না,
আমি ঝুঁকে পড়ে অনেক নিচের রাস্তা দেখতে লাগলাম। অত
রাত্তিরেও মাঝে মাঝে দুয়েকটা মোটর বাইক আর গাড়ি যাতায়াত করছে।