দ্রোহী
বিশাল
কনক্রিটের দেয়াল ঘেঁষা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো সুহাসিনী। হাতে একটি মাত্র সুটকেস।
এ বাড়ি থেকে একদিন চলে গিয়েছিল একজনের হাত ধরে।পরম বিশ্বাসে,নির্ভরতার অন্যতম ঠাঁই ভেবে যার জন্য ছেড়েছিল শৈশব কৈশোরের মমতা ঘেরা এই
বাড়িটি,আজ আর সে বিশ্বাসের কোন মূল্যই নেই।
আজ
সে নিঃস্ব হয়ে ফিরে এসেছে। লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে আবার দারস্থ হয়েছে তাদের,
যারা একদিন আস্তাকুঁড়ের আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো তাকে। মাত্র
পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে এমন করে ঝড়ের মত সব লন্ড ভন্ড হয়ে যাবে এ যে ভাবনার বাইরে
ছিল।
ঝড়
জলের রাতে একদিন বাড়ি ফিরতে গিয়ে তোমার সাথে পরিচয়।তারপর অসীম আকাশে ডানা মেলে উড়েছি
কতদিন! আমাদের ছোট্ট ভুবনে তুমি আর আমি ছাড়া আর কিছুই ভাবতে
পারিনি। পরিবারের অমতে সব ছেড়ে ছুড়ে একদিন পাড়ি জমিয়েছিলাম অজানা ভুবনে। যে ভূবনে ফুল
ফোটাবো শুধু তুমি আর আমি। পরম বিশ্বাসে মমতায় ঘেরা আমাদের ছোট্ট নীড়।
খূব
বেশী চাওয়া আমার ছিল না কোন কালেও। সৌম্যকান্তি অবয়বের আড়ালে এমন হায়েনার মুখ লুকিয়ে
থাকতে পারে, কে ভেবেছিল কোন কালে?
আজকাল
কেন যেন প্রায়ই রাতে ঘুম হতোনা না। এক রাতে খাবার ঘরে ফ্রিজ খুলে ঠাণ্ডা জল খেতে গিয়ে
তোমাকে ভাঁড়ার ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে যেতে চমকে
ঘুরে তাকালো সুহাসিনী।
--'কাকে চাই?'
দারোয়ানের প্রশ্নে অসহায় চোখ তুলে তাকালো। কাঁপা গলায় নিজের পরিচয় দিলো। দারোয়ান চিনলোনা। উত্তর আসলো এ বাড়ির মালিক অনেক দিন আগে বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছেন।
পা
বাড়ালো সুহাসিনী,কঠিন সংকল্পে ব্রত হয়ে গ্লানিময়
নোংরা পৃথিবী থেকে অনেক দূরে, কোনো এক অজানার পথে।
আরশিনগর
টিম টিমে আলোয় আবছা একটা ছায়া। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।এই নিশুতি রাতে কে ! কুপির আলোয় এবারে অস্পষ্ট দেখা যায় অবগুন্ঠিত সদ্য যৌবনা এক নারী।
--' কে তুই?'
'আমি দূর গাঁ থেকে এসেছি গুরুজি ।সংসার
আমারে নিল না, ঘর আমারে ঠাঁই দিলনা, তাই ঘর ছেড়েছি,আমায় আপনার শিষ্য কইরে নেন গুরুজি।
আমার মন টানে লালনের গীতে। আমার এই জীবনে মিলনের আশা যে নেই গুরুজি। তাই আমি আপনার
কাছে আসছি । আমারে ফিরায়ে দিয়েন না,দয়া করেন গুরু। নইলে যে
আমার এ কূল ও কূল দু'কূল ই যাবে। '
গুরুজি চোখ বুজে শুনছিলেন,মাথায় হাত রাখলেন,ঘরহারা এই নিশি কন্যার।
- নাম কি তোর?
-'কাজললতা'
'সাধনা যে কত কঠিন তা কি তুই জানিস?'
'আমি জানি, আর
জানি বইলাই আমি আইসি গুরু!'
মন টেনেছে সেই জ্ঞান হবার পর থেকেই লালনের
গীতে, সুর গেঁথেছে অন্তরে সেই কবে থেকে। এমন কুচকুচে কালো
মেয়ের হিল্লে হলো বলে মা বাপের কাঁধ থেকে বোঝা গেছে সেই ঢের।
আত্মভোলা মেয়েটা পুকুর ঘাটে কলসী ভরে আনতে
গিয়ে,আনমনে গেয়ে উঠে ,
"আমি একদিনও না দেখিলাম তারে...
বাড়ির কাছে আরশিনগর ,একঘর পড়শি বসত করে "
বাড়ির কাছে আরশিনগর ,একঘর পড়শি বসত করে "
চকিতে ঘাটের দিকে নজর পড়ে,
অনতি দূরে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা এক যুবক ! বিমোহিত
হয়ে গীত শুনছে ।চোখ পড়তেই লজ্জায় মাথার আঁচল টেনে দেয়। কপালে সিঁদুর ,হাতে শাঁখা পলা !
যে মেয়ের কণ্ঠে এত দরদ!
সে থাকবে গৃহ বন্দী !
" থামলে কেন কন্যা? তুমি কি জান? স্বয়ং বিধাতা তোমার কণ্ঠে কি সুধা
ঢেলে দিয়েছেন ! "
ভীত হরিণীর মত কাজলকালো চোখে এক নজর তাকিয়ে
কলসী কাঁখে নিজ পথে পা বাড়ালো ।
যুবকের চোখে বিস্ময়! অন্তরে বিষণ্ণতার ছায়া।
যুবকের চোখে বিস্ময়! অন্তরে বিষণ্ণতার ছায়া।
ফিরতি পথে পা বাড়িয়ে পরের চরণ ধরে--
"গেরাম বেড়ে অগাধ পানি
নাই কিনারা নাই তরণী পারে,
বাঞ্ছা করি দেখব তারে
আমি কেমনে সেথা যাই রে।।"
নাই কিনারা নাই তরণী পারে,
বাঞ্ছা করি দেখব তারে
আমি কেমনে সেথা যাই রে।।"
বিমুগ্ধ নয়নে ঘাড় ফিরিয়ে কাজললতা চেয়ে থাকে,
ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় সুর।
বাড়ী ফিরতে দেরী হলো,
স্বামীর ঘর থেকে অপমান আর অত্যাচারের দাগ শরীরে নিয়ে অবশেষে ঘরছাড়া।
গুরুজীর ডাকে সচকিত হয়
!
'এই জগত দেখবি অন্তর দিয়ে, অন্তরের চোখ আর বাহিরের চোখ এক নয়, একথা মনে রাখিস।'
খেয়ে নে মা। খেয়ে নে' ।
লালন অনুসারী গুরুজীর আখড়ায় এই নিশুতি রাতেও
শিষ্যরা জেগে আছে কেউ কেউ।
বড় চেনা কণ্ঠে দরদী গলায় কে যেন গেয়ে ওঠে--
বড় চেনা কণ্ঠে দরদী গলায় কে যেন গেয়ে ওঠে--
"সময় গেলে সাধন হবেনা ,
দিন থাকিতে দিনের সাধন,
কেন জানলে না তুমি !"
দিন থাকিতে দিনের সাধন,
কেন জানলে না তুমি !"