গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৭

মমতা দাস (ভট্টাচার্য)

বিসর্জন


প্রতিমা নিরঞ্জন দেখার কাড়াকাড়ি, হুড়াহুড়িতে মায়ের হাতটা কখন যেন ছেড়ে গেল শেফালির হাত থেকে।বেশ জোরে-ই তো আঁকড়ে ধরে রেখেছিল, তবু ...লোকগুলো যেন পাগল হয়ে যায় এসব ভিড়ে,আরে বাবা সবাই তো দেখতেই এসেছে ! লাভ--ক্ষতির তো কিছু নেই, তবে ? আপন মনে গজ গজ করে আর মাকে খোঁজে শেফু, মা তাকে আদর করে এই নামেই ডাকে ! খুব ভালবাসে মা। কত সামলিয়ে রাখে ! একটা বাজে লোক চোখ তুলতে পারে না তার দিকে,মায়ের ভয়ে । খুব শান্ত মেয়ে শেফু, জানে মা তার ভাল চায় । বাবাটা তো সেই কোন ছেলেবেলায় তাদের দুজনকে ফেলে পালিয়েছিল বাবা। চেহারাটা-ও মনে নেই শেফু-র । তারপর, মা... যেন দশভুজা হয়ে বড় করছে তাকে। দুজনের খাবার, বাড়িভাড়া, ডাক্তার-বদ্যি, তার লেখা-পড়া,অন্য সব ...খরচ তো কম নয় ! মা একা হাতে সামলায়, বাপের বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিল, তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক নাই ! আর বাবার দিকে তো পুরো পরিবারটাই ছন্নছাড়া, তাদের কে দেখে ঠিক নাই ! অতএব শেফু আর মা।কি করে যে পারে মা ? খুব সকালে শেফু স্কুলে  যাওয়ার আগেই মার রান্না, ঘর গোছানো শেস।শেফু উঠলে তার খাবার দিয়ে , নিজে একটু চা খায় মা। জলখাবার অন্য বাড়িতে পাবে, তেমনি ব্যবস্থা ।শেফু স্কুলের রিকশায় উঠলে, ঘরে তালা দিয়ে বেরোয় মা।তিন বাড়িতে ঠিকে আর দুই বাড়িতে রান্নার কাজ করে মা। আগে খুব কষ্ট ছিল,এখন মাইনে-পত্র ভাল । তা ছাড়া মা-র কাজ পরিপাটি, কামাই করে কম।না বলে কামাই তো মোটে নয়......তাই সকলে ভাল বাসে, কেউ মাকে ছাড়তে চায় না।বরংমাইনের উপরে, সাহায্যই করে। শেফুর স্কুলের বই-খাতা এসব তারাই যোগায়, তবেই তো চালাতে পারছে তারা !  নইলে----শেফুকে দু-হাতে আগলে রাখে মা,বলে  'বস্তির লোকরা ভাল নয় শেফু, কথা বলবি , নইলে আবার রেগে গিয়ে ক্ষতি করবে,কিন্তু একদম ঘেঁষতে দিবি না' --সব কথা তো বোঝে না শেফু, কিন্তু কিছু বোঝেও বটে ! ওই যে পুলু কাকু ছিল ওদের ঘর থেকে দুটো ঘর দূরে, কেমন করে যেন তাকায় আর হাসে , আর ওই নান্তুদা টা , এই দুজনকে দেখলে কেমন ভয় ভয় করে যেন ! পুলু কাকুটা গতবছর চলে গেছে, কোথায় নাকি ঘর কিনেছে ! গেছে বাঁচা গেছে,ভেবে বেশ শান্তিতে ছিল তারা মা-মেয়ে, হঠাৎ কদিন আগে স্কুলের রিকশায় দেখে, কত খবর নেওয়া ! রিকশা্কাকু কিছু একটা বুঝে তাড়াতাড়ি রিকশা চালিয়ে দিলে, তবে শান্তি ! শান্তি ? তার দুদিন বাদেই তো পুলুকাকু বাড়িতে হাজীর ! স্কুল থেকে ফিরে দেখে মা-র সঙ্গে কি একটা ঝগড়া হচ্ছে , শেফু বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে শুনছিল মা-র গলা' খবর্দার আমার মেয়ের দিকে নজর দিলে কিন্তু আমি ছাড়ব না,ওর বাপ আর তোমাকঅ,দুজনকেই দেখে নেব।' তখন চলে গেল পুলু, শেফু শুনল 'দ্যাখ তবে কি হয় ! মেয়ে মানুষের এত তেজ ?না যদি ব্দলা নিয়েছি...' মা তখনো গজরাচ্ছে, 'টাকা দেখাচ্ছে ! টাকা কি মেয়ের সমান হয়?বাপটাও তেমনি, কোথায় বাঁচাবে, না মেয়ের নরকের ব্যবস্থা করছে, থুঃ'......মাকে কোনও দিন এত রাগতে দেখেনি শেফু,বাপের সঙ্গে যখন ঝগড়া হত , তখনো না । কি জানি ! মাকে না ঘাঁটিয়ে, চুপ চাপ পোশাক বদলে খাওয়া সেরে,হম ওয়ার্ক করতে বসে । মা বলে দরজা টা বন্ধ করে বস, যে কেউ আসুক , খুলবি না। তোর বাপটা এলেও না। মায়ের কথা শুনে দরজা বন্ধ করে বসে লেখাপড়া করে, কিন্তু একটু আশাও থাকে যদি বাপ আসে! দরজা বন্ধ থাকলেও জানলা দিয়ে একটু দেখা তো যাবে ! না, বাপ আসে নি,অন্য কেউ-ও না । তারকদিন বাদেই তো দুর্গা পূজা । আনন্দ ! ঠাকুর দেখেছে বন্ধুদের সঙ্গে কাছের দুএকটা,কিন্তু দিনে দিনে । সন্ধ্যা বেলা নয় । আজ-ই প্রথম মার সঙ্গে। হঠাৎ চক ভাঙ্গে আরে মাকে তো পাওয়াই যাচ্ছে না ! কি করে ? বারি চলে যাবে? মাত বাড়িতে ফিরবেই ! সন্ধ্যা ঘর হয় নি এখনও ...সংকল্প করে, ঘুরে পা বাড়াতেই,সামনে ......