সত্যপ্রকাশকে
নিয়ে কিছু লেখার আগ্রহ বা ইচ্ছে কিছুই ছিল না , বরং নীলমণিকে নিয়ে কিছু লেখার কথা ভাবছিলাম । নীলমনি মহাতো –
পুরুলিয়ার এক গন্ডগ্রামের আদিবাসী লোকশিল্পী । আমি তখন
রাড় বাংলার লোকগান নিয়ে একটা কাজ করছিলাম , সে কাজেই বাঁকুড়া পুরুলিয়ার গ্রামগুলিতে যেতাম প্রায়ই । তখনই নীলমণির সঙ্গে আলাপ হয় । পুরুলিয়ার রুখা শুখা মাটি থেকে সুর তুলে আনত নীলমনী । ওকে একদিন বলেছিলাম কলকাতায় একদিন
প্রাণভরে তোমার গান শুনবো নীলমনি । নীলমনি বলেছিলো, কলকাতার জলসায় আমি গান গাইবোনা, টাকা দিলেও না । বলেছিল, শহরে ইট কাঠের জঙ্গলে মানুষের প্রাণের মধ্যি কোনো সুর লাই গো দাদা । বলেছিল,
ইদিকটা একতু শান্ত হোলি, এস আমার কুঁড়ে ঘরে বসে তোমায় প্রাণ ভরে গান শুনাবো ।
না,
নীলমণি আর কোনদিন গান শোনাবে না । আজকের কাগজে ছোট করে একটা সংবাদ বেরিয়েছে ,
পুরুলিয়ার লোকসঙ্গীত
শিল্পী নীলমনি মাহাতো খুন হয়েছে,
রাস্তার ধারে তার কন্ঠনালী কাটা লাশটা পাওয়া গেছে । কারা
নীলমণিকে খুন করেছে তার ইঙ্গীতও সংবাদ পত্রটি দিয়েছে । এখন অবশ্য রাস্তার ধারে
খুন হয়ে পড়ে থাকা লাশ কোন দুর্লভ দৃশ্য নয় । বিচলিত আমি ভেবে পাইনা বেঁচে থাকার
জন্য মানুষ আর কত মূল্য দেবে ! কিন্তু নীলমণির এলাকা তো গান, সেই এলাকায় ঢুকতে তো মোটর
সাইকেল চেপে আসতে হয় না !
ঠিক এই সময় আমার সত্যপ্রকাশের ভেতরটা পড়বার ইচ্ছে হলো । ও কি আমার মতই বিচলিত হয়েছে ? নাকি বিচলিত হওয়ার মত মন এখনো ওর আছে !সত্যপ্রকাশ কলকাতার একডাকে চেনা নাট্য ব্যক্তিত্ব , মিডিয়া ইদানিং একটা অলঙ্কার লাগিয়েছে ‘সেলিব্রিটি’ । তা সে আমার বন্ধুও বটে , অন্তত দু বছর আগে পর্যন্ত ছিল । শুনতে পাই এখন সত্যপ্রকাশ আমাকে ‘দালাল’ ছাড়া আর কিছু ভাবেনা , তা ভাবুক, কিন্তু সত্যপ্রকাশের নাট্যবোধ ও অভিনয় দক্ষতার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এখনো অটুট । ইদানিং অবশ্য সত্যপ্রকাশ থিয়েটারে আর সময় দিচ্ছে নয়া, এখন টেলিভিষণে ওর খুব চাহিদা, নানান কারেন্ট এফেয়ার্স ওনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে, মানবাধিকার সংগঠনের মোমবাতি মিছিলেও দেখা যায় সামনের দিকে ।
বছর তিনেক আগে আমিই নীলমণিকে সত্যপ্রকাশের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম । পুরুলিয়ার লোক শিল্পীদের জীবন নিয়ে ‘রুক্ষ মাটির গান’ নামে একটা নাটক করার কথা সত্যপ্রকাশ আমাকে বলেছিল । নাটকটাতে সুর ও গান করার জন্য আমি নীলমণিকে রাজি করিয়েছিলাম । ‘রুক্ষ মাটির গান’ দারুন হিট করেছিল । ও আমাকে বলেছিল যে এই নাটকটাই ওর সচেয়ে সফল প্রযোজনা এবং নীলমণির গানের জন্যই যে সেটা সম্ভব হয়েছল, সত্যপ্রকাশ তাও জানিয়েছিল । সেই নীলমনির খুন হয়ে যাওয়ার খবরটা সত্যপ্রকাশ নিশ্চয়ই পেয়েছে । আমি মনে মনে সত্যপ্রকাশের ভেতরটা পড়ার চেষ্টা করতেই আর একটা দৃশ্য ভেসে এলো – নীলমনির জন্য নাটক ও সঙ্গীত জগতের লোকেরা মোমবাতি মিছিল করছে, আমি মিছিলে সত্যপ্রকাশের মুখটা খুঁজছি তন্নতন্ন করে ।
আচমকা টেলিফোনের তীব্র শব্দে আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল। ফোন তুললাম । অবাক বিস্ময়ে শুনলাম ওপারের কন্ঠ – ‘মণীষ, আমি সত্যপ্রকাশ বলছি’ । আমার গলা দিয়ে আপাতত কোন শব্দ বেরোলো না । প্রায় দু বছর বাদে সত্যপ্রকাশ আমাকে ফোন করছে , ভেবে পেলাম না কি এমন ঘটনা ঘটল যে দালাল হয়ে যাওয়া আমাকে ওর দরকার পড়লো ? ওপারে কন্ঠে একটা আকুতি ‘একবার আসতে পারবি’ ?
আমি ? কি ব্যাপার ? আমি জানতে চাইলাম । ও বললো, তোকে ছাড়া কাউকে বলা যাবে না । আমি বললাম, কিন্তু ব্যাপারটা কি তাতো জানতে হবে । সত্যপ্রকাশের কন্ঠস্বর একটু বিচলিত মনে হল, বললো, ‘হ্যা মানে সেই নীলমণি মাহাতো ...’ । ‘জানি, গতকাল রাত্রে নীলমনি ......’ খুন হয়েছে কথাটা বলার আগেই সত্যপ্রকাশ বললো ‘গতকাল গভীর রাতে নীলমণির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, ও আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করেছিল, আমি উত্তর দিতে পারিনি ।‘
আমার
বিস্ময়ের ঘোর কাটে নয়া, কি বলছে
সত্যপ্রকাশ ? খুন
হওয়ার তারিখে গভীর রাতে নীলমণি সত্যপ্রকাশের সঙ্গে দেখা করেছিল –
এ কি করে সম্ভব ? খবরের কাগজ তো জানিয়েছে নীলমণি রাত্রি দশটা থেকে বারোটার মধ্যে খুন হয়েছে ,
তা ছাড়া এদিন ই তো সত্যপ্রকাশের একটা সম্বর্ধনা অনুষ্টান
ছিল , কোন এক মানবাধিকার সংগঠন ওকে
সম্বর্ধনা দিচ্ছিল । দিনটা রবি বার ছিল , আমি সত্যপ্রকাশের ফ্ল্যাটে গেলাম ।
সত্যপ্রকাশ আমাকে যা বললো তা এই রকম । নীলমণির খুন হওয়ার দিন ওর ঘরে ফিরতে বেশ রাত্রি হয়েছিল । সম্বর্ধনার পর খাওয়া-দাওয়া ছিল,পেটে একটু্ তরল পানীয়ও ঢুকেছিল । গলির মোড়ে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে টলমল পায়ে হাঁটছিল সত্যপ্রকাশ , হঠাত অন্ধকার ফুঁড়ে একটা কালো মত লোক ওর কাছে এগিয়ে এসে বললো - আমি নীলমণি মাহাতো বটে গো দাদা । চিনতে পারছো ? চিনতে পেরে সত্যপ্রকাশ বলেছিল , এত রাতে তুমি এখানে কি করে এলে নীলমণি ? তবে যে কাগজে দেখলাম ......, ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই নীলমনি বলেছিল- ও কথা থাক দাদা, আমি একটা প্রশ্ন শুধোতে এইছিলুম গো । তুমিতো আমাদের ওখেনে মিটিন করতে গ্যাছিলে সেদিন , তা নীলমণি কেমন আছে একটুন খোজ করলেনা কেন গো দাদা ? একজন সুরের কারবারীকে খুন হতে হয় কেন গো দাদা ? সত্যপ্রকাশ চিৎকার করে উঠেছিল ‘তাহলে খবরটা সত্যি ? তুমি ......! নীলমণি বলেছিল ‘ একটুন আগে তুমি যখন মিটিনে পুরুলিয়ার মানুষদের নিয়ে বলছ্যালে – ঠিক তখনই তোমার নাটকের নীলমণি মাহাতোর কন্ঠনালী কাটা লাশটা ওরা রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল । কেন গো দাদা, কোন বিপ্লবের দাম চুকোচ্ছি গো আমরা ?’ সত্যপ্রকাশের আর কিছু মনে ছিলনা । কখন কি ভাবে ঘরে ঢুকেছিল, তাও নয় ।
বিবরনটা শুনে আমি আর একবার ওর ভেতরটা পড়বার চেষ্টা করলাম, কেননা মদের ঘোরে অন্তত নীলমণির কথা্টা ভেবেছিল সত্যপ্রকাশ , নীলমণির খুন হওয়াটা ওর ভেতরটাকে হয়তো কিঞ্চিৎ আলোড়িত করেছে । চলে আসার আগে বললাম, তুমি আবার ‘রুক্ষ মাটির গান’ নাটকটা করো, নীলমণি না থাকুক, তার সুর আর গানগুলোতো আছে ।
পরদিন
সকালে ঘুম ভাঙ্গলো টেলিফোনের শব্দে । ঘুম মাখা চোখে ফোন তুললাম । ওপারের কন্ঠ বল - যাদবপুর
থানা থেকে সার্কেল ইন্সপেক্টর সুজয় বোস বলছি স্যার । শান্ত গলায় বললুম ‘বলুন’
। সুজয় বলল
– ‘প্রবীণ নাট্যকার –
পরিচালক সত্যপ্রকাশ কাল রাত্রে আত্মহত্যা করেছেন,
আপনি একবার আসতে পারবেন স্যার ?
আপনাকে লেখা একটা চিরকূট রেখে গেছেন’
।আমি আধঘন্টার মধ্যে পোঁছে গেলাম
। সত্যপ্রকাশের মুখে গ্যাঁজলা ওঠা নিথর দেহটা পড়ে আছে,
পাশে শূণ্য ঘুমের ওষুধের শিশিটা রয়েছে । সুজয় একটা চিরকূট
বাড়িয়ে দিল । রাত্রি দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে লেখা একফালি কাগজে সত্যপ্রকাশ
লিখেছে ‘মণীষ,
তোর কথাটাই ঠিক , বাঘের পিঠে ওঠাটা সহজ, নামাটা
কঠিন , তাই ...... ‘।