গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৭

অমিতাভ দাস


স্বপ্নের সীমানা

গাড়ি আর সামনে এগুবে না । বললে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন । দেখে বোঝা গেল স্থানীয় । কারণ জিজ্ঞেস করলাম ।বললে , বরফ পড়ছে ।রাস্তা বন্ধ । সাফাই হচ্ছে । 
একথা অবিশ্যি গাড়ির ড্রাইভার সমর সিং বলেছিল । দুপুর থেকেই আকাশের মুখ ভার । তবু নতুনকে দেখবার আকাঙ্খায় বেরিয়ে পড়েছি । এখন ঘড়িতে প্রায় ছটা বাজে ।হোটেল
 ছেড়েছি বেলা তিনটের সময় ।আর মাত্র ঘন্টা দুয়েকের পথ । তারপর আমাদের পেলিং  পৌঁছানোর কথা ।
আমাদের সঙ্গে আছে
  আমাদের একজন ব্যাচেলর বন্ধু সুধাংশু । আরেকটি পরিবার মিস্টার দত্তের । তিনি আমাদের স্কুলের ভূগোল শিক্ষক । ভ্রমণ-পিপাসু । আমাদের বেশ সিনিয়র । তাঁর ছেলে এবার  মাধ্যমিক দিলো । সে সুধাংশুর সঙ্গে বেশ জমে গেছে ।
মিস্টার দত্তের এসব অভিজ্ঞতা আগে হয়েছে । তাই বললে , মানস ঘন্টা খানেক বসে থাকো । বা একটু ঘুমিয়ে নাও । সব ঠিক হয়ে যাবে ।
দেখি সুধাংশু আর সৌগত ,মানে মিস্টার দত্তের ছেলে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করেছে সামনের দিকে ।
মৌমিতা
 আমার পাশে বসা । সে একটু ঘামছে যেন । ওর তুঁতে রঙের শাড়িটার দিকে বারবার আমার চোখ চলে যাচ্ছে । কী চমৎকার লাগছে ওকে !
আমাদের পেছনে আরো কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে । একদিকে গভীর পাহাড় অন্যদিকে খাঁদ ।যদিও রেলিং দেওয়া ।তবুও তাকালে পিলে চমকে যাবে ।
.
হাঁটতে হাঁটতে আমরা অনেকটা পথ চলে এসেছি ।দু'চার জন লোককে ছাপিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি । জানতে চাইছি আর কতক্ষণ লাগবে ? কেউ সঠিক কথা বলতেই পারে না । এগিয়ে তো যাচ্ছি ,বরফ কাটা হচ্ছে কোথায় ? পথ তো বেশ সাফ-সুতরা ,তাহলে ?
আমার বা-দিকে আঙুল ধরে এগিয়ে যাচ্ছে মৌমিতা । কিছু দূর যাবার পর দেখি একটা সাহেব মতন লোক তাঁর কুকুর টাকে
 চেন দিয়েও টেনে রাখতে পারছে না ।কুকুরটা কেমন যেন উত্তেজিত । চারপাশের লোকজন বেশ ভয় পেয়েছে । কুকুরটা ছুটে আসছে ।পেছনে  কুকুরের মালিক ।এ বাবা কুকুরটা যে আমাদের দিকেই আসছে !
মৌমিতা ভয় পেল ।সে শক্ত করে ধরে আছে আমার আঙুল । এক সময় জামা খামচে ধরলে ।ভয় পেয়েছে । কুকুরটা ছুটে আসছে । সত্যিই তো আমাদের দিকেই
  আসছে দেখছি ।মৌমিতা বললে চলো , গাড়িতে ফিরে যাই । আমার ভয় করছে ।
আমরা ফিরে আসি । দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ।
 
পাহাড়ী রাস্তা । নির্জন হয়েছে । সরু পথ । চারপাশে ঘন বন ।আমি আর মৌমিতা হেঁটে আসছি । চারিদিকে কেউ নেই ।আমি তাকিয়ে আছি মৌমিতার
 দিকে । মৌমিতাও আমার দিকে ।ওর তুঁতে  রঙের শাড়িটার ওপর কালো রঙের মোটা উলের সোয়েটার ।এই নির্জন পাহাড়ী সরু পথে চাঁদের আলোয় সে আরো সৌন্দর্যময়ী হয়ে উঠেছে । 
আমি ডান হাত দিয়ে মৌমিতাকে জড়িয়ে ধরলাম । সেও আমাকে ।এতটুকু চমকাল না ।মৌমিতা আমার
 ডান হাতে এলিয়ে পড়েছে ,ওর ঠোঁটে আমার ঠোঁট ।সে যেন আবেশে চোখ বুজে ফেলেছে । চাঁদ থেকে চুঁইয়ে আসা আলো দীর্ঘ গাছগুলি ভেদ করে ওর মুখে এসে পড়েছে ।
হঠাত্ খেয়াল হল আমরা কোথায় । চারিদিকে গাছ আর গাছ । এ পথ তো চিনি না । এ তো গাছের জঙ্গল ।
 
ভয় করতে লাগল । মৌমিতা বললে ,আমরা কোথায় --কোথায় আমাদের গাড়ি ?
--আমরা পথ হারিয়েছি ।বলতেই ডুকরে কেঁদে উঠল মৌমিতা ।
আমি ওর হাত শক্ত করে ধরে ওপরের দিকে দৌড়তে লাগলাম ।অথচ খুব কষ্ট হচ্ছে ।পা হড়কে নীচে পড়ে যাচ্ছি । পেছন থেকে একটা হাত আমার জামার কলার টেনে ধরলে ।
.
.
ভায়া স্বপ্ন দেখছিলে নাকি ?
--কে ? কে ?
খেয়েছে
 ।আমাকে চিনতে পারছো না মানস  ? ভালোই এক চোট ঘুম লাগালে দুজনে । বললে মিস্টার দত্ত
 
এতক্ষনে বুঝলাম আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম ।দেখি পাশে মৌমিতা শক্ত করে আমার হাত ধরে ঘুমিয়ে
 আছে ।
পেছন থেকে দত্ত বৌদি বললে ,ঠাকুর পো তোমার বৌটিকে এবার ডেকে দাও ।
সত্যিই তো কী বিচ্ছিরি কান্ড ! আমরা যে পেলিং পৌঁছে গেছি । কখন যে বরফ সাফ হল আর কখন আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করল জানতেও পারলাম না ।
মিস্টার দত্ত বললে , বিয়ে করলে প্রথম প্রথম
  এমনটাই হয় । চলো চলো এবার হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হতে হবে ।
.
.
সকালে ঘুম ভাঙল সুধাংশু আর মিস্টার দত্তের দরজা ধাক্কার আওয়াজে ।
 
সূর্য তখনো ওঠেনি । উঠব উঠব করছে । জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম পাহাড়ের চূড়ায়
 জমাট বেঁধে আছে মেঘ । আমরা অপেক্ষা করছি কখন মেঘের নেকাব  খুলে বেরিয়ে আসবে সূর্য ।
মিস্টার দত্তের গলায় ক্যামেরা । তাঁর ছেলের হাতেও একটি ক্যামেরা ।
 
ইতিমধ্যে তৈরী হয়ে নিয়েছে মৌমিতা । আমিও পাঁচ মিনিটে তৈরী হয়ে বেরিয়ে পাঁচ তলার হোটেলের ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম ।
আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকে আকাশের রঙ । পাহাড় শিখরে কে যেন কমলা একটা মুকুট পরিয়েছে । মৌমিতার মুখে হাসি । নেচে উঠল ঁর চোখ ,ওর ঠোঁট
 
।মৌমিতার দিকে তাকিয়ে আছি । মৌমিতাও আমার দিকে ।
পাশ থেকে আড় চোখে তাকাল মিস্টার দত্ত । প্রথম প্রথম এই রকম হয় । ভায়া ,এবার একটু পাহাড়-চূড়ায় তাকাও । ওই দ্যাখো , ওইটে হল কাঞ্চনজঙ্ঘা ।
--আহা , কী উঁচু তাইনা ! অপরূপ সুন্দর ।বললে মৌমিতা ।
সারাদিন মেঘলা আকাশ । সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি । বাইরে যাওয়ার উপায় নেই । হোটেলের ম্যানেজার বললে , যে কোনো সময়ে বৃষ্টি  থেমে যেতে পারে আবার নাও থামতে পারে । 
আমাদের হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে ।আমরা স্থির করলাম আজ আর বেরুবো না ।হোটেলেই জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে । আড্ডার উপকরণ ও উপযুক্ত পরিবেশ তো তৈরী ।
 
সুধাংশু গল্পকার । ও আমাদের গল্প শোনাল । মিস্টার দত্ত প্রচুর বেড়িয়েছেন ।ফলে তাঁর মুখ থেকে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা শোনা
 অন্য এক পাওয়া । মৌমিতা খোঁজ নিচ্ছিল কীভাবে সে বাবা-মাকে নিয়ে কেদার-বদ্রী যাবে ? কোন সময়ে যাবে ইত্যাদি । 
সৌগত শোনালে আবৃত্তি । বনলতা সেন ,হঠাত্ দেখা শুনতে শুনতে আমার কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল ।
 
দত্ত বৌদি একটা গান ধরলে , আমারো পরাণ যাহা চায় তুমি তাই...গলা মেলাল মৌমিতা ।
 
গাইতে গাইতে সে আমার দিকে চাইল । এইটে দৃষ্টি এড়াল না মিস্টার দত্তের ।তিনি আবার বলে উঠলেন ,প্রথম প্রথম এই রকম হয় ।
আমি থাকতে না পেরে বললাম ,
 আচ্ছা দাদা প্রথম প্রথম আর কী কী হয় ?
হাসতে হাসতে তিনি বললেন ,বলব বলব ,ধৈর্য ধরো ভায়া ।
বৃষ্টি থামছেই না । শীতটাও বেশ বেশী । এত ঠান্ডা আমার আবার পছন্দ নয় ।তবে বৃষ্টিটা চমত্কার লাগছে ।

গত রাতেই মিস্টার দত্ত জানিয়েছিলেন আজ আমদের  কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাত ,গেজিং রক গার্ডেনস আর খেচুপেরিতে নিয়ে যাবেন । কথা মত সকালেই ব্রেকফাস্ট সেরে নটায় আমরা বেরিয়ে পড়ি ।
আকাশ আজ পরিস্কার । আমরা খেচুপেরিতে প্রবেশ পত্র নিয়ে ঢুকে পড়লাম । আহা ,কী অপার সৌন্দর্য । প্রথমেই ছোট্ট এক বৌদ্ধ মন্দির । বাইরে থেকে দেখলাম মন্ত্রখোদিত ঘূণায়মান গোলকটি । সেটা স্পর্শ করে আমরা এগিয়ে গেলাম ।
আরেকটু এগোতেই বনজ শোভায় আমরা মুগ্ধ । মৌমিতার চোখে শিশুর মত আনন্দ ঝরে পড়ছে । সে এই প্রথম পাহাড়ে এলো ।
চারিদিকে সবুজের ঘন গাছগাছালিতে ভরা । অদূরে পাথরের গায়ে কাঁচা হাতে লেখা'লাভ মাদার নেচার ।' প্রকৃতির কাছে এলে সকলেই বুঝি সুন্দর হয়ে ওঠে । সুধাংশু আর সৌগত ছবি তুলছে । দত্ত দম্পতিকেও কাছাকাছি দেখছি না । 
হাঁটতে হাঁটতে একটা লেকের কাছে আমরা । একে নাকি অনেকে ইচ্ছাপূরণ লেক বলে । অনেকের অনেক ইচ্ছা নাকি পূরণ হয় । চারপাশে কেউ নেই । থাকলেও দেখা যাচ্ছে না । আকাশে আবার মেঘ জমছে ।
আমরা একটা পাথরের ওপর বসি । কাছাকাছি কেউ নেই বলে আমি মৌমিতার ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রাখি । মৌমিতা আরো কাছে ঘেঁষে বসে । বলে , বিয়ে করবে ?
-মানে ! চমকে উঠি ।আমি তো বিয়ে করতেই চেয়েছি এতকাল ।
 মৌমিতা চায় নি । সে সাংসারিক জটিলতায় জড়াতে চায়নি । সে লিভ ইনে বিশ্বাসী । সবাই জানে আমরা বিবাহিত ।হানিমুনে এসেছি ।আসলে তা তো নয় । বললাম , হঠাত্ বিয়ে করতে চাইছ যে...
--ইচ্ছে করছে খুব ।বলে আমার বুকে মাথা রাখল ।
.
হঠাত্ একটা কুকুরের ডাকে চমকে উঠি আমরা । ঐ তো একটা কুকুর ছুটে আসছে এদিকে । পেছনে সাহেব মতন লম্বা একটা লোক , চেন হাতে কুকুরটার পিছু পিছু দৌড়ে এদিকেই তো আসছে ।
 আকস্মিক ঘটনায় ভয় পেয়ে আমাকে  শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মৌমিতা ।