গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৭

তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক

জবলপুর, হান্টেড কাহিনী—১৩

অপঘাত মৃত্যু


গ্রামের নাম ভুবয়ারা। জবলপুর থেকে প্রায় ৪০ কি.মি. দূরে হবে। ভূতের ভয়ে এখানকার লোক অতিষ্ঠ হয়ে আছে। সারাদিন ওরা ভালো থাকে, এমন কি রাত বারটা পর্যন্ত কোন ভয়ের ব্যাপার নেই। যেই না রাত বারটা বাজলো অমনি শুরু হল চীৎকার। চীৎকার করে কাঁদতে শোনা যায় কিন্তু কাউকে দেখা যায় না। কোন বুড় মানুষের গলার যেন এ কান্না। কখনও কাঁপা কাঁপা সুরের কান্না শোনা যেত। প্রতিরাতে থেকে থেকে প্রায় ঘণ্টা খানেক সে কান্না চলতে থাকে।   
এই গ্রামেরই লোক ছিল উমাপদ। উমাপদ যাদব। বয়েস সত্তরের কাছাকাছি হয়েছিল। ছোটখাটো ব্যবসায় তার দিন গুজার হত। তাতে তার পরিবারের ভরণপোষণ ভাল ভাবেই চলে যাচ্ছিলো। বলতে গেলে সারা জীবন ব্যবসা ছেড়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়া আর তার হয়ে ওঠেনি। উমাপদর স্ত্রী বহুবার বলেছে, কি গো বয়েস তো হল এবার কিছু দিন কোথাও থেকে ঘুরে আসলে ভাল হয় না ?
ছেলে মেয়েরাও বাবাকে ঘুরতে যাওয়ার কথা অনেকবার বলেছে কিন্তু কে কার কথা শোনে ! আসলে উমাপদও তার বিজনেস নিয়ে বড় ব্যস্ত থাকে। সবাই জানে বিজনেসে তেমন করে ছুটি নেওয়া যায় না। আর ছুটি নেওয়া মানেই হল কিছুটা লোকসান দেওয়া। তবু কিছুদিন ধরে উমাপদর কেন যেন মনে মনে ভক্তি ভাব জাগছিল। মনে হচ্ছিলো, একবার হরিদ্বার ঘুরে এলে কেমন হয় ? সারা জীবন তো কাজের মধ্যেই তার কেটে গেল। আর তা ছাড়া স্ত্রী ছেলে মেয়েরাও কবে থেকে বলছে যাবার জন্যে। শেষ পর্যন্ত উমাপদ স্ত্রী ছেলে মেয়েকে তার মনের কথা জানিয়েই দিল। সবাই আনন্দিত, কিছুদিনের মধ্যেই উমাপদ সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল হরিদ্বারের দিকে। হরিদ্বারে পৌঁছে ভালই লাগল সবার। সেখানে অনেক ঘোরা-ফেরা করল। মন্দির দর্শন করল। গঙ্গায় স্নান হল। হরিদ্বার থেকে হৃষীকেশ গেল। বেশ আনন্দেই দিন কতক কেটে গেলো।
এবার ফেরার পালা। হৃষীকেশ থেকে হরিদ্বার আর সেখান থেকেই ট্রেনে নিজের গ্রাম ভুবয়ারার দিকে রওনা দিতে হবে। ঠিক হয়ে ছিল হৃষীকেশ থেকে রাত  এগারটায় রওনা দিয়ে পৌঁছবে হরিদ্বারে আর সেখান থেকে শেষ রাতের ট্রেন ধরবে। পনের কিলোমিটারের রাস্তা আর এমন কিছু ছিল না। শেষ পর্যন্ত এক অটোতে একটু চাপাচাপি করেই ওরা রওনা হল। বাঁধ সাধল অটো ড্রাইভারটা। বেটা রাতে এতো মদ গিলবে কে জানে ! খুব স্পীডে চালাচ্ছিল সে। উমাপদ তাকে স্পীড কমাতে বললে সে আরও বেশী স্পীডে চালাচ্ছে। আর এভাবেই সেদিন ঘটে গেলো উমাপদর জীবনের সবচে বড় দুর্ঘটনা। হঠাৎ অটো এক ব্রিজে গিয়ে ধাক্কা খেল, আর ছিটকে গিয়ে পড়লো প্রায় ১০০০ফিট তলায়। সক্ত এবড়ো খেবড়ো পাথরের ওপর ওরা সবাই ভয়ংকর ভাবে আছড়ে পড়ল। ব্যাস এখানেই সব কিছু সাঙ্গ হয়ে গেল। ড্রাইভার সহ উমাপদ ও তার পরিবারের সবার এ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল। জীবিতের কাহিনী এখানেই শেষ হয়ে গেলো। শুরু হল অন্য আর এক অধ্যায়।
গ্রামের লোকজন তখন জানে না যে উমাপদর সপরিবারে মারা গেছে। একদিন মাঝ রাতে ওরা শুনতে পেলো, ওদের গ্রামের উমাপদর বাড়ির ধারে কেউ যেন জোরে জোরে কেঁদে যাচ্ছে। বেশ জোরে হচ্ছিল সে কান্নার আওয়াজ। গ্রামের বেশ কিছু লোকের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল, ওরা শুনতে পেয়েছে সে রাতের কান্না। তারপর থেকে প্রতিদিনই গ্রামের লোকেরা রাত বারটায় উমাপদর কান্নার চীৎকার শুনতে পায়। কেউ কেউ সে কান্নার উৎস দেখতে গেছে, পরীক্ষা করতে গেছে তারা কিন্তু তারা বাস্তব কোন অস্তিত্বই খুঁজে পায়নি।
ভিলেজের একজনের নাম, চন্দ্র সিংহ। সে বেশ ভালভাবে ভৌতিক অস্তিত্বের ব্যাপারটা পরখ করে নিতে চেয়ে ছিল। এমন কি সত্যি কিছু হলে প্রয়োজন হলে ওঝার ব্যবস্থাও করবে জানিয়েছিল। গ্রামের কমিটি তাকে সহায়তা করবে বলে কথাও দিয়েছিল, কিন্তু একদিন সেই চন্দ্র সিংহকে মাঠের মাঝে পড়ে থাকতে দেখা গেলো। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। অনেক চিকিৎসার পর সে সুস্থ হয়ে উঠল।  সে বলে ছিল, সেদিন আমি চীৎকার শুনে ছুটে যাই, এক সময় মনে হয় আমার পাশ থেকেই সে চীৎকারের শব্দ আসছে। আমি চীৎকার করে কে ? কে ?  বলে ডেকে উঠেছি। আর হঠাৎ দেখি আমায় কেউ আলতো করে তুলে নিয়েছে, আমি কিছুই অনুভব করতে পারছিলাম না, শুধু কালো মানুষের আকৃতির একটা দীর্ঘ অস্পষ্ট ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম। এর মধ্যে আমায় সে ছায়াটা বেশ কিছুটা উপরে তুলে কিছুটা দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়েছে। পড়ে গিয়ে আমি তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ছিলাম।
এ গল্প শুনে আপনাদের মধ্যে কেউ যদি সেই গ্রাম ভিজিট করে দেখতে আগ্রহী হন, তবে সতর্ক করব, বলবো, যাবার আগে আরও একবার অন্তত ভেবে দেখে নেবেন।