গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৭

নীহার চক্রবর্তী

মন-দোল


সবুজ সেবারও মাধ্যমিকে পাস করেনি ।
অথচ দেখে বোঝার উপায় নেই । ওর বাবা-মায়ের হতাশা দেখার পর ওর সঙ্গে পথে দেখা হল ।
 
বিষণ্ণ-মনে জিজ্ঞেস করলাম,''এবার কত ছেলে পাস করল । আর তুই কিনা...''
 
কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ওর ।
প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক হাসি ছড়িয়ে বলল, ''কি আর বলি । এবারও হল না ।''
 
আমি ওকে জানালাম,''তোর বাবা কিন্তু বলেছে আর পড়াবে না ।''
 
এবারও দেখলাম বে-পরোয়া ভাব ওর ।
 
সবুজ দূরের আকাশে উড়ন্ত ঘুড়িটা লক্ষ্য করতে করতে বলল, ''ও আচ্ছা অনেক পড়া হল ।''
 
আমি হাসব, না কাঁদব বুঝতে পারলাম না ।
ঠিক পরেরদিন সবুজকে দেখলাম একটা ভোঁ-কাট্টা ঘুড়ির পেছনে ছুটছে । 
এত গতি যে পড়েও যেতে পারে । ওর পেছনে দুটো বাচ্চা ছেলে ঢিলে প্যান্ট তুলতে তুলতে ছুটে যাচ্ছে । বেশী দূর ওকে যেতে হল না । ঘুড়িটা একটা লাইট-পোস্টের মাথায় আটকে গেল । অনেকক্ষণ মাজায় হাত দিয়ে সবুজ দাঁড়িয়ে থাকল ।
 
শুনলাম ও বাচ্চা দুটোকে বলছে,''ঝড়-বৃষ্টি না হলে আমি পেরে আনব ঘুড়িটা ।''
 
আমি আঁতকে ঊঠলাম ।
 
কাছে ডেকে বললাম,''খবরদার,এগারো হাজার ভোল্ট ।''
 
কি বুঝল কে জানে । ছোট বন্ধুদের সঙ্গে ঘুড়ির গল্প করতে করতে চলে গেল ।
এই ঘটনার পরের দিন আমি বাবার ব্যবসায়িক কাজে কয়েকদিনের জন্য বাইরে যাই । মনের মধ্যে একটা ভয় ছিলই । যাবার আগে সবুজের বাবাকে সতর্ক ক'রে যাই । এমন বাউল-ছেলে আর একটি দেখিনি আমি ।
ফিরে এলাম কাজের শেষে । 
বেশ ভয় ছিল । ট্রেন থেকে সবুজের এক বাচ্চা বন্ধুর সঙ্গে দেখা। সবুজ সম্বন্ধে জানতে চাইলাম ।
ও চোখ বড় বড় ক'রে বলল, ''সবুজদাদা তো বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে ।''
 
আমি অবাক হলাম শুনে । বাড়িতে না ঢুকে সবুজদের বাড়িতে আগে গেলাম ।
 
বিষণ্ণ সবুজের বাবা জানাল, ''ছেলেটা যে কোথায় গেল, খুঁজে খুঁজে হয়রান । তুমি এসে পড়েছ ভালো হয়েছে । একটু দেখো ।''
 
আমি আশ্বস্ত ক'রে ফিরে এলাম । আসার পথে দেখি সেই লাইট-পোস্টে ঘুড়িটা ন্যাতার মতো ঝুলছে ।
আমাদের গ্রামের থেকে আট মাইল দূরে শিবানন্দপুর । 
বাবার এক মহাজনের বাড়িতে যেতে হ'ল দুই-একদিন পর । সেখানে সেদিন ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা ছিল । একটা বড় মাঠে বহু মানুষ মিলিত হয় । সেখানেই প্রতিযোগিতাটা হয় । একটু দূর থেকে দেখলাম একটা ছেলের হাতে বেশ কিছু ঘুড়ি । ছুটে বেড়াচ্ছে একবার এদিক, একবার ওদিক । আমি এগিয়ে যেতেই অবাক হ'লাম । এ যে আমাদের সবুজ ! এখানে কী ক'রে এল ও ? আমাকে দেখে একচোট হেসে নিল ও । কিন্তু সঙ্কোচের বালাই নেই ।
আমি সবুজকে বললাম, তুই এখানে ? আর তোর বাড়ির সবাই তোর খোঁজে পাগল । তোর মাকে খুব কাঁদতে দেখে এলাম ।'' 
 ভোঁ-কাট্টা ব'লে মহানন্দে সবুজ ছুটে গেল । এ কেমন ছেলেরে বাবা ! তবে আবার কাছে এল ।
সবুজ শুরু করল, ''আরে কাকু, আমি তো এখানে এসেছি প্রতিযোগিতায় । কাল শেষ হবে । পরশু দিন বাড়ি যাব । মাকে ব'লে দিও ।''
 
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ''তোর এখানে কী লাভ,শুনি ?"
 
সবুজ অনাবিল হেসে জানাল,''প্রচুর ঘুড়ি পাব । বন্ধুদের জন্য নিয়ে যাব । কি মজা, না ব'?'
কথামতো সবুজ ফিরে এল সারাদেহ হলুদ হয়ে সেদিনই । 
শোনা গেল, গাছের মগডাল থেকে ঘুড়ি নামাতে গিয়ে সে পড়ে গিয়ে মারা যায় । গ্রাম-জুড়ে শোকের পরিবেশ । আমি সবুজের বাবা-মাকে কীভাবে আর সান্ত্বনা দিই । আমিও তখন হাপুস নয়নে কাঁদছি ।
পরেরদিন কিন্তু সেই লাইট-পোস্টে ঝোলা ঘুড়িটা আর দেখা গেল না ।