ঘুঁটে বানানো গোবর কুড়ানি মেয়েটা পদ্মবিলের ধারে কাছেই চরে বেড়ায়
সারাদিন। কাজলি ধবলীরা গোবর দেয় , পদ্মপাতায় জমা
রাখে কুড়ানি মেয়ে। ক্ষুধায় পেট জ্বলে উঠলে পুরাণো পদ্মের ঘোট খুলে বিচি খায়।
ঘোটগুলো কচরমচর খেয়ে ফেলে কাজলি ধবলী। কখনো বিলের জলে ইরি আটাশের ভাজা চাল গামছায়
বেঁধে চুবিয়ে রাখে। ভিজে ফুলে উঠলে কাঁচা মরিচ ভেঙ্গে এ গাল ওগাল করে আস্তে আস্তে
লালা মিশিয়ে খেয়ে নেয়। ও জানে যত আস্তে খাবে তত আস্তে আস্তে শেষ হবে খাবার । মাঝে
মাঝে যকু দারোগা পেতল বাঁধানো লাঠি দেখিয়ে হুঁসিয়ার করে দেয়, অই ফুল ছিঁড়লি কিন্তুক ---- ফুল ও ছেঁড়ে না ।
তবে কোনো কোনো ভাইয়া আপু বেড়াতে আসে এখানে। তারা ফুল ছিঁড়ে ওকে পাঁচ দশ টাকা দিয়ে
যায়। সেই টাকায় ও সালু মুদির দোকান থেকে এটাসেটা কিনে খায়।
ওরা
থাকে যকু দারোগার পুরোন বাড়ির ভাঙা ঘরে। নতুন বাড়িতে দালান ঘর তুলে চলে গেছে যকু
দারোগারা। মাঝে মাঝে কুড়ানির মার কাছে আসে । মাগরিবের আজান শেষে যখন প্রকৃতি থির
ধরে থাকে সেই সময় মসজিদ ফেরত যকু দারোগা এসে বলে, কেমন আছিস কেংকু? ওরা মায়ে ঝিয়ে তখন ঘুঁটে
তুলছে। মার একহাত বাঁকা বলে গ্রামের কেউ কেউ কেংকু বলে ডাকে। শেষ রোদ্দুরের গন্ধ
ভাসা উঠোনের জামরুলগাছের নিচে যকু দারোগাকে তখন জিনের মত লাগে। কুড়ানির মনে হয়
কোনো জিন মাথায় টুপি, সোনালি রঙ চশমা আর শাদা পাজামা
পাঞ্জাবি পরে
যকু দারোগার চেহারা নিয়ে নেমে এসেছে জামরুলগাছ থেকে।
মা মাথায় ঘোমটা টেনে দেয়, ভাল
আছি ভাইজান। পিতলের লাঠিটা ঘরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে যকু দারোগা বলে, ভালো আছিস। তা বেশ! চল তো ঘরে চল, দেখি কেমন ভাল আছিস। কুড়ানি তখন একা উঠোনে ঘুঁটে তোলে। দু একটা আধকাঁচা জামরুলপাতা পড়ে
থাকে উঠোনে। কাজলি ধবলি ঘুঁটে ঘরের চিলতে বারান্দায় বসে ডুবে যাওয়া সূর্য দেখে।
ওদের চোখ ম্লান, ভেজা। ঘুঁটে তোলা শেষ হলে
কুড়ানি গিয়ে বসে থাকে কাজলি ধবলির পাশে। লাল রঙ ছড়িয়ে ডুবে যাচ্ছে সূর্য। মা
বলেছিল, চাল ডাল আনিছি রে কুসুম। তোরে আজকে খেচোড়ি করি
দিবানি। কুসুম খুশিতে লাফিয়ে উঠতেই মা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলেছিল, ডিম ভাজি দে খেচোড়ি খাতি কেমন লাগে রে কুসুমরাণি ? কুড়ানি জানে মা এতক্ষণ ভাল ছিল। এবার খারাপ থাকবে, থু থু ফেলবে হাজারবার। রান্নাঘরে ঢুকবেও না। এরপর চলে যাবে কুমোরপাড়া।
সুবলকাকার দু একটা কাঁচা হাঁড়ি ভাঙবে। কতক্ষণ খিস্তি করবে। কাকা তুলি রেখে বলবে,
আয় ক্ষেপি। কাছে এসে বস তো দেখি! এত
ক্ষেপিছিস ক্যান !
কুড়ানির মা তখন কিচ্ছু বলতে পারবে না। কেবল মার খাওয়া কাজলি ধবলির মত অবোধ
চোখে জল নিয়ে চেয়ে থাকবে। সুবলকাকা একহাতে মার হাত জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে বুলিয়ে দেবে
আদর। আর তখন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলবে মা। প্রকৃতি নড়েচড়ে জেগে উঠবে। ঘরের পেছনের
বাবলা গাছ থেকে হুশ করে ধেয়ে আসবে বাতাস। সুবলকাকার বুড়ি কাকি,
বাতের ব্যাথায় প্রায় অচল, মাকে দেখে ডাক
দেবে, ও সুফি সুফিরে এড্ডু ধর দিকিনি মা। আলোডা জ্বালি
দিয়ি আসি।
কোনো
কোনো দিন কুড়ানিও চলে আসে মার সাথে। সুবলকাকা ওকে বুকের কাছে ধরে রাখে। কিযে ভাল
লাগে তখন । সন্ধ্যা উতরে গেলে এ শাক ও শাক, কচুর
গোট, লতির তরকারির ঘ্যাট আর একটা ডিম চার ভাগ করে চারজনে
খেয়ে বসে থাকে বারান্দায়। সুবলকাকা গান ধরে, দোলা,
হে দোলা, হে দোলা, হে দোলা আঁকাবাঁকা পথে মোরা কাঁধে নিয়ে ছুটে যাই-- বুড়ি কাকি খুনখুন করে কাঁদে, চেরডা কাল এমনি
গেলো ! এমনি কাটিছে রাতদিন! ত্যাল
আছে ত নুন নাই, নুন আছে ত পিন্দনের কাপুড় নাই---
অনেক
রাতে সুবলকাকার বুকের ভেতর থেকে ঘুমন্ত কুড়ানিকে ছিনিয়ে নিয়ে সুফি হিসহিস করে,
কইছিলা দিন আসপে, আসপেই। আর আসিছে।
মিথ্যুক কোহানকার!
সুবলকাকা
উধাও হয়ে যায়। যকু দারোগার লাঠি সুবলকাকাদের উঠোনে ঝলকে উঠে,
শালার কুমোরপাড়াই শ্মশান করে দেবো। চুতিয়া হারামির জাত। বন্ধুর
বউয়ের সাথে আশনাই করো শালা। মুসলমানের দ্যাশে বসি মুর্তি গড়ি ভাত খাও, চেনো না আমারে!
এগিয়ে
আসে জালাল মাষ্টার, চাচা ইডা কি কলেন আপনি
? তুই থাম । এই ঘটনা ইন্ডিয়াতে হলি দুডোরেই পোড়াইয়ে মারত
। খবর পাস না বুঝি ? জালাল মাষ্টার একটু দমকা খায়। অশত্থের
পাতার মত সুন্দর মুখ কেঁপে উঠে উত্তরের বাতাসে। সুবল পালের বুড়ি কাকির হাত ধরে
দাওয়ায় বসিয়ে ফিরে আসে, ধর্ম ধর্ম করি মেলা অধর্মের খেলা
খেলিছেন আপনারা । এবার থামেন কলাম চাচা।
যকু
দারোগার দৃষ্টি পিছল খায়। তার ঘরেই বিভীষণ! নাকি
সুবল পাল !