[১]
সবুজ গালিচায় মোড়া ছোট্ট একটি গ্রাম, প্রচলিত আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে আজও দিব্যি সরিয়ে রেখেছে নিজেকে। সোনালী ধানক্ষেত, শ্যাওলা-ধরা পুকুর, শাপলা ও পানকৌড়ি, ছাউনি-ঘেরা মাটির ঘর, ঘন জঙ্গল, সন্ধ্যেবেলা টিমটিমে লণ্ঠনের আলো ও ছিমছাম তুলসীমঞ্চ— কেমন যেন মায়াবী হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে কুসুমগড়। গ্রামের ঠিক ধার ঘেঁষে চলে গেছে রেললাইন, দিবারাত্র দূরপাল্লার ট্রেন যাওয়ার বিরাম নেই যেন। তিন্নির বড় ভাল লাগে ট্রেনের হুইসেলের আওয়াজখানা, সুযোগ পেলেই দৌড়ে ট্রেন দেখতে চলে আসে, সুদূর যে বড় টানে ওকে।
“বাবা আমরা
কলকাতায় কবে যাবো?”, তিন্নি পাগল করে দেয় নিবারণকে বারবার।
কত চিন্তা নিবারণের মাথায়, ঠিকঠাক ফসল ফলছে কিনা, লাঙল চষাটা উপযুক্ত হলো কিনা, এবছর অতিবৃষ্টি হবে
কিনা, তাই সে ধমকে চুপ করিয়ে দেয় মেয়েকে। একবার অবশ্য গিয়েছিল
তারা কলকাতা, তিন্নির বয়স তখন মাত্র বছর পাঁচেক, দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসস্থান যে ওখানেই। মহানগরীর আবছা কিছু স্মৃতি
আজও গেঁথে আছে তিন্নির মনে। সেই বড় একখানা ব্রিজ, বয়ে চলা
গঙ্গা নদী, আলো ঝলমলে বড় বড় অট্টালিকা, চওড়া রাস্তায় পিলপিল করে হেঁটে যাওয়া অসংখ্য মানুষ ও দ্রুতগতিতে ছুটে যাওয়া
যানবাহন— তিন্নির বড় ইচ্ছে করে ট্রেনে করে কলকাতা চলে যেতে।
কুসুমগড়
মোটেই আকর্ষণ করে না ওকে, তিন্নি খালি স্বপ্ন দেখে
আচমকা এক বিকেলে দূরপাল্লার কোন ট্রেন এসে থামবে ওদের ছোট্ট ছিমছাম স্টেশনটায়,
বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে গটগট করে নেমে আসবে কলকাতাবাসী কোন সুপুরুষ রাজকুমার,
ওর দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকবে সে। আর থাকবে নাই বা কেন? বছর চোদ্দ’র তিন্নি কি কম সুন্দরী নাকি?
কালো মেঘের মতো একঢাল চুল, সোনার বরণ অঙ্গ,
টানা টানা দুখানি চোখ, বাঁকা ধনুর মতো ভ্রু—
গ্রামের আর ক’টা মেয়েরই বা আছে শুনি?
রাজকুমার বেশ ধুমধাম করে ওকে বিয়ে করে নিয়ে সুদূর কলকাতায়,
তিন্নির স্বপ্নের শহরে রওনা দেবে। গল্পে তো এমনটা কতই হয়,
তিন্নির জীবনে কি ঘটতে পারে না এমন? ভেবে
ভেবে আকুল হয়ে যায় তিন্নি, কিন্তু সেই রাজকুমার আর এসে না...
[২]
“আজ বিকেলে নদীর ধারে বেড়াতে যাবি তিন্নি?”, ঝাঁকড়াচুলো ছেলে পলাশ প্রায়ই জিজ্ঞেস করে তিন্নিকে। দুরন্ত এই ছেলেটা স্টেশনমাস্টারের, গেল মাঘে ষোলো’য় পা দিয়েছে। ওর চোখ দুটো বড্ড মায়াবী, তিন্নিকে যেন অনন্তকাল ধরে কিছু বলার অপেক্ষায় বসে আছে। সুযোগ পেলেই তিন্নিকে সাইকেলে চাপিয়ে ধানক্ষেতের ধারে নিয়ে যেতে চায় ও, হৃদয়ের কোণে জমানো সবটুকু ব্যথা, অনুভূতি যেন উজাড় করে দিতে চায়। “তোর জন্য আজ টগরফুল এনেছি, তোর খুব প্রিয় তো?”, বলে মাঝেই মাঝেই তিন্নিকে খুশি করতে চায়। “তিন্নি, আজ আমার জন্য ইলিশভাপা বানাবি রে, কতদিন খাই নি, তোর রান্নার হাতটা কিন্তু দারুণ!“, লাজুক মুখ করে প্রায়ই অনুরোধ করে ফেলে পলাশ। কুসুমগড়ের সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেটা তিন্নির সামনে এসেই কেমন যেন ক্যাবলাকান্ত হয়ে যায়।
[২]
“আজ বিকেলে নদীর ধারে বেড়াতে যাবি তিন্নি?”, ঝাঁকড়াচুলো ছেলে পলাশ প্রায়ই জিজ্ঞেস করে তিন্নিকে। দুরন্ত এই ছেলেটা স্টেশনমাস্টারের, গেল মাঘে ষোলো’য় পা দিয়েছে। ওর চোখ দুটো বড্ড মায়াবী, তিন্নিকে যেন অনন্তকাল ধরে কিছু বলার অপেক্ষায় বসে আছে। সুযোগ পেলেই তিন্নিকে সাইকেলে চাপিয়ে ধানক্ষেতের ধারে নিয়ে যেতে চায় ও, হৃদয়ের কোণে জমানো সবটুকু ব্যথা, অনুভূতি যেন উজাড় করে দিতে চায়। “তোর জন্য আজ টগরফুল এনেছি, তোর খুব প্রিয় তো?”, বলে মাঝেই মাঝেই তিন্নিকে খুশি করতে চায়। “তিন্নি, আজ আমার জন্য ইলিশভাপা বানাবি রে, কতদিন খাই নি, তোর রান্নার হাতটা কিন্তু দারুণ!“, লাজুক মুখ করে প্রায়ই অনুরোধ করে ফেলে পলাশ। কুসুমগড়ের সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেটা তিন্নির সামনে এসেই কেমন যেন ক্যাবলাকান্ত হয়ে যায়।
তিন্নি
সবটা পর্যবেক্ষণ করে, বোঝেও, ও কি কচি খুকি নাকি? তবে পাত্তা বিশেষ দেয় না সে,
তার দুচোখ ভরে যে এখন কেবলই সুদূর মহানগরীর স্বপ্ন। নদীর ধার,
ধানক্ষেত ও হ্যারিকেনের আলোয় আটকে থাকতে যে জন্ম হয় নি ওর,
তাই মায়াবী দুটি চোখের ইশারা খুব সহজেই উপেক্ষা করে যায় ও।
“তোকে খুব সুখে রাখবো রে তিন্নি”, পলাশ যেদিন
হাঁটু মুড়ে বসে বনফুল হাতে বলেছিল ওকে, সেদিনও হেসে উপেক্ষা
করেছিল নির্দ্বিধায়।
[৩]
“কই গো
বৌমা, টিফিন বানানো হলো? এত ধীরে
ধীরে কাজ সারলে চলবে কি করে বলো তো?”, শাশুড়ির হাঁক শুনে ঘেমে
নেয়ে একসা হওয়া তিন্নি আরও তাড়াতাড়ি হাত চালাতে থাকে, বেলা
দশটা বাজতে চললো যে! শ্যামবাজারের এক কোণে ছোট্ট ভাড়াবাড়িটার
জানলা থেকে একটুকরো আকাশ দেখতে দেখতে রুটি সেঁকতে থাকে সে। ছেলে স্কুলে বেরিয়ে গেছে
কোন সকালে, স্বামীর অফিস বেরোনোর আয়োজন করতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে
সে, শাশুড়ি মা তো বিন্দুমাত্র সাহায্য করেন না, কেবল আরামকেদারায় বসে হাঁকটাই পাড়েন।
তবে
তিন্নির স্বপ্ন কিন্তু সত্যি হয়েছিল, সত্যিই
একদিন দূরপাল্লার ট্রেনে করে কলকাতার পাত্র দেখতে এসেছিল তাকে, দূরসম্পর্কীয় সেই আত্মীয়ের হাত ধরেই। তার হাত ধরেই সবুজে মোড়া কুসুমগড় ও
ব্যথিতচিত্ত পলাশকে অবলীলায় ফেলে রেখে কলকাতায়, তার স্বপ্নপুরীতে
মহানন্দে পা রেখেছিল সে। স্বামী সামান্য কেরানী, শ্যামবাজারের
একটি ছোট্ট গলিতে দুকামরার এক ভাড়াবাড়িতে বিধবা মা’কে নিয়ে
বসবাস তার।
কালের
নিয়মে আজ কেটে গেছে দশটা বছর, এর মধ্যে তিন্নি বাপের
বাড়িতে গেছে হাতে গুণে মাত্র কয়েক বার, দূরত্বটা বড্ড বেশি
যে! সেই স্বপ্নবিলাসী, কিশোরী তিন্নি
আজ পাকা গিন্নী, এক পুত্রসন্তানের জননী। সারাদিন ঘরের অজস্র
কাজে ব্যস্ত থাকতে থাকতে, বৈষয়িক ও হিসেবী স্বামীর মন রেখে
চলতে চলতে কখন যে সে নিজস্বতাকে হারিয়ে ফেলে আপাতভাবে একটি যন্ত্রে পরিণত হয়েছে,
টেরই পায় নি। বিয়ের পর গঙ্গার ধারে বেড়াতে গিয়েছিল কয়েকবার,
আজকাল আর বহুদিন যাওয়ার ফুরসত পাওয়া যায় না। কলকাতা আর আকর্ষণ করে
না আমাদের তিন্নিকে।
বাড়িটা খুব ছোট লাগে তিন্নির, একচিলতে জানলা দিয়ে ধোঁয়ায় ঢাকা আকাশ দেখতে দেখতে ক্লান্ত সে! মাঝে মাঝে ফুরসত পেলে তাই বিকেলের দিকে ছাদে উঠে যায়, ব্যস্ততায় ঘেরা অতি যান্ত্রিক শহর যেন তার চোখে পড়ে না তখন। কল্পনার মায়াসিঁড়ি বেয়ে একছুটে সে চলে যেতে চায় কুসুমগড়ের মেঠো পথে। বাস্তবে তা সম্ভবপর না হওয়ায় সে চোখদুটি বুজে ফেলে, মানসপটে ভেসে ওঠে সোনালী ধানক্ষেত, নদীর পার, লণ্ঠনের আলো, কলাগাছের জঙ্গল ও ঝাঁকড়াচুলো একটি ছেলের মায়াবী দুটি চোখ, পড়ন্ত বিকেলের আভায় মাঝবয়সী তিন্নিকে যেন কিশোরী লাগে আবার।
বাড়িটা খুব ছোট লাগে তিন্নির, একচিলতে জানলা দিয়ে ধোঁয়ায় ঢাকা আকাশ দেখতে দেখতে ক্লান্ত সে! মাঝে মাঝে ফুরসত পেলে তাই বিকেলের দিকে ছাদে উঠে যায়, ব্যস্ততায় ঘেরা অতি যান্ত্রিক শহর যেন তার চোখে পড়ে না তখন। কল্পনার মায়াসিঁড়ি বেয়ে একছুটে সে চলে যেতে চায় কুসুমগড়ের মেঠো পথে। বাস্তবে তা সম্ভবপর না হওয়ায় সে চোখদুটি বুজে ফেলে, মানসপটে ভেসে ওঠে সোনালী ধানক্ষেত, নদীর পার, লণ্ঠনের আলো, কলাগাছের জঙ্গল ও ঝাঁকড়াচুলো একটি ছেলের মায়াবী দুটি চোখ, পড়ন্ত বিকেলের আভায় মাঝবয়সী তিন্নিকে যেন কিশোরী লাগে আবার।
আজ এতবছর পরেও বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধ পৃথিবীর
মতো ওর হৃদয় যেন হঠাৎ জুড়িয়ে যায়,সুদূর যে আজও তিন্নিকে বড্ড টানে...