মেয়েকে
স্কুল থেকে আনার পথে অটোতে উঠে ড্রাইভারকে বললাম... আইবুড়ো মোড়ে নামিয়ে দেবেন। পাশে বসে থাকা মহিলা শুনে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন.. "ওই বাড়ির চার ভাইবোনের আজও কি বিয়ে হয়নি ?..
আমি বললাম.. 'না '। শুনে.. অবাক হয়ে বললেন... "সে কি! বড়োটার তো এই পঞ্চান্ন বছর.. আমি আর ও একসাথে পড়তাম।" আমি কিছু না বলে
মুচকি হেসে... ভাড়া
মিটিয়ে দিয়ে নেমে পড়লাম মেয়েকে নিয়ে।
বাইরে
থেকে এসে.. খুব গরম লাগছিল.. তাই দখিনের জানলাটা খুলে দিলাম... এই জানলাটি রজত খুলতে বারণ করে রেখেছে। কারণ... জানলা খুললেই আইবুড়ো বাড়ির অন্দরমহল দেখা যায়... যেখান থেকে গালিগালাজ ভেসে আসে সবসময়। কিন্তু আজ খুলতেই দেখি অন্যরকম আবহাওয়া... সব ছুটোছুটি করছে আর একটা অনুষ্ঠানের গন্ধ পাচ্ছি। সব উৎসাহ দমন করে জানলাটা বন্ধ করে দিতেই কাজের বৌ ঘর মুছতে মুছতে
জানালো... "
জানো বৌদি... বুড়ো
খোকনের আজ বিয়ে । যাক্
এতদিন পর ও বাড়ির আইবুড়ো বদমান টা ঘুচবে। এরপর যদি বোন দুটোর বিয়ে হয়... ওদের বয়স তো প্রায় পঞ্চাশ হতে গেলো। কে নেবে বলো দেখি! তার উপর যা ঝগড়ুটে!" আমি শুনে বকা দিয়ে বললাম.. " এসব ফালতু না বকে কাজে মন দাও। "
মাসকয়েক
পর বিকালে জানলাটা খুলে দাঁড়াতেই দেখি... বৌটা একমনে কাজ করছে। মুখটা খুব মিষ্টি। দেখে মনে হয়... বছর কুড়ি বয়স। জানলা খুললেই... ও আমাকে দেখে হাসে.. আর ওর চোখ মুখ দেখলে মনে হয়... আমায় কি যেন বলতে চায়। আজও দেখে তেমনি মনে হল। আমি ইশারায় বাড়িতে আসতে বললাম। ও খুব খুশি হয়ে ইশারায় বলল... "আসছি"। কিছুক্ষণ পর একটা কলসি নিয়ে বেরিয়ে এলো। আমি বুঝতে পেরে জানলাটা বন্ধ করে সামনের বারান্দার গেট খুলে দিয়ে
দাঁড়িয়ে রইলাম। বৌটি..
এদিক ওদিক দেখে বাইরের
গেট খুলে.. বারান্দায়
এসে বসল। তারপর
কথায় কথায় যা জানতে পারলাম... সেটা শুনে আমি ভীষণ রকম অবাক হলাম।
বৌটির
নাম স্বপ্না.. ভীষণ
গরিবের ঘরের তিন নম্বর মেয়ে। এর পরেও দুটো বোন আছে। বুড়ো হলেও দু'বেলা পেট পুরে খেতে তো পারবে... এই আশায় তাকে এই বাড়িতে পাঠিয়েছে। স্বপ্না ভেবেছিল... কত বুড়ো তো বৌ এর সব চাহিদা পূরণ করে.. আর উনি তো মাত্র পঞ্চান্ন। কিন্তু বিয়ের রাতে বুঝেছে... এ বাড়িতে পেট পুরে খাওয়া ছাড়া.. দেহের কোনো স্বাদ মিটবে না। বহু কান্নাকাটি করে.. নিজেকে বুঝিয়ে.. সংসারে গাধার মত খাটতে লাগল আর ননদদের অত্যাচার সহ্য করে পড়ে রইল শুধু তিনবেলা খাওয়ার জন্য। একদিন ওর স্বামী মাঝ রাতে তার ছোট ভাই তপন কে ঘরে এনে.. ওকে ঘুম থেকে তুলে জানালো.. যত দিন তার পেটে বাচ্চা না আসে.. ততদিন মাঝরাতে তপন এসে তার পাশে শোবে। সে ঘুম চোখে... চুপচাপ বসে রইল.. আর ভাবতে থাকলো... "এও কি সম্ভব!" এভাবেই প্রতিরাতে একসাথে থাকতে থাকতে.. দুইজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলে। এদিকে পেটে বাচ্চা আসার পর থেকে.. তার স্বামী আর ওদের এক সাথে থাকতে দেয় না। কিন্তু স্বপ্না যে সত্যি তপন কে ভালোবেসে ফেলেছে। এখন সে কি করবে ভেবেই পাচ্ছে না।
কিছুদিন
পর হঠাৎ মাঝ রাতে ওই
বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে...
রজতকে
ডেকে বললাম.. " একটু দেখবে কি হল ওদের বাড়ি "! শুনে আমায় ধমক দিয়ে বলল..
" ঘুমাও তো! ওদের বাড়ি সব সময় এমন নাটক চলতেই থাকে। " আমি ধমক খেয়ে শুয়ে পড়লাম। পরের দিন কাজের বৌটা এসে জানালো... " ও বাড়ির নতুন বৌ স্বামীকে খুন করেছে। রাতেই নাকি তাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।" শুনে মনে মনে ভাবলাম...
" শেষ পর্যন্ত
ভালোবাসার জন্য স্বামীকে খুন করল!"
তিন
মাস পর মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে ফিরছি... এমন সময় পথে স্বপ্নার সাথে দেখা। আমি না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলাম... পিছন থেকে বৌদি বলে ডাক দিয়ে বলল... " তুমিও আমায় ভুল বুঝলে! " কথাটা শুনে আর পা বাড়াতে
পারলাম না। পিছন
ফিরে জানতে চাইলাম.. "
কি এমন হল যে.. খুন
করলে! " শুনে
ও কাঁদতে কাঁদতে বলল... " আমি খুন করিনি। সেদিন রাতে আমার ঘরে ঢুকেছিল তপন... তখন ওর দাদা ওকে বাধা দেয়.. আর ঘর থেকে বার করে দিতে যায়। কিন্তু চল্লিশ বছরের যুবকের কাছে ও পারবে কেমন করে.. সেও ধাক্বা দেয়.. ও সামলাতে না পেরে... দেওয়ালে মাথা ঠুকে যায়। যেখানে গাঁথা ছিল লোহার হুক.. সেটা মাথায় ফুটে গেলে রক্তে ভেসে যায় আর সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও আর জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তার যখন এলেন... তখন সব শেষ। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম... "তাহলে পুলিশ তোমায় ধরল কেনো?" ... স্বপ্না হেসে জানালো... "আমার মত গরিব ঘরের মেয়েদের তো শুধু দু মুঠো
ভাত হলেই চলে যায়.. তা
সে জেলের ভাত হলে ক্ষতি কি! আর তুমি বলো... যাকে এত ভালোবাসি.. তাকে কেমন করে জেলে পাঠাই! " শুনে আমি জিজ্ঞাসা করলাম... "তপন তোমার খোঁজ নিয়েছে? " স্বপ্না বহু কষ্টে চোখের জলকে দমন করে বলল... "একটি
জেল খাটা মেয়েকে কখনও কি আর ভালোবাসা যায়?" আমি আর কোন কথা বলতে পারলাম না.. শুধু মাথায় হাত রেখে বললাম.. "ভালো থেকো।"