গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৬ মে, ২০১৭

সপ্তাশ্ব ভৌমিক


উৎসারিত আলো

প্রসন্ননগর পাবলিক ক্লাবের হলঘরে 'রবীন্দ্র-জয়ন্তী' - অনুষ্ঠান চলছে। হঠাৎ করেই নকশাল নেতা চম্পকদা এসে লাঠির ঘায়ে রবীন্দ্রনাথের ফোটো ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিলেন। দর্শকরা পালাতে শুরু করল। প্রায় সকলেই নিমেষে হাওয়া। আমাদের শৈশবে এটাই খেলা হয়ে উঠল। ভাঙা টালি বা অ্যাসবেস্টসের টুকরো হত ফোটোর প্রতীক। তার মধ্যে কিছু টগর ফুল ছড়িয়ে দিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন। হঠাৎ করে একজন এসে সব ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেবে। কদিন পর নিজস্ব নিয়মেই এ খেলা বন্ধ হল। কিন্তু ফোটো ভাঙার স্মৃতি কেন যেন অটুট থেকে গেল। এখন আমি আর চম্পকদা দুজনেই জলপাইগুড়িতে থাকি। কিছুদিন আগে রূপ-মায়াসিনেমা হলের সামনে দেখা। ৬৫ বছরেও বলিষ্ঠ চেহারা। অকারণেই জিজ্ঞেস করে বসলাম, ‘চম্পকদা, তুমি রবীন্দ্রনাথের ফোটো ভেঙেছিলে কেন? চম্পকদা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘কিছু কি আর বুঝেশুঝে করেছিলাম। চারিদিকে ভাঙচুর চলছে, ভাঙলেই হিরো।বললাম এখন তোমার অনুতাপ হয় না। চম্পকদা বললেন – ‘একটুও না। আমরা তো দাদাদের কথা শুনে কম বয়সে অবুঝের মতো কাজ করেছিলাম। যখন ধান্দাবাজ নেতা, কোরাপ্টেড মন্ত্রী, আত্মপ্রচার-সর্বস্ব শিল্পী ঘটা করে রবীন্দ্র বন্দনা করে তখন কি আর কবির গায়ে চোট লাগে না’? 

আমি আর কথা বাড়ালাম না। রাতে বিছানায় শোয়ার একটু পরেই গোলমাল শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি আলখাল্লা পরা এক বৃদ্ধকে অনেকে মিলে আঘাত করছে। হয়তো সমস্ত শরীর রক্তাক্ত। নির্বিকার বৃদ্ধ তবু গান করে চলেছেন – ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো। নিরাপদ দূরত্বে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকরা ফিসফিস করে বলছে – ‘এ অন্যায়, ঘোর অন্যায়। কিন্তু কোনো সরব প্রতিবাদ নেই। হঠাৎ গাড়ির হেডলাইটের আলো বৃদ্ধের মুখে পড়তেই আঁতকে উঠলাম। অবিকল রবীন্দ্রনাথের মুখ। এ সময়ে কাঁধে এক জনের হাতের স্পর্শ পেলাম। মুখ ফিরিয়ে দেখি চম্পকদা! আমার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে বললেন –‘ভয় নেই, আমরা আঘাত করে কিছু করতে পারিনি, ওরাও পারবে না। এ গান কিছুতেই বন্ধ হবে না।কথা শেষ হতেই ঘুম ভেঙে গেল।