শুধু
অবাক নয় চমকে উঠেছিল সুমনা । চমকে ওঠারই কথা । কলকাতার এই অল্পচেনা যায়গায় একজন
ট্যাক্সিচালক তাকে, তার বাড়ির লোকেদের চেনে । সুমনা ভাবে কত আশ্চর্য ঘটনাই না ঘটে !
শিলিগুড়ি থেকে সুমনাকে মাঝে মাঝে কলকাতায় আসতে হয়না তা নয় । কিন্তু সে তো দু এক
দিনের জন্য কাকার ফ্ল্যাটে । ঐ
এপার্টমেন্টের দু একজন ছাড়া কে তাকে চিনবে এই ব্যস্ত আর ভীড়ে ঠাসা মহানগরে ! বছর
তিনেক আগে চাকরীর পরীক্ষার সিট পড়েছিল । সেবারই শেষ এসেছিল । আর এবার আসতে হল এক
আত্মীয়ের মেয়ের বিয়েতে । এবার দিদিকেও নিয়ে এসেছে । দিদি কোথাও যেতে চায় না । এবার স্কুলের গরমের ছুটি, সুমনার জেদাজেদিতে
আসতে রাজি হয়েছে । কিন্তু বিয়েবাড়িতে কিছুতেই আসবে না, এই সর্তেই এসেছে ।
লেকটাউনে
কাকার ফ্ল্যাটের কাছেই ট্যাক্সিটা পেয়ে গিয়েছিল সুমনা । লেকটাউন থেকে কুদঘাট আর কত
দূর । তবু দিদি পইপই করে বলে দিয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করে বেশি দেরি করবি
না । চিন্তা হবে । সুমনা বলেছিল “তুমিও যেমন দিদি, কলকাতায় বন্ধু পাবো কোথায় ? তুমি
ছাড়া আমার বন্ধুই বা আছে কে” ?
বলতে
গেলে সুজাতাই সুমনাকে মানুষ করেছে । বাবা যখন মারা গেলেন সুমনা তখন আট বছরের, সবে
ক্লাস টু পাশ করেছে । ট্যাক্সিতে উঠেই চালককে বললো ‘কুদঘাট যাবো’ । বিয়ের কার্ডটা
সঙ্গে ছিল, বাড়িয়ে দিয়ে বললো ‘এই ঠিকানায়’ । এক ঝলক কার্ডটা দেখে ফেরৎ দিয়ে দিল ট্যাক্সির
চালক । অভিভাবক হিসাবে নিমন্ত্রণ পত্রে ঠিকানা সহ দিদির নামটাই লেখা ছিল – সুজাতা
সেনগুপ্ত, ১৭/১ স্টেশন রোড, শিলিগুড়ি ।
কাউকে
জিজ্ঞাসা করতে হয়নি । ঠিক বাড়ির সামনে ট্যাক্সিটা থামলো । সুমনা নামলো । নেমেই
প্রৌঢ় একজনকে প্রনাম করলো । ট্যাক্সিটা তখনও দাঁড়িয়ে । দুজনের কথা ভেসে আসছে ।
প্রৌঢ় জানতে চাইলেন, তুই একলা এলি, সুজাতাকে নিয়ে আসতে পারলি না । আরো কিছুক্ষণ
দুজনে কথা বললো । বিয়েবাড়ির লোকজন আসা-যাওয়ার ভীড় ঠেলে ট্যাক্সিটা এগুতে চাইলো ।
তখনও দুজনে কথা বলছে । ধীরে চলমান ট্যাক্সিচালক প্রৌঢ়ের শেষ কথাটা শুনতে পেল ‘সেই
সুজন নামের ছেলাটাও তো উধাও হয়ে গেলো’ ।
বেশি
সময় নিল না। দিদির কথা মেনে এক ঘন্টার মধ্যেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, ফিরতে হবে এবার
। একটা ট্যাক্সির আশায় রাস্তায় দাঁড়ালো । অপেক্ষা করতে হলনা মোটেই । একটা ট্যাক্সিটা
এসে দাঁড়ালো সুমনার সামনে, চালক নেমে দরজাটা খুলে বললো ‘ওঠো’ । অবাক হল সুমনা । এ
তো আগের ট্যাক্সিটাই, যেটা করে এসেছিল । হয়তো আবার তার মত কাউকে নিয়ে এসেছে ।
সুমনা ভাবলো । কিন্তু ‘ওঠো’ বললো কেন ? লোকটি সুমনার চেয়ে অনেক বড় বয়সে । তাহোক, কিন্তু
একটা অচেনা মেয়েকে এক অচেনা ট্যাক্সি চালক তুমি সম্বোধন করবে ? রুষ্ট না হলেও অবাক
হল সুমনা । অবাক হওয়া তখনও কিছু বাকি ছিল সুমনার । গাড়ি স্টার্ট করেই চালক বললো ‘দিদি
আসে নি’ ?
এবার
চমকে গেল সুমনা । শিলিগুড়ি থেকে এত দূরে কলকাতায় একজন ট্যাক্সি চালক তাকে চেনে, দিদিকে
চেনে ! সুমনা ভাবতে চেষ্টা করলো, মানুষটা কে ? যে দিদিকে চেনে । দু গাল চাপা
দাড়িতে মুখটা যতটুকু দেখেছে তাতে তো কিছু মনে করতে পারলো না । উত্তর না দিয়ে
লোকটাকে বুঝতে চাইলো । চালক আবার কথা বললো ‘ কেমন আছে তোমার দিদি’ ? এবার উথাল-পাথাল
সুমনার মনে । প্রায় সমবয়সী এক পুরুষ তার প্রায় পঞ্চাশছোঁয়া দিদি কেমন আছে জানতে
চাইছে । কেউ তো ইদানিং এমন আন্তরিকায় জানতে চায়নি দিদি তার কেমন আছে । সুমনাই কি
ভেতর থেকে কোনদিন জানতে চেয়েছে ?
ভালো
করে জ্ঞান হবার পর দিদিকে কারো সঙ্গে মিশতে দেখেনি সুমনা । একজন স্কুল শিক্ষিকার
যতটা গাম্ভীর্য কাম্য তার চেয়েও যেন বেশি গম্ভীর দিদি বাইরের জগতে । অথচ পনেরো
বছরের ছোট সুমনার, দিদিই হল সবচেয়ে ভালো বন্ধু । সুমনা অতীতে চলে যায় । বাবা মারা
যাবার পর দিদি কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিল বাবা যখন মারা গেল, সুমনা তখন সবে ক্লাস
থ্রিতে উঠেছে আর দাদা সবে মাধ্যমিক পাশ করেছে । ক্রমে যেন একটা খোলসের মধ্যে ঢুকে
গেলো দিদি । বাবা মারা যাবার দু বছর পর মা বিছানা নিলেন, দাদা বিয়ে করে আলাদা হয়ে
গেল । দিদির এই নিজেকে গুটিয়ে নেবার পেছনে অন্য কোন কার্যকারণ আছে কি না, একটু বড়
হয়ে জানতে চেষ্টা করেছিল সুমনা । খুব হালকা মনে আছে, সুজন দা বলে একজন আসতো বাড়িতে,
মার সঙ্গে গল্প করতো, দিদিকে নিয়ে বেড়াতেও যেতো । তারপর হঠাৎ সুজনদার আসা যাওয়া
বন্ধ হয়ে গেল । মানুষটাই যেন উধাও হয়ে গেল ।
সুমনা
তিরিশে পা দিয়েছে । রেলের চাকরীটাও পেয়ে গেছে এক বছর হল । মা দিদির সঙ্গে পরামর্শ
করে ওর বিয়ের জন্য । সুমনা জানে । দিদি তার বন্ধু, তাই একদিন সাহস করে জিজ্ঞাসা
করেছিল “এমন করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে কেন থাকিস দিদি ? সংসার করলি না, শুধু দিয়ে
গেলি । কিছু পেতে চাইলি না ?”সুজনদাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলি কেন দিদি ?
দিদি
রাগ করেনি । মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল সকলের কি সব কিছু পাওয়া হয় ? আমি পাইনি, তোর
দাদা পেয়েছে, তুইও পাবি, এগুলোই তো আমার পাওয়া রে । দাদা বিয়ে করে অন্যত্র বাসা বেঁধেছে
দিদির মত নিয়েই । দিদি বুঝেছিল, এখনকার আধুনিক মেয়ে বিয়ে না হওয়া বড় ননদের সঙ্গে
মানিয়ে নিতে পারতো না । মাও তো তেমন করে জানতে চায়নি কোনদিন তার বড় মেয়ে কেমন আছে
। মাকে মাঝে মাঝে শুধু বিড়বিড় করে বলতে শুনেছে “সুজাতা হাল না ধরলে সংসারটা যে
কোথায় ভেসে যেত। তেমন ভাবে জানতে চেয়েছে কই তার বড় মেয়ে ভেতরে ভেতরে কতটা ক্ষয়ে
গেছে ! আর তার অচেনা কলকাতার এক ট্যাক্সি চালক কেমন প্রশান্ত কন্ঠে জানতে চাইছে
কেমন আছে সুজাতা ?
সুমনা
বললো “আপনি আমাদের ভালোই চেনেন দেখছি, আগে শিলিগুড়িতে থাকতেন ? আপনার নাম কি ? সামনের
মানুষটা উত্তর দিল অমন ভালো গান গাওয়া মার্জিত রুচির সুজাতা সেনগুপ্তকে শিলিগুড়ির
কে না চিনতো ? আমি হয়তো একটু বেশিই চিনতাম । আমি যখন চিনতাম তখন তুমি ফ্রক পরা
ছোট্ট মেয়েটি । সুমনা যেন অধৈর্য হয়ে উঠেছে । বললো “কিন্তু নামটা বলছেন না কেন ?”
ড্রাইভিং
লাইসেন্সটা পকেটেই থাকে, পেছনের সিটে সুমনার দিকে বাড়িয়ে দিল । চমকে উঠে শিশুর মত চেঁচিয়ে
উঠলো সুমনা । সুজনদা আপনি ! এখানে ! কোথায় থাকেন ? সুজনের মুখের কোন ভাবান্তর
হয়েছে কি না বুঝতে চাইলো সুমনা। আয়নায় শুধু নির্লিপ্ত মুখটাই দেখলো । গাড়ি চালাতে
চালাতেই কথা বলছে “থাকি, মানে এতো বড় আকাশ, একটা না একটা যায়গা জুটে যায়, আর একটা
মাত্র পেট, চলে যায় ঠিক” । নিজের কথা বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করলো ‘সুজাতা গানটা গাইছে
তো ? নাকি সংসার করতে গিয়ে ওসব চুকে বুকে গেছে” । কোন কথাই বোধয় কানে যাচ্ছিল না সুমনার । একটা ঘোরের মধ্যে
থেকে ভাবলো সুজনদাও তবে দিদির মত নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে ? সুমনা আর কিছু শুনতে
পাচ্ছিল না, সে তখন চলে গেছে অনেক পেছনে ।
একটু
একটু মনে পড়ছে সুমনার সেই এক্কা-দোক্কা খেলার বয়সের পুরোনো দিনের কথা । দিদি
স্কুলে চাকরী পেল, শুনেছিল দিদির বিয়ে হবে সুজনদার সঙ্গে । তারপর কি যে হল ! বাবার
মৃত্যু, মায়ের বিছানা নেওয়া, দিদির কাঁধে চাপলো সব দায় । সুজনদা শিলিগুড়ি থেকে কাউকে
কিছু না জানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল । দিদিকেও কিছু জানায়নি । পরে মার কাছে শুনেছিল
সুজনদা দিদিকে বলেছিল, “সব ঠিক হয়ে যাবে সুজাতা তুমি তোমার স্কুলের বেতনটা না হয়
সংসারে দিয়ে দিও । দুটো বেশি গানের টিউশানি করে আমি ঠিক চালিয়ে নেবো । সুজাতাই
পিছিয়ে গিয়েছিল । বলেছিল তা হয় না সুজন, ভাই-বোন দুটো ভেসে যাবে, তা হয় না । তুমি
সংসার করো, সুখী হও, আমাকে ভুলে যাও । সুজনদা আর কিছু বলেনি, চলে এসেছিল । তারপর
শিলিগুড়ি থেকেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, কেউ সন্ধান দিতে পারেনি । মাঝখানে কুড়িটা বছর
পেরিয়ে গেছে । সুমনার সন্বিত ফিরলো ফোনের তীব্র শব্দে । দিদি ফোন করেছে “তুই কোথায়
এখন ? এতো দেরি হচ্ছে কেন ? এখনও ট্যাক্সি পাসনি নাকি ? বাইরে বেরোলে তোর আর বাড়ির
খেয়াল থেকে না । দিদি চিন্তা করবে সে কথা আর মনে রাখিস না” । সুমনা জানিয়ে দিল “ফেরার
পথে ট্যাক্সিতেই আছি দিদি , তুমি চিন্তা করো না। জানো দিদি আজ এক কান্ড হয়েছে ।
তোমাকে গিয়ে সব বলবো, তুমি খুব খুশি হবে” । ও প্রান্তে দিদির ধমক “পাকামি করিসনা, তাড়াতাড়ি
ফের” । ফোনের স্পিকার অন করে রেখেছিল সুমনা । নিজের মনেই সুজন বলে চলেছে “সেই
কন্ঠস্বর কত বছর পরে শুনলাম, সেই বকুনি, আমাকে যেমন বলতো, দেরি হয়ে যাচ্ছে সুজন, আমি
না থাকলে ছোট বোনটা কিছুতেই পড়তে বসবে না” বলেই হো হো করে হাসলো ।
কতদূর
এলো সুমনা বুঝতে পারছে না। জিজ্ঞাসা করলো “আমরা কি অন্য পথে যাচ্ছি সুজন দা ?
দিদির ফোন করার মত দেরি তো হওয়ার কথা নয়” । সুজন জানালো “তুমি বুঝতে পারোনি, আজ
ফুসফুসে একটু ময়দানের হাওয়া ভরলাম, রোজই তো অন্যের জন্য গাড়ি চালাই, আজ কিছুক্ষণ
নিজের জন্য চালালাম । দেখো তোমার দিদি কিছু মনে করবে না” । কাকার এপার্টমেন্টের
সামনে গাড়ি থামলো । নামতে নামতে সুমনা বললো “ একবার পাঁচ মিনিটের জন্য আসা যায় না
সুজন দা” ? সুজনের ছোট্ট উত্তর এই জীর্ণ মানুষটার এখন আর সে সাহস নেই সুমনা”। বিষন্ন
সুমনা দাঁড়িয়ে রইলো ।
গাড়িতে ওঠার আগে সুজন আর একবার দেখলো, ফ্ল্যাটের চার তলায়
জানালা ধরে তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে এক নারীমূর্তি ।